আমাদের বর্তমান সভ্যতা কি পথ হারাইয়াছে?
দীপেন্দু চৌধুরী
একবার মাটির দিকে তাকাও/ একবার মানুষের দিকে।/
এখন গভীর রাত;/ অন্ধকার তোমার বুকের ওপর কঠিন পাথরের মত,/ তুমি নিঃশ্বাস নিতে
পারছো না। (জন্মভূমি আজ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)। আমরা কেমন যেন একটা মিল খুঁজে
পাচ্ছি। কয়কদশক আগের লেখা এই কবিতার কয়েকটি লাইনের সঙ্গে। ‘’আই কান্ট ব্রিদ’’, আমি
নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। আমায় ছেড়ে দিন অফিসার। আমায় ছেড়ে দিন। বলছেন নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ
যুবক জর্জ ফ্লয়েড। আমি সেদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নিউজ পোর্টালে লাইভ
দেখলাম। মন্তব্য লেখার সুযোগ ছিল। খুব ভয়ে, অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে লিখলাম, এটা একুশ
শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের উন্নত গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকা? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না!
না তারপর আমি আর কিছু লিখতে পারিনি! কি লিখব?
আজকাল আমাকেও একটা অচেনা ভয় পেয়ে বসেছে। বয়স হচ্ছে
অথবা আমিও বর্ণবিদ্বেষের মিছিল ভেঙ্গে এক মিছিল থেকে আর এক মিছিলে হাঁটছি। খুঁজছি
সালেমনের মাকে। জর্জ ফ্লয়েডকে। ভয় হচ্ছে এই লেখার পর আবার, হ্যা আবার দেশদ্রোহীর
তকমা দেগে দেওয়া হবেনাতো? ভয়ের পুনরাবৃত্তি করলাম। ভয়ের, আতঙ্কের, অন্ধকার গুহা
থেকে আলোর ঠিকানায় চলতে চলতে আজও আমাদের ভয় করছে। ভয়ে ভয়ে আছেন প্রবাসী ভারতীয়রা।
তারাও হঠাত বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতিকে তারাও কেন
ভয় পাচ্ছে? তবু বলতে হবে লিখতে হবে স্বাধীনতার কথা। আমাদেরই লিখতে হবে ভালোবাসার
কবিতা, ভালোবাসার গান, গণতন্ত্রের গদ্য। গদ্যের ক্যানভাসে, রক্তের ক্যানভাসের সাদা
কালো ছবি আঁকতে হবে। আশাবাদের রঙে রঙিন ছবি আঁকতে হবে আমাদের। জর্জ ফ্লয়েডের রক্তাত্ত
গদ্যের পরিচ্ছেদ আমাদের লিখতেই হবে!
বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ালে, সাধারণ
খেটে খাওয়া মানুষের কথা শুনলে, ওই সব হেঁটে চলা ক্লান্তিহীন মানুষের কান্নার শরিক
হতে চাইলে অপরাধ! এই বিশ্ব কি তবে আজও বাসযোগ্য হয়নি। কিষান শ্রমিকের কবির কাছে
জানতে চাইছি। ১৮ বছরের কবির কাছে কান পাতছি। বাসযোগ্য পৃথিবীর খোঁজে আজও আমরা পথে,
ফুটপাথে নীল আকাশের লাল সূর্যের নীচে। সকাল আটটা ন’টার সূর্যের কাছে শপথ নিয়ে
আমাদের বলতে হবে বারে বারে।
আমি পদাতিক। আমি হাঁটছি। ৭ জুন বিক্ষোভকারীদের
হাতে প্ল্যাকার্ড। তাতে কোনটায় লেখা ‘আমরা বিরক্ত’, কোথাও লেখা কৃষ্ণাঙ্গের জীবনের
দাম না-দিলে কারও জীবনের দাম নেই’। মিছিল শুরু হয়েছিল আমেরিকার নিউ ইয়র্ক, শিকাগো,
লস অ্যাঞ্জেলস, সান ফ্রানিসকো, বস্টন সহ বিভিন্ন প্রদেশ থেকে। সংবাদে প্রকাশ ৭
জুনের বিক্ষোভে যারা অংশ নিয়েছেন, তাদের পরিচয় তারা মানবতাবাদী। সাদা-কালো, বাদামি
মিছিলে হেঁটেছেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ছোট বড় সব বয়সের মানুষ জর্জ
ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে হেঁটেছেন। ওরা পদাতিক। বিশ্বে বর্ণবিদ্বেষ নীতির
বিরুদ্ধে, মানবতার দাবিতে তারা পথে নেমে এসেছেন। জর্জ ফ্লয়েড এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ,
একটি রেস্টুরেন্টের নিরাপত্তা কর্মী তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারলে না বন্ধু। রেখে গেলে
তোমার হাজার হাজার সচেতন শ্বেতাঙ্গ বন্ধুকে, কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধুকে, বাদামি কমরেডকে।
গত ১১ দিন ধরে আমেরিকার শহরে রাস্তায় হাজার
হাজার মানুষ ন্যায়ের দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। হিংসাত্বক সংঘর্ষ, লুটপাট হয়েছে। কার্ফু জারি হয়েছে। চলেছে ধরপাকড়। তবু ন্যায়ের দাবিতে প্রতিবাদ থামেনি। গণতন্ত্রের দাবিতে প্রতিবাদ আজও অম্লান। মিছিলের পরে মিছিলে মানুষের মুখ। প্রতিবাদের অচঞ্চল উত্তাল জনসমুদ্রে একটাই
দাবি। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার বিচার চাই। সেই মিছিলের সমর্থনে সামিল হাজারে হাজারে
মানুষ। লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, ফ্রান্স, হংকং এবং কলকাতায় হেটেঁছেন হাজারে
হাজারে মানুষ। দৃপ্ত ভঙ্গিমায় বিশ্বের গণতান্ত্রিক নাগরিকের অধিকারে ওরা একাকার হয়ে
গিয়েছিল। জর্জ ফ্লয়েড ‘করোনা সভ্যতা’র ইতিহাসে আমাদের হাত ধরে পৌঁছে দিয়ে গেল। সেই
কারণে কি বারাক ওবামার কথায় ‘’দিস কান্ট বি নর্মাল ইন ২০২০।‘’ আমি ভয় পেলে চলবে? মন
মানল না। মন সায় দিল না চুপ করে বসে থাকতে। লিখতে বসলাম। মার্টিন লুথার কিং-এর
হত্যার পর কী তীব্র শোক নেমে এসেছিল আমেরিকা সহ সারা বিশ্বের রাস্তায়। আজ আবার মনে
পড়ে গেল।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতা আমাদের বিমূঢ় করে
দিয়েছিল। বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল। নাপামবোমার বারুদের গন্ধ আজও ইতিহাসের পাতায় যুদ্ধ
বিদ্ধস্ত ভিয়েতনামের কান্নার অধ্যায় মনে করিয়ে দেয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে
তামাম আমেরিকার নাগরিকেরা রাস্তায় নেমে এসেছিল। যুদ্ধবিরোধী মার্কিন নাগরিক,
মানবতাবাদী মার্কিন নাগরিক সেদিনও রাস্তায় নেমে এসে সৌভাতৃত্বের স্লোগান দিয়েছিল।
শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের নেতৃত্বে কৃষ্ণাঙ্গ-বাদামি হাতে হাত রেখে যুদ্ধ বিরোধী
স্লোগান দিয়েছিল। বিবেক যাদের আছে তারা কি ঘরে চুপ করে ভয় পেয়ে বসে থাকতে পারে?
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে আমেরিকার অর্থনীতি সারা
বিশ্বের সঙ্গে দুর্বল হয়েছে। চাকরি খুইয়ে বহু মানুষ দুশ্চিন্তায়। সংবাদসংস্থা
সূত্রে খবর, করোনা সংক্রমণ কৃষ্ণাঙ্গ সমাজেই সব থেকে বেশি। সেই অর্থে আমেরিকায়
মৃত্যুর হারও এই সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশি। সংবাদসংস্থা সূত্রে আরও জানা যাচ্ছে, আমেরিকায়
কৃষ্ণাঙ্গ জনসংখ্যা ১৩ শতাংশ। কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের ৪৪ শতাংশ কাজ হারিয়ে
দিশাহারা। এই সম্প্রদায়ের ২২ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এবং ২৩ শতাংশ
মানুষের মৃত্যু হয়েছে করোনা ভাইরাসে।
এ যেন এক অন্তহীন বিরাম বিহীন মিছিল। ৭ জুন
কৃষ্ণাঙ্গ নিরস্ত্র যুবক জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে মিছিল। আমেরিকা ছুঁয়ে
সারা বিশ্বে অহিংস প্রতিবাদ মিছিল ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের ভারতেও অক্লান্ত এক মিছিল
গত তিন মাস ধরে হেঁটে চলেছে। অনাহারে ক্ষুধায় হাঁটতে হাঁটতে একসময় রাস্তায় লুটিয়ে
পড়েছে সেই মিছিলের অভুক্ত মানুষ। অসুস্থ মানুষ। ওরা পরিযায়ী শ্রমিক। ওরাও কাজ
হারিয়ে বাড়ি ফিরছিল। মৃত্যু মিছিলের ছবি আঁকতে হয়েছে আমাদের। গদ্যের ক্যানভাসে। নতুন করে এক
মাত্রিক ভাষায় কেউ কেউ বলছেন ওদের পরিযায়ী শ্রমিক কেন বলা হবে? না সত্যিই ওদের ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ বলব না। আমরা জানতাম না। কৃষ্ণাঙ্গ যুবক
জর্জ ফ্লয়েড আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। ভারতের তথাকথিত পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত যুবক আছেন। যারা কাজ
হারিয়ে এই সেদিন পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার
হেঁটেছেন। রাস্তায় ছিল ওদের আত্মার আত্মীয়। ওদের ঘরে ফিরতে হবে। বাড়ি ফিরতে হবে।
জর্জ ফ্লয়েড আমাদের আন্তর্জাতিক এক উঠোনে নিয়ে এসে
দাঁড় করিয়েছেন। আমরা এক বিশ্বের মানুষ। কাজ হারানো সমাজের মানুষ। আমাদের লড়াই
‘ডিগনিটি’-র জন্য। আত্মসম্মান এবং মর্যাদার জন্য আমাদের লড়াই। তথাকথিত অসভ্য বর্বর
সভ্যতা পেরিয়ে কি আমাদের করোনা সভ্যতা চিনতে হবে? কি জানি? আমরা অপেক্ষায় থাকি।
জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার ন্যায় বিচারের দাবিতে। আমাদের কোনও ব্যাঙ্কার নেই। আমাদের কোনও বাঙ্কার নেই। আমরা মুক্ত আকাশের নীচে।
Comments
Post a Comment