শীত-গ্রীষ্ম-বৃষ্টিতে ভেজা নায়কের খোঁজে




দীপেন্দু চৌধুরী 
যে আমাকে চায় আমি তার কাছে যাব
গলায় খেলে না সুর
তবু আমি গাইব গান মৃদঙ্গ বাজাব
বৃষ্টি এলে
বাইরে বেরোব ভিজতে
নদী যদি পারে যেন আমাকে ডোবায়
আমি যেতে চাই না তীর্থে
পুণ্যে নেই লোভ
কেন ডাকো
মন নেই যাব না সভায়।।
(যাব না সভায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, পরিচয় শারদীয় সংখ্যা, ১৯৭৬)
নায়ক ছবিতে সত্যজিৎ রায় আমাদের দেখিয়েছেন ছবির বা চলচ্চিত্রের একজন প্রতিষ্ঠিত নায়কের ‘আত্মনুসন্ধান’। টাকার পাহাড়ে নায়ক ডুবে যাচ্ছেন। কিন্তু তার জীবনে সুখ নেই। শান্তি নেই। আবেগ নেই। অনন্ত দিগন্তহীন নেইয়ের আকাশে নায়ককে বাস্তবের জীবনেও অভিনয় করতে হয়। মনের শুকনো আবেগ মুখের স্মিত মৃদু হাসিতে লুকিয়ে নিতে হয়। গাদা গাদা ফুলের তোড়া হাতে অনুরাগীদের ভিড়। মনে শান্তি নেই তবু তিনি নায়ক। এই গল্প শুরু হয়েছিল মানব সভ্যতার উজ্জ্বল উত্তরণের সময়কাল থেকেই। নায়ক সিনেমার গল্পে থাকলেও আসলে দার্শনিক পরিভাষায় বুঝে নেওয়া যায় ঝা চকচকে সভ্যতায় ‘নায়ক’ হয়ে ওঠাটাই একটা অতি বাস্তবতা। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে থাকতে একসময় মনে হয়, প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আশায় জীবন থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। বিংশ শতাব্দীর গল্প, উপন্যাসে এমন সব ভুরি ভুরি উদাহারণ পাওয়া যাবে।
ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে এবং পরে সত্তর দশক পর্যন্ত গল্প উপন্যাসে বিভিন্ন নায়ক উঠে এসেছে ভারতীয় সাহিত্যে। এই নায়কদের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক পেয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন থেকে। সুদূর অতীতে যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। লেখা হয়েছিল সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে। উনবিংশ শতাব্দীর একটি বিতর্কিত উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’। তৎকালে সাধারণ মানুষের সমকালীন স্বাধীনতার উচ্চারিত আশা আকাঙ্খাকে প্রকাশ করতে পেরেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। হয়ত প্রায় দেড়শ বছর পরে এখন পড়লে মনে হবে এর মধ্যে অসংগতি আছে। আছে দ্বিধা, যে কারণে এই উপন্যাস নিয়ে মুসলমান সমাজ ক্ষুব্ধ। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই উপন্যাসে রাজনৈতিক আন্দোলনের একটা অস্পষ্ট কর্ম পরিকল্পনা আছে। যে কর্মসূচী প্রেরণা দিয়েছিল অরবিন্দকে। এই উপন্যাসে আছে এমন একটি গান যা সারা ভারতে বিস্তার পেয়েছে। আছে এমন একটি শব্দ বা স্লোগান। ‘বন্দেমাতরম’বন্দেমাতরম’ শব্দবন্ধ সমস্ত শক্তিকে উপেক্ষা করে আজও দীপ্যমান। যে শব্দ মন্ত্র উচ্চারণের মতো সারা ভারতে দাবানলের ন্যায় ছড়িয়ে গেল পরাধীন ভারতে এবং স্বাধীন ভারতে। আজও করোনা যুগে, করোনা সভ্যতায় এই গান গাওয়া হবেরাজনৈতিক প্রয়োজনে। সামাজিক প্রয়োজনে। আবার স্বাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় সংগীত হিসেবে। সাহিত্যবেত্তাদের দাবি, ইতিহাসের দিক থেকে আনন্দমঠকে ভারতীয় সাহিত্যের প্রথম রাজনৈতিক উপন্যাস বলা হয়ে থাকে
বঙ্কিমচন্দ্র কোন দলের? বঙ্কিমচন্দ্র গাঁধিবাদী না মার্ক্সবাদী? অথবা সংঘ পরিবারের আত্মীয়? আমরা এই বিতর্কে আগ্রহী নই। বঙ্কিমচন্দ্র যে সময় ‘আনন্দমঠ’ লিখেছিলেন সেই সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে। গাঁধিজীর তখনও ভারতীয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়নি। গাঁধিজী আসবেন ‘সন্ন্যাসী রাজা’-র ভূমিকায় পরে অনেক পরে।
ভারতে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক লেখক এবং পাঠকসমাজ গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায়। বিভিন্ন অঞ্চলে। রাজনৈতিক উপন্যাসের জন্য রাজনৈতিক চেতনার মান তৈরি হওয়া একটি প্রয়োজনীয় শর্ত। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ থেকে গাঁধির সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতীয় জনমানসে রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হচ্ছিল। আলোচ্য পটভূমি থেকেই আমরা পেয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস। এই উপন্যাস আনন্দমঠের মতো ঐতিহাসিক কাহিনী নয়। সমকালের একটি আন্দোলন। সাহিত্য বিশেষঞ্জদের দাবি, ভারতে  রবীন্দ্রনাথই প্রথম রাজনৈতিক উপন্যাস লেখেন। যে আন্দোলনকে ভিত্তি করে ঘরে বাইরে উপন্যাস লেখা হয়েছিল সেই আন্দোলন সারা ভারতে রাজনৈতিক চেতনাকে সংহত করেছিল সে সময়। এই উপন্যাসে আমরা পেয়েছি গরিবদরদী জমিদার নিখিলেশকে। যে বিদেশীদ্রব্য বয়কটের বিরুদ্ধে গর্জে উঠছে দেশের গরিব মুসলিমদের কথা ভেবেআপামর গরিব মানুষের কথা ভেবে। নিখিলেশ আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন হাটে বাজারে যারা বিদেশী দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি করে তারা গরিব। তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে তারা কোথায় যাবে? তারা খাবে কি?
ঘরে বাইরে লেখা হয়েছে যখন সে সময় আমাদের দেশের রাজনীতিতে গাঁধিজীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ঘরে বাইরে উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সামনে আরও একটি চরিত্র উপহার দিয়েছেনস্বদেশী আন্দোলনের নেতা সন্দীপ। তার অনেক গুণ। ভালো বক্তৃতা করতে পারে। মিথ্যে কথা বলতে পারে। ছল- চাতুরি করতে পারে। সম্ভবত অর্থ তছরুপও করতে পারে সুযোগ পেলে। একজন মহান লেখক সমকালীন সমাজের আন্দোলন থেকে তুলে আনেন একাধিক চরিত্র। ঘরে বাইরে উপন্যাসে নিখিলেশ যে-শক্তির প্রবক্তা, এই শক্তিকে দার্শনিক লেখক রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘ আত্মশক্তি’। সমাজ গড়তে গেলে আত্মশক্তির প্রয়োজন হয়। রবীন্দ্র বিশেষঞ্জরা বলছেন, তিনি নিজেও একই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করতেন।                            
শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ (১৯২৬) উপন্যাসের নায়ক সব্যসাচী। উপন্যাসের প্রধান এবং প্রথম নায়কলেখকের কলমে উঠে এসেছে, মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের সমস্তরকম বিদ্রোহ-বিক্ষোভের জীবন্ত প্রতিনিধি সব্যসাচী স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত রাজনৈতিক উপন্যাসে দুটি সমান্তরাল ধারা তৈরি হয়েছিল। একটি হল গাঁধি এবং কংগ্রেস আন্দোলনকে বৃত্তে রেখে। দ্বিতীয় ধারাটি ছিল সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের নিয়ে। সতীনাথ ভাদুড়ির পথেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এলেন নতুন চিন্তাকে আশ্রয় করে। দুটি ধারাকে মেলাতে চাইলেন তারাশঙ্কর। মানিক সরাসরি অন্তজ মানুষদের পক্ষ নিয়ে মাঝি মল্লারদের গল্প কথা শোনালেন। উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের ধারা বাহিকতায় ১৯৪৬ পর্যন্ত সাহিত্য লেখা হয়। লব্ধ প্রতিষ্ঠিত কালজয়ী ঔপন্যাসিকরা সময়কে বেছে নিয়েছেন। আন্দোলনকে বেছে নিয়েছেন। কালকে বেছে নিয়েছেন। যেমন সমরেশ বসু, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রমাপদ চৌধুরী এবং আরও অনেকে।
স্বাধীনতা উত্তর ভারতে দেশের আর্থ সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও সামাজিক চরিত্র বদলে যেতে থাকে। সর্বজনীন ভোটাধিকারের কারণে প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ, অন্তজ সমাজের মানুষ, জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ হাতে ক্ষমতা পেল। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় এই সব গোষ্ঠীর মানুষদের প্রজন্মের প্রজন্ম বঞ্চনার পরে সাক্ষর করা হল। শিক্ষার প্রসার ঘটল। ষাট-সত্তর দশক পর্যন্ত বাংলার সমাজ নিরবিচ্ছিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ ছিল বামপন্থীদের হাতে। তাই  পাহাড়ের গোর্খাদের আন্দোলন, উত্তরবঙ্গের কামতাপুরি আন্দোলন, মতুয়া আন্দোলন এবং আদিবাসী ঝাড়খণ্ডের আন্দোলন আলাদা করে নজরে পড়েনি। তার কারণ ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এদের মূলধারার সঙ্গে রেখে ভোট রাজনীতির মুনাফা তুলেছে। বামেদের মাটি দুর্বল হতেই এই সব সম্প্রদায়, গোষ্ঠীর মানুষ শুরু করে ‘আত্মপরিচয়’-র আন্দোলন। দীর্ঘ দিনের বঞ্চনা অত্যাচার এদের বাধ্য করে নতুন আন্দোলন গড়ে তুলতে। বাংলা সমাজের উপ-ধারার বঞ্চিত মানুষদের নিয়ে একটি দুটির বেশি উপন্যাস আমাদের চোখে পড়েনি। কেউ কেউ হয়ত বলবেন, দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-র কথা। অবশ্যই ব্যতিক্রমী উপন্যাস।
সত্তর দশকের পর থেকেই আমরা বাঙালি সমাজে ‘নায়ক’-দের হারিয়ে ফেললাম। আশি-নব্বইয়ের দশকে শুরু হল মতাদর্শগত অবক্ষয়। প্রশ্রয় পেল, স্বীকৃতি পেয়ে আদরণীয় হয়ে উঠল আকন্ঠ দুর্নীতিগ্রস্ত সুচতুর খল নায়করা (এরাও হতে পারত মহান সাহিত্যের চরিত্র)। তাই সমাজ হারিয়ে ফেলল ‘সমাজ সেবা’ করা সর্বোদয় আশ্রমের সর্বত্যাগী সমাজ সেবকদের। যে কথা গাঁধিবাদী সমাজসেবী পান্নালাল দাশগুপ্ত বলে গেছেন। তারও আগে তলস্তয় শুনিয়েছেন সর্বজনীন সমাজের কথা। আমদের আপনজন করে তুললেন, সর্বহিতায়ে কাজ করে দেখিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতন এবং শ্রীনিকেতনের সমন্বয় করে। সামাজিক দায়িত্ব কাকে বলে। গ্রাম সমাজ কাকে বলে। যুগের সঙ্গে সঙ্গে পরিকাঠামোর বদল হতে পারে। নায়কের পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু মানুষ যে আজও খোঁজে ঘামে ভেজা নায়ককে। সমাজ খোঁজে শীত গ্রীষ্ম বৃষ্টি রোদে ভেজা নায়ককে। সেই নায়ক তবেই উঠে আসে সাহিত্যের পাতায় পাতায়। লতায় পাতায়। লাল মাটির কাচা-পাকা রাস্তায় পাঠক আজও দাঁড়িয়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, ‘’আমাদের শিক্ষিত লোকদের ঞ্জান যে নিস্ফল হয়, অভিঞ্জতা যে পল্লীবাসীদের কাজে লাগে না, তার কারণ আমাদের অহমিকা। যাতে আমাদের মিলতে দেয় না। ভেদকে জাগিয়ে রাখে। তাই আমি বারংবার বলি, গ্রামবাসীদের অসম্মান ক’রো না, যে শিক্ষায় আমাদের প্রয়োজন তা শুধু শহরবাসীদের জন্য নয়, সমস্ত দেশের মধ্যে তার ধারাকে প্রবাহিত করতে হবে। ...... মনে রাখতে হবে শ্রেষ্ঠত্বের উৎকর্ষে সকল মানুষেরই জন্মগত অধিকার। ... আজ আমাদের সকলের চেয়ে বড় দরকার শিক্ষার সাম্য‘’ (শ্রীনিকেতন বার্ষিক উৎসবে প্রদত্ত ভাষণ। ৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৪০)                

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?