জল জংলার দেশ আমরা যাচ্ছি কোথায়?






দীপেন্দু চৌধুরী
লকডাউন বলুন অথবা ঘরবন্দি। ৬৬ দিন একটানা বন্দি থাকার সময় মানুষ অবলম্বন করে নিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ মাধ্যমকে। এবং বাড়িতে জমে থাকা ধুলোমাখা বই, পত্রপত্রিকা এখন আমাদের অন্যতম অবলম্বন। এইসব ওইসব  পুরনো বইগুলি ধুলো ঝেড়ে যতটা পারা যায় আবার পড়ে ফেলা। অথবা করোনা সভ্যতায় অবনমন অথবা উত্তরণের আগে নতুন করে পড়ে ফেলা। নিজেকে এবং নিজেদের সুস্থ রেখে। ২০ মে সামাজিক মাধ্যমে আমার কাছে একটি মেসেজ আসে। মেসেজের বক্তব্য ছিল এই রকম, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তনী বর্তমানে কলকাতা পুরসভার ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার অমিতাভ পাল। ২০ মে আম্পান ঝড় আসে, সেদিন অমিতাভবাবু পরিস্থিতি অনুমান করে বিকেল চারটের আগে টালা ট্যাঙ্কে পৌঁছে যান। আমরা যারা খবর রাখি তারা জানি, ১০০ বছরের পুরনো কলকাতা শহরের এই প্রধান জলাধারটির স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো নয়। কাঠের কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে থাকা লোহা দিয়ে তৈরি এই ট্যাঙ্কের পরিষেবা গত একশো বছর ধরে সে আমাদের দিয়েছেবলা হয় টাইটানিক জাহাজের সম মানের স্টিল দিয়ে তৈরি এই জলাধার। ১০০ বছরের এই ট্যাঙ্কটি রুগ্ন হয়ে পড়ার জন্য পুরসভা সম্প্রতি সংস্কারের কাজও শুরু করেছে।
২০ মে আমপান ঝড় আসার আগে অভিঞ্জ অমিতাভবাবু টালা ট্যাঙ্কে পৌঁছে সহকর্মীদের নির্দেশ দেন, ট্যাঙ্কের ৪টি ইউনিটে ৮৫ হাজার মেঃ টন জল ভরে সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়ার। এই একটি বৈঞ্জানিক সিদ্ধান্তে প্রলয় সৃষ্টিকারী ১৮৫ কিলোমিটার বেগে আসা আমপান ঝড় ১০০ বছরের প্রবীণ টালা ট্যাঙ্কের কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। অটল অটুট আছে। ২০ মে থেকে ২৬ মে পর্যন্ত পুরসভার প্রচার বিমুখ ইঞ্জিনিয়ার অমিতাভ পাল টানা টালা ট্যাঙ্কে ছিলেন। কলকাতা শহরে বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরে আসার পর টালা ট্যাঙ্কের দুর্যোগের শহরে জল সরবরাহ আগের মতোই শুরু হয়।
এই মেসেজটি আমি এক বন্ধুকে ফরোয়ার্ড করেছিলাম। সেই বন্ধু রোমান হরফে আমাকে উত্তর দিল। এই মানুষগুলোর জন্য এখনো আমরা নিশ্চিন্তে থাকি। আরও খারাপ কত কিছু হতে হতে চলেছে। কারণ ‘ব্যাড টাইম ব্রিং মোর ব্যাড নিউজ’।
২৭ মে উত্তর ভারতে পঙ্গপালের আক্রমণ হল। আমার কাছে আসা পঙ্গপালের তিনটি ভিডিও আমি রাজ্য পরিবেশ দফতরের উচ্চপদস্থ এক আধিকারিককে মেসেজ করি। এবং লিখি, ম্যাডাম ভারতের সময় সম্ভবত ভালো যাচ্ছে না। উত্তরে তিনি লেখেন, পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেরই সময় খারাপ যাচ্ছে। আমার উত্তর ছিল, তবে ভারতের মনে হয় আরও বেশি খারাপ যাচ্ছে। করোনার পরে আমপান। তারপর পঙ্গপালের আক্রমণ। সম্মানীয় ভদ্রমহিলা উত্তরে লিখলেন, উগান্ডা, ফিজি, বাংলাদেশ, ব্রাজিল আরও কোনও কোনও দেশ সমস্যায় পড়েছে কোভিড-১৯-র সময়ে। আমার প্রশ্ন ছিল, আপনি কি বলবেন? কোভিড-১৯ একটা জটিল রোগ। প্রতিরোধের ভ্যাকসিন বা টিকা কতদিনে আসবে আমরা জানি না। কিন্তু আমপানের জন্য কাকে অভিযোগ করব? ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ু পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ নয় কি? সম্মানীয় আধিকারিক ভদ্রমহিলা সেদিন উত্তরে আমাকে জানালেন, ওই টা বিঞ্জানীরা জানাবেন। অপেক্ষা করতে হবে।
হ্যা আমরা অপেক্ষায় থাকব, আমরা অপেক্ষায় আছি। আমরা অপেক্ষায় আছি ১৯৯৯ সালের সুপার সাইক্লোনে প্রায় ১৫ হাজার লোকের মৃত্যুর পরেও। আমরা অপেক্ষায় আছি ২০০৯ সালের আয়লা নামক এক বিদ্ধংসী ঝড়ের পরেও। পরপর সাজিয়ে নিতে পারি ২০১৩ তে পিলিন, ২০১৪ সালে  হুদহুদ, ২০১৯ সালে ফণী, ২০১৯ সালে আরও একটা বিদ্ধংসী ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। এবং ২০২০ সালে আরও আরও অমানবিক শক্তি নিয়ে আমাদের বাংলায় দানবীয় শক্তিতে আছড়ে পড়ল আমপান। সারা বাংলায় এইঝড়ের তান্ডব যাই হোক, প্রতিটি ঝড়ের পরে সুন্দরবনের যে ধ্বংসের ছবি আমাদের সামনে আসে তার থেকে অনেক অনেক বেশি ক্ষতির কথা আমরা জানতে পারছি। যদিও ঝড়ের তান্ডব চলার দু’দিন পর থেকে আমাদের কাছে খবর আস্তে শুরু করে। জল জংলার দেশ সুন্দরবন বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে আজও। খাবার নেই, বাড়ি নেই, পানীয় জল নেই, শৌচাগার নেই, বিদ্যুৎ নেই। ওরা সেই ‘নেই রাজ্য’-র বাসিন্দা। মানুষ হাহাকার করছে। স্কুলের বই, কলেজের বই রাক্ষুসী নদী খেয়ে ফেলেছে। ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। মরসুমী আম লিছু জামরুল একটাও গাছে নেই। ক্ষয়ক্ষতির হিসেব রাজ্য এবং কেন্দ্রের প্রশাসন করছে। প্রতিটি ঝড়ের পরে যেমন করে থাকে। 
প্রতিবার বিদ্ধংসী ঝড়ের পরে যেমন হয়ে থাকে। নদী এ পাড় ভেঙ্গে ও কূল গড়ে নেয়। যেন হাহাকার। কয়েক দিন, কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস, কয়েক বছর। তারপর সভ্য সভ্যতার সঙ্গে নদীঘেরা সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের আর কোনও যোগাযোগ থাকে না। আমপান ঝড়ের তান্ডবের পরে চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকেছেজল থৈথৈ নদীর সভ্যতায় সুন্দর বনের মানুষ অভ্যস্ত। সুন্দরবনের আর্থ সামাজিক অবস্থা ভাঙতে ভাঙতে আমাদের নতুন করে ভাবতে বলছে না? একটা উদাহারণ দিয়ে বলা যাক। মূল সমতলের নাগরিক হিসেবে আমরা ২০ মের আমপান আছড়ে পড়ার আগে পর্যন্ত সুন্দরবনের প্রায় সব ব্লকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পেরেছিলাম। সেই সূত্রে একটি খবর উল্লেখ করা যাক। সুন্দরবনের স্থানীয় একটি সংবাদ মাধ্যম থেকে ছবি সহ আমার কাছে খবর আসে। আমপান ঝড় মোকাবিলা করতে একশো দিনের কাজে যুক্ত শ্রমিকদের নিয়ে সুন্দরবনে গঠন করা হল উদ্ধার বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। শুধু দক্ষিণ ২৪ পরগণা নয় রাজ্যে এই ধরণের উদ্যোগ প্রথম। ক্যানিং-১ ব্লকের নিকাটিঘাটা গ্রামপঞ্চায়েত অঞ্চলের ৪০-৫০ জনকে নিয়ে গড়া হয়েছে উদ্ধার বাহিনী। সদ্য তৈরি হওয়া এই বাহিনীর সদস্যরা মূলত নদী সংলগ্ন এলাকার বসিন্দাম্যানগ্রোভ জঙ্গল দিয়ে ঘেরা নদীর উপর নির্ভর করেই এদের জীবন জীবীকা চলে। তাই এরা শারীরিকভাবে খুবই শক্তিশালী।
‘সমতল’ শব্দটা একটা সময় সুন্দরবনের ক্ষেত্রে খুব ব্যবহার হত। আমরা গত কুড়ি বছর ধরে যারা সংবাদ মাধ্যমের কর্মী হিসেবে কাজের জন্য সুন্দরবন গিয়েছি তারা জানি। দুর্গম সুন্দরবনকে আমরা চিনি। নদী, নদীর খাঁড়ি পেরিয়ে, কখনও ভ্যান রিক্সা, তারপর পায়ে হেঁটে, মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে আমরা অনুন্নত সুন্দরবনে পৌঁছেছি। খবর করে আবার মূল সমতলে ফিরে এসেছি। অথবা স্থানীয় কারও বাড়িতে বা রাজনৈতিক দলের অফিসে রাত কাটিয়েছি। এই শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে সুন্দরবনে উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। তাও বিশ্ব ব্যাঙ্কের টাকায়। মাতলা নদীর সেতু। সোনাখালী-বাসন্তীত সেতু। রায়দিঘী সেতু। নামখানা সেতু। ইত্যাদি। তথ্যে দু’একটি ভুল থাকতে পারে। দুর্গম সুন্দরবন মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়। সুন্দরবনের কিছুটা অংশ কলকাতার শহরতলী হিসেবে পরিচিত।
কিন্তু আমপান ঝড়ের পর সুন্দরবনের মূল দুটি আর্থ-সামাজিক সমস্যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছে। সমস্যা এক এবং মূল সমস্যা- নদীবাঁধ নির্মাণ। স্থায়ীভাবে নদীবাঁধ নির্মাণ। আমপানের দাপটে মাইলের পর মাইল বাঁধ ভেঙ্গেছে দুই ২৪ পরগণা জেলায় বিভিন্ন ব্লকে। আনুমানিক ৯০ থেকে ১০০ কিলোমিটার নদীবাঁধ ভেঙ্গেছে বলে অনুমান রাজ্য প্রশাসনের। বাঁধ থাকলে বসত থাকবে। জমি থাকবে। নোনা জল ঢুকবে না। মাছ বাঁচবে। ফসল বাঁচবে। উদাহারণ হিসেবে আলোচনায় আসছে ‘হাতিবাঁধ’-র কথা। আয়লা তহবিলের টাকায় তৈরি দুই ২৪পরগণায় তৈরি হচ্ছে ১৮৪ কিলোমিটার বাঁধ। এই বাঁধ নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। আমপানের বিদ্ধংসী দাপট ৪০ মিটার ভিতের প্রকান্ড এই ‘হাতিবাধ’-র কোন ক্ষতি করতে পারেনি। সেচ দফতর সূত্রে জানান হয়েছে এই বাঁধ নদীর পাড়ে ৫.৮ মিটার এবং সমুদ্রের পাড়ে ৭.২ মিটার উঁচু করা হয়েছে।
সমস্যা দুই, ম্যান গ্রোভের ঢাল। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য যেমন সামুদ্রিক ঝড়ের ক্ষয় ক্ষতি থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করে তেমনি রক্ষা করে কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গকেও। আমপানের ধাক্কায় এই রক্ষণপ্রাচীরের আবারও বহু জায়গার ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। বন দফতর সূত্রে জানা গেছে সুন্দরী, গর্জন, গেঁওয়া, কালো বাইন পেয়ারা বাইন সহ মোট ৩২ প্রকারের ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে আছে। জল জংলার দেশ আমরা যাচ্ছি কোথায়? এই কথা আজ আর কেউ কি বলে? আমরা কি বলি? রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে সুন্দরবনে ১০ লক্ষ ম্যানগ্রোভ লাগানোর পরিকল্পনা করেছে রাজ্য সরকার। ঘোষণা আর বাস্তবে যে বহু যোজন ফারাক। আমাদের মনে আছে কেন্দ্রীয় সরকারের আয়লা তহবিলে দেওয়া পাঁচ হাজার কোটির কিছু বেশি টাকা ফেরৎ চলে গেছে। কারণ কি আমরা আজও জানতে পারিনি। তাই আপামর পশ্চিমবঙ্গবাসীকে দায়িত্ব নিতে হবে সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখার। বিঞ্জানভিত্তিক কারিগরি প্রকৌশল যদি ১০০ বছরের পুরণো একটা জলাধারকে আমপান নামক ঝড় থেকে বাঁচাতে পারে। সুন্দরবনকে আমরা বাঁচাতে পারব না কেন? সুন্দরবন বাঁচলে তবে আমরা বাঁচব। নদীবাঁধ থাকলে সুন্দরবনের বসত থাকবে। ম্যানগ্রোভ বাঁচলে সুন্দরবন বাঁচবে। সুন্দরবনের মানবসভ্যতা থাকবে। জীববৈচিত্র বাঁচবে।                                                    

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?