বর্তমান বাংলা রাজনীতির চেনা অচেনা প্রচ্ছদ







দীপেন্দু চৌধুরী
আজকাল হুতোমের কথা কেউ আমাকে জিগ্যেস করে না। আমি বলিও না। কারণ প্রাসঙ্গিকতা দাবি করে না। তবে সম্প্রতি জানতে পারলাম হুতোম নাকি গত চার বছর রাতে না বেড়িয়ে দিনে ঘুরে বেড়াত। ও কারণ হিসেবে বলেছে, গত চার বছর হুতোম একটা চোখে দেখতে পেত না। তাই দিনের বেলায় চড়তে বেরতো। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারের পশু হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে এখন দু’টো চোখে সব কিছু দেখতে পায়। হুতোমের আরও অনেকের মতো কোনও স্বাস্থ্যবীমা নেই। পশুর আবার স্বাস্থ্যবীমা? কিন্তু দিনের আলোয় ওদের পক্ষে বেড়নো? সেটা কি করে সম্ভব? সূর্যের আলোয় এক চোখ হোক অথবা দু’চোখ ওরা যে দেখতে পাবে না। হুতোমের কথায় সেটা নাকি অসুবিধা হয়নি। একটা হনুমানের পীঠে চড়ে ওই চার বছর হুতোম দিনের আলোয় এক চোখ নিয়ে ঘুরেছে। সেই কারণে ওকে এতদিন দেখা যায়নি। আর সামাজিক পারিবারিক উপেক্ষা সেটা ওদের নিত্যসঙ্গী। আমরা হুতোমের কথা না হয় আর একদিন আলোচনা করব। আসলে বীরভূম, মালদহ এবং বাংলার কথা বললেই আমার কেমন যেন হুতোমের কথা মনে হয়।
‘পরিবর্তন’ ২০০৯, পরিবর্তন ২০১১। তারপর আবার এক নতুন শব্দবন্ধ আমরা পেয়েছিলাম ‘প্রত্যাবর্তন’ এইসব শব্দের শক্তি এখন বাংলার বর্তমান রাজনীতির সময়ে গুরুত্ব হারিয়েছে। সম্ভবত পরম্পরা দাবিও করে না। আমাদের কাছে এই শতাব্দীর বিগত দশকে যে খবর এসেছিল। ২০০৮ সালের মে মাসে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বদলের ইঙ্গিত। ‘বদলা’-র নয়। বদলা নেওয়া হয়েছে কি হয়নি সে সব .........গরুড়ের ছানা বলতে পারবে। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে কোনওরকম জোট তৈরি হয়নি কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে। রাজনৈতিক  বিশ্লেষকরা দাবি করেন, বাম-বিরোধী শিবিরের পক্ষে জনমত তৈরি হওয়ার পূর্বাভাস সংবাদ মাধ্যম এবং রাজনৈতিক দলগুলির প্রথমসারির নেতৃত্বের কাছে ছিল। যে হিসেবটা পরবর্তী সময়ে মিলে যায়। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক জোট গড়ে ওঠে কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে। রাজ্যের ৪২টা লোকসভা আসনের মধ্যে ২৭ টা আসনে জেতে সদ্য গঠিত এই জোট। ২৭ টি আসনের মধ্যেই ছিল এসইউসি দলের জেতা একটি আসনও২০১০ সালের রাজ্যের পুর ভোটের আগে এই জোট সলতে পাকানোর কাজটা শুরু করেছিল।
সেটা আরও সাফল্য এনে দেয় বামফ্রন্ট বিরোধী বাম বুদ্ধিজীবীদের প্রচার। এই শিবিরের অনেক বুদ্ধিজীবী ২০০৯ সাল পর্যন্তও যারা নিজেদের বামপন্থী বলে দাবি করত। ২০১০ সালের পুরভোটের আগে তৃণমূলপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অনেকে প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিন। পাশাপাশি দলবদলু সুশীলসমাজ নিজেদের গা বাঁচাতে, এই স্লোগানও সামনে এনেছিল ‘কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপিকে ভোট দেবেন না’। এই প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় থাক, ইউপিএ-১ সরকারের থেকে বামফ্রন্টের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়াটা ছিল ভারতের জাতীয় রাজনীতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আজও মানতে হবে কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সেই সময় পরস্পরের সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে বামেদের এই সিদ্ধান্ত অনুঘটকের কাজ করেছিল। রাজনীতিতে কহবত আছে কলকাতা পুরসভা যারা দখল করে, পরবর্তীতে তাদের দলের নেতৃত্বে বিধানসভাও দখল করে মন্ত্রিসভাও গঠন করে। এটাই নাকি আমাদের রাজ্যে প্রচলিত ধারণা।
করোনা এবং লকডাঊনের কারণে কলকাতা পুরসভা সহ রাজ্যের পুর নির্বাচন কয়েক মাস পিছিয়ে গিয়েছে। কিন্তু দিল্লি রাজনীতির বর্তমান নবাব-বাদশাহরা কলকাতা পুরসভা সহ রাজ্যের পুরভোট নিয়ে তারা খুব একটা ভাবছে বলে এই মুহূর্তে আমাদের মনে হচ্ছে না। কারণটা নবাব-বাদশাহরা বলতে পারবেন। সারা দেশে ‘করোনাভাইরাস’ যে ধরণের আর্থ সামাজিক সমস্যা তৈরি করেছে সেটাকে উপেক্ষা করে থাকা যায় কি?  আমাদের রাজ্যে আবার নতুন মাত্রা তৈরি হয়েছে ‘আমপান’ নামক এক বিদ্ধংসী ঘূর্ণি ঝড়  আছড়ে পড়ায়। সমস্ত রাজ্যের কয়েকটি জেলা এখনও স্বাভাবিক হয়নি। এই ত্রিফলা আক্রমণে বাংলা যখন বিদ্ধস্ত ঠিক তখনই শুরু হল পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ ভোটের কর্মসূচী। শুরুটাই করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ‘পশ্চিমবঙ্গ জনসংবাদ র‍্যালি’ নামে এক ‘ভার্চুয়াল জনসভা’-র আয়োজন করে ‘ভার্চুয়াল ভাষণ’ আমাদের শুনতে হল। বিরোধীরা দাবি করছে, সারা রাজ্যে ৭১, ০০০ এলইডি টিভি লাগিয়ে এই ভার্চুয়াল জনসভা করা হয়েছে। বাম এবং কংগ্রেসের অভিযোগ করোনা, লকডাউন এবং ‘আমপান’-এর কারণে তৈরি হওয়া বাস্তব পরিস্থিতি ছেড়ে ভোটের প্রচার শুরু করে দিলেন অমিত শাহ? তৃণমূলের অভিযোগ এই ‘ভার্চুয়াল জনসভা’ করতে বিজেপি কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে।  
খুব প্রাসঙ্গিকভাবে বিষয়টা চলে আসে, অতিমারির কারণে আরথ-সামাজিক দুর্যোগ এবং জাতীয় বিপর্যয়ের সময় কি নির্বাচনী রাজনীতি করার সময়? বিরোধীদের অভিযোগ বিজেপি সেটাই করছে। রাজ্যসভার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি রাজস্থান, গুজরাটে ঘোড়া কেনাবেচা শুরু করে দিয়েছে। আধুনিক গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলে দাবি করা একটি দল ঘোড়া কেনাবেচাকেই অন্যতম রাজনৈতক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে কেন? আমাদের ঠিকঠাক বোধগম্য হচ্ছে না। সাময়িক এই কৌশল কতটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে? ভারতের একটা সর্বজনীন সংবিধান আছে। সেই সংবিধানে লেখা আছে ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ। তাই এই দেশে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা আছে। একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা কি সম্ভব?  
ভারতের আর্থসামাজিক সমস্যা বিষয়ে একটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করা যাক। কোভিড-১৯ এবং সেই কারণে লকডাউন বিশ্বের সব দেশের সরকারকেই করতে হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে কারও দ্বিমত হওয়ার কোনও কারণ নেই। ভিন্নমত উঠে এসেছে, আমাদের দেশে লকডাউন মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঘোষণা করতে পারত কেন্দ্র। তাহলে সংক্রমণের সংখ্যা আরও কম হত। রোগী মৃত্যুর সংখ্যাও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হত। আমাদের দেশে যেখানে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যাবস্থা নেইঅত্যন্ত দুর্বল স্বাস্থ্যপরিকাঠামো। সেই দেশে সর্বজনীন চিকিৎসা পাওয়া কতটা সম্ভব?  পরিসংখ্যানের কথা বলছিলাম। ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’-র রিপোর্ট বলছে, ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে মার্চের শেষে বেকারত্বের হার ছিল ৮.৮ শতাংশ। ২০২০-২১ আর্থিক বছরের এপ্রিল-মে দু’মাসে বেকারত্বের হার দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৩.৫ শতাংশ। বৃদ্ধির হারটা দেখুন। এপ্রিল মাসেই কাজ হারিয়েছেন ১২ কোটি ২০লক্ষ ভারতীয়। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ী এবং শ্রমিক। পাশাপাশি কর্মহীন বিপুল সংখ্যক ব্যবসায়ী এবং চাকরিজীবী। 
২০১৯-২০ আর্থিক বছরের শেষে উদ্যোগজীবীর সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৮০ লক্ষ। এপ্রিলের শেষে ১ কোটী ৮০ লক্ষ কমে এই সংখ্যা হয়েছে ৬ কোটি। একই মাসে অর্থাৎ এপ্রিল মাসে দেশের ২ কোটি ৭০ লক্ষ তরুণ কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছেন। যাদের গড় বয়স ২০-৩০ বছরের মধ্যে। যে আশঙ্কার কথা অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজন এবং নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন। এবং ধারাবাহিকভাবে বলছেন, কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি। তিনি দাবি করেছেন, মানুষের হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়া হোক।     
আমাদের আলোচনায় আমরা উল্লেখ করতে চাই এই মরসুমি রাজনীতির সময় বাংলায় রাজনৈতিক দলগুলি করোনা, আমপান এবং লকডাউন পর্বে সাংগঠনিকভাবে কি পরিকল্পনা নিয়েছে? তার আগে উল্লেখ করতে হয় বছরখানেকের মধ্যে রাজ্য বিধানসভার ভোট ভেবে নিয়ে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলকে নির্দেশ দিয়েছেন তৈরি থাকতে। কংগ্রেস এবং সিপিএমের ভূমিকা কি? একটু পিছনের দিকে ফিরে যাই, ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বাম এবং কংগ্রেস জোট করে যে সুফল পেয়েছিল তা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি তারা২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট না হওয়ায় আখেরে লাভ হয় বিজেপির। এটা একটা বড় ধাক্কা ছিল এই জোটের কাছে। রাজ্যে খড়গপুর, করিমগঞ্জ সহ তিনটে বিধানসভার উপনির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের জোট হওয়ার কারণে রাজ্যের নতুন বাতাবরণে বিজেপি নামক একটি সর্বগ্রাসী দলের প্রার্থীদের আটকে দেওয়া গেছে।
রাজ্যের করোনা-লকডাউন এবং আমপানের আক্রমণে সাধারণ মানুষ, নিম্নবিত্ত মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে, আশ্রয় হারিয়ে, কাজ হারিয়ে, চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে আজ দিশাহারা। ধ্বস্ত, ভেঙে যাওয়া জীবনযাত্রার সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাম এবং কংগ্রেস দলের নেতৃত্ব। কংগ্রেস সভাপতি সনিয়া গাঁধির নেতৃত্বে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত। প্রবাসী (পরিযায়ী) শ্রমিক কর্মচারিদের নিজের রাজ্যে ফিরে যেতে ট্রেন ভাড়া সহ সমস্ত আর্থিক দায় তুলে নিয়েছে বিভিন্ন রাজ্যের প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব। আবার আমাদের রাজ্যে পঞ্চায়েতস্তর পর্যন্ত করোনা, লকডাউন এবং আমপানের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মানুষের পাশে দিবারাত্রি সবসময় হাজির কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবী কর্মীর দল। ত্রাণ সামগ্রী, ওষুধ প্রভৃতি নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন কংগ্রেসের তরতাজা এই দলের সদস্যরা। এদের বর্তমান সময়ের ভূমিকা স্বাধীনতাপূর্ব ভারতের কংগ্রেস কর্মীদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সিপিএম ফিরে গেছে ষাটের দশকের কর্মসূচীতে। সিপিএম সহ অন্যান্য বামপন্থী দলের বিভিন্ন গণসংগঠনের কর্মীরা রাস্তায়, বস্তিতে, গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছেন ত্রাণ, কমিউনিটি কিচেন, সব্জি বাজার, শ্রমজীবী ক্যান্টিন খোলা সহ শিক্ষা সামগ্রী নিয়ে তারা হাজির।
কংগ্রেস এবং বামেদের নতুন ভাষায় গড়ে ওঠা জোট রাজ্যে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে অনেকটাই দুর্বল করেছে। এই জোট নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির। তৃণমূল কংগ্রেসের বড় সমস্যা, দলের একটা অংশ দুরনীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। দলের উপদেষ্টা প্রশান্ত কিশোর নিজেও এই বিষয়ে নাকি বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন। সূত্রের খবর, তৃণমূল কংগ্রেস থেকে একটি গোষ্ঠী বেরিয়ে এসে আলাদা দল করতে পারে। যে ইঙ্গিত রাজ্যের বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান দিয়েছেন। বাম-কংগ্রেস জোট সোস্যাল মিডিয়ায় অল আউট আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। ২০২১ সালের সমীকরণ কি হবে এই মুহূর্তে আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমাদের আরও একমাস অপেক্ষা করতে হবে।                                         

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?