বিদেশ নীতির ব্যর্থতা এবং চিনের পণ্য বয়কট
দীপেন্দু চৌধুরী
যদিও বিষয়গুলি নিয়ে ইতিমধ্যেই বিস্তর আলোচনা হয়ে গেছে। তবুও আমাদের মনে
রাখতে হচ্ছে। কারণ ভারতের আপামর নাগরিক চিন সীমান্তে ২০ জন সেনার মৃত্যু কিছুতেই
মেনে নিতে পারছে না। বিষয়টা অত্যন্ত স্পর্শ কাতর। ইতিহাস আমাদের এভাবেই মনে রাখতে
হয়, এবং পরেও মনে রাখতে হবে। প্রতিটি দেশের সীমান্ত সংঘর্ষ হোক অথবা যুদ্ধ হোক। এভাবেই
রক্তের ইতিহাস কালো-নীল, লাল কালিতে লেখা থাকে। সাদা কাগজে চোখের জলের ইতিহাস,
কান্নার ইতিহাস, রাজনীতির ইতিহাস লেখা হয়। ঘটনা যখন ইতিহাস হয়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিক
আকাশের সীমা অতিক্রম করে। তখনই অতীত ঘাটতে হয়।
সেনাবাহিনীর জওয়ান-অফিসারদের জীবন বলি রেখে প্রমাণ দিতে হয় জাতীয়তাবাদী
কর্তব্যের। সরকারি কর্মীর দায়বদ্ধতায়। গত ছ’বছরের ভারত-চিন সম্পর্কের বিষয়টা অন্যদের
মতো না হলেও নিজেরমতো করে দেখে নেওয়া যায়। গত কয়েক দশকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী
ন’বার চিন সফরে গেছেন। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন পাঁচবার এবং জাতীয়তাবাদী বর্তমান ভারতের এনডিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরে চারবার। ভারত
স্বাধীন হওয়ার পরে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে মনমোহন সিংহ
পর্যন্ত কেউ এতবার চিন সফরে যাননি।
লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষের মাত্র আট মাস
আগে ঐতিহাসিক মল্লপুরমে দুদেশের রাষ্ট্রপ্রধান নৌকাবিহার করেন। এবং কূটনৈতিক
আলোচনায় স্বল্প মেয়াদী দীর্ঘ মেয়াদী বিষয়ে আলোচনা সেরে নেন।। এটা হওয়া স্বাভাবিক,
দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে যখন বৈঠক হচ্ছে। ২০১৮ সালে চিনের
উহানের মনোরম হ্রদের ধারে দুই দেশের রাষ্ট্রনেতার আরও একদফা কূটনৈতিক আলোচনা
হয়েছিল।
এই আলোচনার পূর্বপ্রস্তুতি গড়ে উঠেছিল আরও অনেক অনেক আগে। ২০১৪ সালে ভারতে
রাজনৈতিক পালা বদল হয়। নির্বাচনে জয়ের পরে মোদীজি চিনের প্রেসিডেন্ট শি চিন ফিং-কে
আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানান। প্রশ্ন উঠছে, খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে তবে কি ভারতের কূটনীতি ব্যর্থ? গালওয়ান সীমান্তে
প্রতিবেশি দেশের সামরিক প্রস্তুতির বিষয়েও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আগাম কোনও
খবর ছিল না? দেশের ২০ জন সেনার প্রাণ চলে যাওয়ার পরে ভারতীয় নাগরিকদের আবেগকে বেছে
নেওয়া হল। ভারতে আওয়াজ ওঠে, চিনা পণ্য বয়কটের। কলকাতাসহ বিভিন্ন বড়
ছোট শহরে পোড়ানো হল চিনা দ্রব্য-সামগ্রী। অর্থনীতিবিদরা জানাচ্ছেন, ভারতের বৈদেশিক
বাণিজ্যের ১১% চিনের সঙ্গে হয়। চিনের মোট রফতানির মাত্র ২% থেকে ৩% ভারতের সঙ্গে
হয়। বাকি ৯৭% চিনের রফতানি হয় সারা বিশ্বের
বিভিন্ন দেশে।
২০১৯-২০ আর্থিক বছরে চিন থেকে ভারতে এসেছিল ৭৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্যসামগ্রী।
উল্টোদিকে ভারত থেকে চিনে রফতানিজাত পণ্যসামগ্রীর পরিমাণ ছিল ১৭ বিলিয়ন ডলার। এই
হিসেব আমাদের ভাবতে বাধ্য করছে, আবেগ নির্ভর চিনের জিনিস বয়কটের ডাক ধোপে টেকে না।
এটা সাময়িক একটা ইস্যু হতে পারে। বিভিন্ন আলোচনায় দাবি উঠছে, চিনের তৈরি জিনিস যদি
বয়কট করতে হয়, তাহলে সর্দার প্যাটেলের মূর্তির কি হবে? চিন থেকে আনা মেট্রো রেলের
কোচগুলির কি হবে? ভারতে ‘ব্যাঙ্ক অব চায়না’-র শাখা খোলার চুক্তি কি এনডিএ সরকার
বাতিল করার সাহস দেখাতে পারবে? এসব সিদ্ধান্ত নিতে হলে ভারত সরকারকে খুব সম্ভবত
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অনুমতি নিতে হবে। সেটা কি আদৌ সম্ভব?
এই প্রেক্ষাপটে একটি প্রসঙ্গ খুব কিছু অপ্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে হয় না? বেশ
কয়েক বছর আগের ঘটনা। অত্যন্ত বাগ্মী শ্রীকৃষ্ণ মেননের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের তৎকালীন
প্রধানমন্ত্রীর বহু আলোচনার পর, শ্রীমেনন জিঙ্গাসা করেন, ভারত সস্তায় আপনাকে পাট
চা ইত্যাদি সামগ্রী বিক্রি করতে পারে। আপনারা কোন কোন পণ্য সামগ্রী বিক্রি করবেন?
আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে
ওঠে। তিনি মুচকে হেসে বললেন, আমরা আয়ারল্যান্ডের দুটি বিখ্যাত জিনিস বেচতে পারি।
আলু এবং কবি। (পট্যাটোস এবং পোয়েটস)। এই উদাহারণ আমার বা আমাদের কবি বন্ধুদের আহত
করার জন্য উল্লেখ করিনি।
কংগ্রেস সহ ভারতের বিরোধী দলগুলি প্রশ্ন তুলছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র
মোদী সত্যিটা কি সেটা বলছেন না কেন? গালওয়ানে ২০ জন সেনার মৃত্যুর পরে নয়াদিল্লি
মনে করছে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার ম্যাপ নিয়ে ভারত-চিন দ্বিপাক্ষিক মতান্তর মূল
বিষয় নয়। চিনের আসল লক্ষ্য, গালওয়ান উপত্যকার অধিকার। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, সেটাই
মনে করছে ভারত সরকার। যদি এটা সত্যি হয় তা হলে এতদিন সরকার চুপ করে ছিল কেন? ১৯
জুন সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, ‘’ওখানে আমাদের সীমান্ত
পেরিয়ে কেউ ঢুকে আসেনি।‘’ কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি সহ প্রাক্তন বিদেশ সচিব
নিরুপমা রাও মনে করেন, সরকারের উচিত সংবাদ মাধ্যম এবং ভারতীয় নাগরিকদের পরিষ্কার মেসেজ দেওয়া। ওইদিনের সর্বদলীয় বৈঠকে
কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধি বলেন, ৫ মে লাদাখে চিনা সেনার অনুপ্রবেশের খবর
পাওয়ার পরেই সরকারের সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা উচিত ছিল। কেন্দ্রের ব্যর্থতার পরে বিজেপি
নতুন একটা বিষয় সামনে আনতে চাইছে। সেটা হচ্ছে, চিন এবং সিপিএম দলের মধ্যে
সুসম্পর্কের বিষয়টা খুঁচিয়ে তুলতে চাইছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত বিজেপি এই
বক্তব্য ভেবে চিন্তেই তুলছে। মাথায় আছে ভোট রাজনীতি। সামনের বছর বেশ কয়েকটি রাজ্যে
ভোট।
বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরলে ভোটকে সামনে রেখেই বিজেপি এই প্রসঙ্গ নতুন করে
খুঁচিয়ে তুলতে চাইছে। সামাজিক মাধ্যমে
সিপিএম ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য
সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র সম্প্রতি বলেছেন, সিপিএম কখনও চিন বা রুশপন্থী ছিল না।
আজও নেই। চিনের ‘চেয়ারম্যান’ কোনওদিন
সিপিএমের চেয়ারম্যান ছিল না। এটা ভুল পথ। আমরা চির কালই জোট নিরপেক্ষ নীতি নিয়ে
চলেছি। এই নিবন্ধে উল্লেখ করা যাক, ষাটের দশক থেকেই চিনের পার্টির সঙ্গে আমাদের
দেশের বৃহত্তম বাম দল সিপিএমের মত পার্থক্য রয়েছে। যেমন, যুগের সংঞ্জা, এর প্রধান
বিরোধ, গোষ্ঠীনিরপেক্ষতার অস্তিত্ব, শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান, শান্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক
প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ ও শান্তি প্রভৃতি বিষয়ে সিপিএম বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করেছে। ১৪
ই জুনের চিঠি পড়লে এই বিষয়ে জানা যেতে পারে।
১৯৬২ সালে ৩১শে অক্টোবর ‘দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে
জ্যোতি বসু বলেন, ‘আমি মনে করি ভারতের
সীমান্ত প্রতিরক্ষা জোরদার করা উচিত এবং আক্রমণকারী দেশের রাজনৈতিক চরিত্র
নির্বিশেষে আমাদের পার্টি ভারতের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তার সমস্ত প্রচেষ্টা
চালিয়ে যেতে দ্বিধা করবে না।’
সূর্যবাবুর সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে হয়, সারা বিশ্বে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের
নেতৃত্বে আরও অনেকের সঙ্গে ছিলেন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধি।
শেষ পাওয়া খবর, পূর্ব লাদাখে যে টানটান উত্তেজনা রয়েছে সেই উত্তেজনা কমিয়ে
আনার দায়িত্ব সমানভাবে নিচ্ছে ভারত-চিনের সামরিক কতৃপক্ষ। নিয়ন্ত্রণরেখায় দাঁড়িয়ে
থাকা দুই দেশের সেনা সরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে ভারত এবং চিন। আশা করব ভারত সরকার
দেশের নাগরিক, সংবাদ মাধ্যম এবং বিরোধী দলগুলিকে সঠিক তথ্য জানাবেন। আমরা সাধারণ
নাগরিক। আমরা দুই দেশের সাধারণ নাগরিক সীমান্ত উত্তেজনা কমিয়ে ভারত-চিন মৈত্রীর
পক্ষেই কথা বলব। শান্তির পক্ষেই কথা বলব।
Comments
Post a Comment