জুনের আহ্বান নতুন মঞ্চ দেখতে পাব কি?





দীপেন্দু চৌধুরী
পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটিকে নিয়ে ২০১১ সালের পরে আবার রাজনৈতিক পালাবদলের আবহ তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে যুগ সন্ধিক্ষণের সময়। সমাজ বিঞ্জানী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এমনটাই মনে করছেন। বিশেষত করোনা যুগের শুরুয়াত এবং লাদাখে ভারত চিনের টানটান উত্তেজনার সময়কালে। ৩৪ বছর একচেটিয়া রাজ্য শাসন করার পরে ক্ষমতাচ্যুতি হয়েছিল বামেদের। তৎকালীন অন্যতম বামপন্থী মুখ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, আমাদের বিরোধী আসনে বসার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে! আমাদের মনে আছে ২০০১ সালে একটি নতুন জোট তৈরি করে বামপন্থী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার গড়ে তোলার প্রয়াস হয়েছিল। যার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সাল থেকে। তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটির জন্মলগ্নেএবং সহযোগী গোষ্ঠী হিসেবে তৈরি হয়েছিল পিডিএস নামে একটি পৃথক বাম-গণতান্ত্রিক গোষ্ঠী। সিপিএমের জনপ্রিয় যুবনেতা এবং  প্রাক্তন সাংসদ প্রয়াত সৈফুদ্দিন চৌধুরী ছিলেন এই গোষ্ঠীর প্রধান মুখ। সিপিএমের কট্টরপন্থীদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি রাজ্যে সমাজগণতন্ত্রী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিল পিডিএস।  
সৈফুদ্দিন চৌধুরী মনে করতেন, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সব শক্তিকে এক মঞ্চে আনতে হবে। ২০০১ সালে যে সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল, সেই জোট রাজ্যে সরকার গঠন করতে পারেনি। কারণ হিসেবে মনে করতে পারছি, পিডিএস নামক গোষ্ঠীটি দানা বাঁধতেই পারেনি। যে সময়ের প্রসঙ্গে আমরা আলোচনা করছি তৎকালে তৃণমূল কংগ্রেসের সেই শক্তিও ছিল না। বামফ্রন্ট সরকারকে ফেলে দিয়ে নিজেদের শক্তিতে রাজ্যের ক্ষমতা দখল করবে। পাশাপাশি সিপিএম সহ বামফ্রন্টের হাল ধরেছিলেন সিপিএমের চাণক্য বলে পরিচিত নেতা দলের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস। পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতা এবং বৃহত্তর বামফ্রন্টের মুখ হিসেবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে সামনে নিয়ে এলেন তিনিপরেরটা ইতিহাস। ২০০১ থেকে টানা ২০১১ সাল পর্যন্ত বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট রাজ্যের ক্ষমতায় থাকল। ইতিমধ্যে কমরেড অনিল বিশ্বাস প্রয়াত হলেন। ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ স্লোগান সামনে রেখেও সিপিএম সরকার বাঁচাতে পারলনা। দল এবং বামফ্রন্টকেও কয়েক বছর সামলাতে অসুবিধা হচ্ছিল তৎকালীন নেতৃত্বের   
সিপিএম পরবর্তীতে মেনে নিল রাজনৈতিক দর্শনে কোথাও একটা ভুল হয়েছিল। ২০১১ সালের পরে পরপর দুটি পার্টি কংগ্রেসে সিপিএম দলের রাজনৈতিক অবস্থান বদল হল। কৌশল হিসেবে সমস্ত স্তরের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তিকে একমঞ্চে নিয়ে আসার প্রয়াস শুরু করে সিপিএম নামক ভারতের বৃহত্তম বামপন্থী দলটি বিশেষত এই লাইনের মূল উদ্দেশ্য কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে তোলা। যে প্রচেষ্টা দলের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক হরকিষাণ সিংহ সুরজিত শুরু করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে আমরা আবারও আলোচনা করার সুযোগ পাব। ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস এবং জাতীয় কংগ্রেসের জোট ক্ষমতায় আসে। কোনও ন্যুনতম কর্মসূচী কি ছিল এই জোটের? নিন্দুকেরা বলে থাকে, সর্বনিম্ন কর্মসূচী ছিল রাজ্যের শাসন ক্ষমতা থেকে বামফ্রন্টের অপসারণ। যদিও রাজনৈতিক পরিস্থিতির দাবি মনে রেখে জোট সরকার থেকে জাতীয় কংগ্রেস জোট ভেঙ্গে সরকার থেকে বেরিয়ে আসে। তারপরে প্রকাশ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত দল কংগ্রেসের কোনও প্রকার জোট হয়নি। এটার একটা কারণ হিসেবে কেউ কেউ বলে থাকেন তৃণমূল দলে একটা অংশ আছে যারা অতি দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে সমঝোতা করতে বেশি আগ্রহী। দ্বিতীয় কারণটি আমাদের প্রবীণ সাংবাদিক বন্ধুদের মুখে শুনেছি। তৃণমূল কংগ্রেসে এবং কংগ্রেসের জোট ছিল অনেকটা শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের টগর বোষ্টমীর মতো। টগর নন্দ মিস্ত্রির সঙ্গে ঘর করবে কিন্তু তাঁকে হেঁসেল ছুঁতে দেবে না।   
আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম পশ্চিমবঙ্গ নামক একটি রাজ্যের ভোট-জোট রাজনীতি নিয়ে। এই রাজ্যটি আজও অবশ্যই বাঙালিপ্রধান রাজ্য হিসেবে পরিচিত। তবে বাঙালি সর্বস্ব অবশ্যই নয়। নানা জাতি, নানা ধর্ম নানা ভাষা, নানা মত বাংলার নাগরিক সমাজে মিশে আছে। এটাই আমাদের রাজ্যের বৈশিষ্ট। স্বাধীনতার আগে কংগ্রেস এবং সমাজবাদীদের ‘সেকুলার’ দর্শন, যে দর্শনের মূল হোতা গাঁধি, সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, বিধানচন্দ্র রায় প্রমূখ। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি এবং পরে সিপিএমের নেতৃত্বে বাম আন্দোলন এই দর্শনের দীর্ঘ ছায়াপথ তৈরি করে রেখেছে। এই রাজ্যের ধর্মনিরপেক্ষতার শিকড় তাই অনেক গভীরে। বাংলার বাঙালিদের তাই আত্মপরিচয়ের কঠিন কোনও সমস্যা বিশ্বায়ন উত্তর সময়ে নেই বললেই চলে। করোনা যুগের ইতিহাস পরে লেখা হবে।
এমতবস্থায় করোনা আবহ, লকডাউনকে কেন্দ্র করে নির্বাক ত্রাণ বন্টন এবং সবাক ত্রাণ বন্টন ছিল একটা অধ্যায়। দ্বিতীয় অধ্যায়ের পাঠ আমরা পেলাম ‘আমপান’ নামক ঘূর্ণিঝড়ের পরে। ত্রাণ নিয়ে যে ধরণের দুর্নীতির খবর সংবাদ মাধ্যমে আছড়ে পড়েছে, সেটা ঝড়ের গতিবেগের সঙ্গে তুলনা করলে খুব কিছু অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয় না। তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত সরকার যথেষ্ট সমস্যায় পড়েছে। দলের নিয়ন্ত্রণ প্রায় ধরে রাখা যাচ্ছে না। ন’বছর ক্ষমতায় থাকার পর প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধীতা শুরু হয়েছে। আঁচ পাওয়া যাচ্ছে ২০২১ সালকে মাথায় রেখে প্রশাসনের কিছু শীর্ষ আমলা ইতিমধ্যে অতি দক্ষিণপন্থী শিবিরের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। যদিও তাদের মধ্যেও টানাপড়েন রয়েছে। তারাও জল মাপছে। যেটাকে শেষের শুরু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই জন্যই আমাদের রাজ্য এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সরকার চালানোর দীর্ঘ অভিঞ্জতা থেকে সিপিএম এবং কংগ্রেস একটি নতুন জোট বা মঞ্চ কি গড়ে তুলবে? বাংলার প্রগতিশীল মানুষ যেটা চাইছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সিপিএম কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও জোট করেনি। যার ফল বামেদের ভুগতে হয়েছে। লোকসভায় আমাদের রাজ্য থেকে বামেদের কোনও প্রতিনিধি নেই। প্রদেশ কংগ্রেসকেও হোঁচট খেতে হয়েছিল ২০১৯ সালের লোকসভার নির্বাচনে। দেরিতে হলেও দুই দল উপলব্ধি করছে। বিজেপি-তৃণমূলকে আটকাতে কংগ্রেস এবং বামেদের মধ্যে যৌথ কর্মসূচীর জন্য জোট হওয়া ভালো। এই জোট নিয়ে  প্রশ্ন তুলছে বাম আমলে বিভিন্ন অত্যাচার সহ্য করা কংরেসের একদল নীচুতলার কর্মী। আপত্তি উঠে আসছে সিপিএম নেতৃত্বের একটা অংশ থেকেও। তারাও কংগ্রেস আমলে বামপন্থীদের উপর আক্রমণ ভুলতে পারছে না। ২০১৯ সালকে অতীত অধ্যায় ধরে নিয়ে ইতিমধ্যেই বামদলগুলি কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ কর্মসূচী শুরু করেছে। জাতীয় নাগরিক পঞ্জির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দিয়ে এই কর্মসূচী প্রাথমিক ভাবে শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে রাজ্যের তিনটি কেন্দ্রে বিধানসভা উপ নির্বাচনের কথা আমরা জানি। যে উপ নির্বাচনে তিনটি কেন্দ্রেই বিজেপি প্রাথী হেরে যায়। মধ্যে কয়েক মাসের বিরতির পরেই করোনা আবহ এবং লকডাউন অনুশাসন। মন্দ অর্থনীতির দোহাই দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সমানে পেট্রো-পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করেই যাচ্ছে। অর্থভান্ডারে সঞ্চয় বাড়িয়ে তুলতে। সাধারণ মানুষের আরও একদফা কষ্টের কারণ পেট্রো-পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি। গ্যাসে সাধারণ মধ্যবিত্তদের প্রদেয় ভর্তুকি প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে
সম্প্রতি পেট্রো-পণ্যের মুল্যবৃদ্ধিকে হাতিয়ার করে ফের পথে নামতে দেখা গেল বামদল এবং কংগ্রেসকে। কলকাতা সহ রাজ্যের সমস্ত জেলায় যৌথ প্রতিবাদ আন্দোলন কর্মসূচী ছিল এই জোটের। যুব কংগ্রেস আলাদাভাবে সারা ভারতে এই ইস্যুতে আন্দোলন কর্মসূচী রেখেছিল। কংগ্রেস এবং বাম নেতৃত্বের আবারও দেখা হবে ১ জুলাই বিধান রায়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানেকলকাতায় বিধান ভবনে এই অনুষ্ঠানে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব আমন্ত্রণ জানিয়েছে বাম নেতৃত্বকে। ২ জুলাই ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রয়াত নেতার জন্মদিনে দলের সদর দফতর হেমন্ত বসু ভবনে যাবেন সোমেন মিত্রের নেতৃত্বে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব। ২০২১ সালের বিধানসভার ভোটকে সামনে রেখে যৌথ মঞ্চের সলতে পাকানো কি শুরু হতে চলেছে?  
বাস্তববাদী কংগ্রেসকর্মী এবং নেতৃত্ব চাইছে যৌথ আন্দোলন করে থেমে থাকলে হবে না। চাই যৌথ মঞ্চ। বিজেপিকে রুখতে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় দেখতে চাইছে বামকর্মী এবং নেতৃত্বও। সেজন্যই চাই দাবি উঠে আসছে, যৌথ-মঞ্চ গড়ে ধারাবাহিক প্রচারমুখী আন্দোলন। এই দায়িত্ব বামপন্থীদেরই নিতে হবে। বাম্পন্থীরা দেহের ধমনীরমতো। রক্তের পরিবহণ স্বাভাবিক রাখে। সমাজের বিবেক হচ্ছে বামপন্থীরা।  
যৌথ-মঞ্চ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি গত বছর অক্টোবর মাসে কলকাতায় ঘোষণা করেন। জরুরি অবস্থার সময়ে ভারতের পরিস্থিতির কথা মনে রাখতে বলছেন তিনি। সেই সময় বিরোধীরা একজোট হয়েছিল। পুরনো অভিঞ্জতা মনে রেখে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের তানাশাহী জমানায় গণ-মঞ্চ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন ইয়েচুরি। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার শতবর্ষ পূর্তির সূচনা অনুষ্ঠানে ১৮ অক্টোবর এই গণ-মঞ্চ গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি। জুনের বাম-কংগ্রেসের যৌথ আন্দোলনের আহ্বান নতুন এক ঐতিহাসিক মঞ্চ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে কি? আমরা অপেক্ষায় থাকছি।                         

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?