দায়বদ্ধ ছায়াপথের প্রতিশ্রুতি দায়বদ্ধ সমাজে



দীপেন্দু চৌধুরী 
সরকারে থাকলে বিরোধী দলের সাদাকালো অভিযোগ সব সরকারকে শুনতে হয়। ভারতে ব্রিটিশ আমলে প্রচার মাধ্যমের এতটা রমরমা ছিল না। তখন রাজাবাদশাহ নবাবদের মত করে ঢেঁড়া পিটিয়ে মহল্লা মহল্লায় সরকার বাহাদুরের প্রচার করতে হত। ব্রিটিশ সরকারের সুচতুর ধূর্ত আমলারা রাজকর্মচারীদের দিয়ে সরকার বাহাদুরের ‘জো-হুজুর’ প্রচার করিয়ে নিতেন। করোনা আবহে ‘তথ্যপ্রযুক্তি’ শিল্প যে কোনও প্রচারের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সহায়ক শিল্পের দায়িত্ব পালন করছে। যতনা করোনা বিষয়ক তার থেকে অনেক বেশি রাজ্যগুলির এবং কেন্দ্রীয় সাফল্যের জয়গাঁথা। অর্থাৎ ‘জো-হুজুর’ প্রচার।
আমাদের দেশ ভারতে প্রায় সাড়ে তিনমাস করোনা ভাইরাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষভাবে আমরা লড়াই করছি। চিকিৎসা বিঞ্জানের শিক্ষকদের আন্তরিক দাবি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনাকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। সামাজিক হই অথবা অসামাজিকএইডস-র রোগের থেকেও অনেক মারাত্মক করোনা নামক মারণরোগকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবেএই দাবির সঙ্গে একমত হয়েই আমাদের ভাবতে হচ্ছে ‘জনস্বাস্থ্য নীতি’-র কথা।
ইতিহাস ঘাটলে জানা যাচ্ছে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আলমা-আটায় ১৯৭৮ সালে একটি স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্মেলন হয়। সেখানে সবার জন্য জনস্বাস্থ্যের দাবি ওঠে। এই দাবির মূল বিষয় ছিল সবার জন্য স্বাস্থ্য। ২০০০ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। মূল স্লোগান ছিল ওই সম্মেলনের। ১৯৭৮ সালের স্বাস্থ্য বিষয়ক ওই সম্মেলনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। সেটা হচ্ছে ‘স্বাস্থ্য মানুষের অধিকার’। জনপ্রিয় এই দাবিকে সামনে রেখে ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই লড়াই নিয়ে পৌঁছে যায় সারা বিশ্বের জনস্বাস্থ্য আন্দোনের কর্মীরা। বিভিন্ন দেশের নারী সংগঠন, বিভিন্ন এনজিও সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী, এবং জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীরা একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা লক্ষ্য উদ্দ্যেশ্য এক রেখে ২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সহযোগিতায় সাভারে একটি সম্মেলনের আয়োজন করে। এই সম্মেলনে বিশ্বের ৯২টি দেশ থেকে ১৪৫৩ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তার পরে কেটে গেল কুড়ি কুড়িটা বছর। করোনা আবহে আমরা উপলব্ধি করতে পারছি ভয়ঙ্কর এই মহামারী আমাদের কতটা অসহায় করে রেখেছে। অবহেলা করার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।   
১৯৭৮ সালের আগে অবশ্য উনিশ শতকের ইউরোপে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে ভাবনা চিন্তা প্রথম শুরু হয়। সময়টা দাবি করা হয়ে থাকে ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট যুগ। এই ভাবনার ভিত ছিল অবশ্যই বাণিজ্যিক। প্লেগ মহামারীর কারণে স্বাস্থ্য বিষয়ক নতুন নীতি প্রণয়ন করতে উদ্যোগ নিতে দেখা গিয়েছিল ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রককে। সামরিক প্রশাসনে আগে সু-স্বাস্থ্যের নজরদারি শুরু করেছিল ওই দেশের সরকার। মহাদেশীয় কৌশলী নীতি ছিল এই সিদ্ধান্তের আড়ালে।          
২০২০ সালে এসে আমাদের অভিঞ্জতা কি হচ্ছে? বিশেষত করোনা আক্রান্ত সারা বিশ্বের ছবি কি? উন্নত দুনিয়ার দেশগুলিকেও অচেনা এক আগুন্তুকের দাপটের কাছে অসহায় দেখিয়েছে। ইউরোপ আমেরিকার স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তুলনামূলকভাবে অনেক উন্নত। সবার জন্য স্বাস্থ্য এই নীতি না থাকলেও ‘কর্পোরেট স্বাস্থ্য’ ব্যবস্থায় সরকারও অনেকটা দায়িত্ব নিয়ে থাকে। তবুও সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক অভিঞ্জতা বলছে,  সেইসব উন্নত রাষ্ট্রের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা করোনা মহামারীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়াই করতে প্রায় ব্যর্থ বলা যায়। দীর্ঘ সময়ের পরে উন্নত পরিকাঠামোকে আরও বিঞ্জানসম্মত করে সেই সব দেশের সরকার পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করছে। ধনতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কয়েক দশক আগে থেকেই বিকল্প একটি মডেল এনেছিল বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক শিবির। উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে এই মডেলের শুরু। সাধারণ খেটে খাওয়া গরিব মানুষের জন্য জনস্বাস্থ্যে প্রথম দেখতে হবে তাদের অভাব, অনটন এবং না খেয়ে থাকে কিনা? বিষয়টা প্রথম থেকেই মানবিক এবং সার্বজনীন ছিল।  তারপরে গড়ে তুলতে হবে স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতার প্রচার। এই পরিকাঠামোর কাজ করতে গেলে প্রয়োজন দক্ষ একদল স্বাস্থ্যকর্মী। করোনা আবহে আমরা দেখলাম ভিয়েতনাম, কিউবা, কোরিয়ারমতো দেশ অতিদ্রুত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বিষয়ক সমস্যা থেকে বেরিয়ে আস্তে পেরেছে। করোনা নামক এক ভয়াবহ ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে এই সব দেশের চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা তুলনামূলকভাবে সফল। মৃত্যুহারও অনেক কম। আমরা মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে কোনওরকম রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা পরিহার করেই জীবনমুখী বিষয়টা উল্লেখ করলাম।
কিউবার প্রশাসকরা যেমন নিজেদের দেশের সমস্যা সামলে প্রতিবেশি দেশে মেডিক্যাল টিম পাঠিয়ে মানবিকভাবে সাড়া দিয়েছে। বিশ্বের জ্বলন্ত সঙ্কটের সময় প্রতিটি দেশকে পরস্পরের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। হুমকি দিয়ে ওষুধ বা চিকিৎসা সরঞ্জাম চাওয়া কোনও রাষ্ট্রনায়কের বিশ্বের একচেটিয়া অধিকার হতে পারে না।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের করোনা চিকিৎসার জন্য কোভিড হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে। বিভিন্ন বিতর্ক আছে। কেরল দাবি করছে তাদের মডেল দেশের সেরা মডেল। রাজস্থান বলছে তারাও এগিয়ে। মহারাষ্ট্রের ধারাভি বস্তির উদাহারণ রয়েছে সে দেশের শিবসেনা জোট সরকারের। আমরা আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কথা বলতে চাইছি। রাজ্যের সরকারি ডাক্তারদের সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স, ওয়েস্ট বেঙ্গল সম্প্রতি একটি প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছে, রাজ্যের করোনা পরিস্থিতি বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছে গেছে। আমাদের রাজ্যে যে হারে প্রতিদিন সংক্রমণ বাড়ছে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু। এই পরিস্থিতি বজায় থাকলে রাজ্য স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ভেঙ্গে পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।
সংগঠনটির অভিযোগ করোনা নিয়ন্ত্রনের জন্য প্রয়োজন ‘পরীক্ষা-আরও পরীক্ষা-রোগনির্ণয় আইসোলেশন’। এই পদ্ধতি মেনে কাজ করার ক্ষেত্রে রাজ্য প্রশাসনে ঘাটতি আছে। তারা আরও বলছে, মানুষের স্টিগমা কাটানোর জন্য কোনও সংগঠিত উদ্যোগ নেই সরকারের। পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় স্বল্প দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলা যেত। সরকারি ডাক্তারদের সংগঠনটি প্রশ্ন তুলছে, নন কোভিড রুগীর চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালগুলোয় সুসংহত পরিকল্পনার অভাব আছে। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সমস্যার প্রসঙ্গও সংগঠনের সদস্যরা জানাচ্ছেন। প্রত্যেক চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের অসুরক্ষিত অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে নন-কোভিড রুগীর চিকিৎসা পরিসেবা দিতে। স্বাস্থ্য পরিকাঠামো সরঞ্জামের অভাবের জন্যই তাদের এই ধরণের ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। সতের দফা দাবি সম্বলিত এই বিবৃতিতে তাদের মূল দাবি, জনস্বাস্থ্য নীতি মাথায় রেখে প্রতিটি পাড়া, মহল্লায়, গ্রামে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ক্লাব, অনুদান পায়নি সেই সব ক্লাবের যুবকদের মধ্যে থেকে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। যারা কোভিড রুগীর চিকিৎসা, পরিবহণ এবং সার্ভিলেন্সে সাহায্য করবে। এছাড়া হোম আইসোলেশন, সেফ হোমে থাকা রুগীদের খাবার প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কাজ করবে। এবং অঞ্চলের ভয় বা স্টিগমা কাটাতে সাহায্য করবে। প্রতিটি পুরসভা এবং পঞ্চায়েতের হাতে থাকা কমিউনিটি সভাঘরকে সেফ হোম হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তাবও দিচ্ছে এই সংগঠনের নেতৃত্ব।
সরকারি ডাক্তারদের দাবি এবং পরামর্শের সঙ্গে একই অভিমত পোষণ করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যয়ের নেতৃত্বাধীন গ্লোবাল অ্যাডভাইজারি বোর্ড। তাদের দাবি, সচেতনতার কাজ সমান ভাবে চালিয়ে যেতে হবে। মার্কিন সংস্থা ‘ন্যাশন্যাল ব্যুরো অব ইকনমিক রিসার্চ’-এর পত্রিকায় অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার সহ-গবেষকরা দাবি করেছে, জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের দিয়ে প্রচার করলে সেটা বেশি গ্রহণযোগ্য হবে।
বিরোধী দল কংগ্রেস এবং সিপিএম করোনা আবহে কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতাকে দায়ী করেই থেমে থাকছে না। কংগ্রেসের অভিযোগ দেশের করোনা সঙ্কট সামলাতে ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। করোনা সঙ্কটকে গুরুত্ব না দিয়ে রাজস্থানে ঘোড়া কেনা-বেঁচা নিয়ে ব্যস্ত বিজেপি নেতৃত্ব। আমাদের রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত বলে দাবি করছে রাজ্যের কংগ্রেস নেতৃত্ব।   
করোনা রোগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সচেতনতার প্রয়োজন মেনে নিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি বলেছেন, ‘বিশেষঞ্জদের কথা অনুযায়ী সামনের দু’টো মাস সংক্রমণ শিখরে উঠবে। ক্লাবগুলোকে অনুরোধ করব আপনাদের পাড়াগুলোকে আপনারাই ভালো রাখুন।’ সার্বজনীন সমাজের দায়বদ্ধতা আমাদের সবার। নিজেদের প্রতিশ্রুতি নিজেদের রক্ষার করার দায়িত্ব নিতে হবে। তবেই হয়ত আগামী সভ্যতায় উত্তরণের ছায়াপথ আমরা খুঁজে পাব।                                       

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?