স্তুতি শুভেচ্ছা নয় জনান্তিকে জয়পত্র
দীপেন্দু চৌধুরী
আমরা মেনে নিলাম। আমরা
স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি হলাম। প্রাক স্বাধীনতার আগে কত কতজনকে রাজনৈতিক কারণে গৃহবন্দি
থাকতে হয়েছে। না ঠিক গৃহবন্দি বলা যাবে না। নজরবন্দি বলতে হবে। স্বাধীনভারতেও অনেক
রাজনৈতিক কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী নজরবন্দি থেকেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা
স্বেচ্ছায় মেনে নিয়েছি সরকারের অনুশাসন। আমরা গৃহবন্দি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও
একাধিক উদাহারণ রয়েছে। নজরবন্দি থাকার। রাষ্ট্র মনে করলেই রাষ্ট্রবিরোধী
গণতান্ত্রিক লেখক, শিল্পী, রাজনৈতিক কর্মী এবং নেতৃত্বকে গৃহবন্দি তথা নজরবন্দি
করে রেখেছেন।
রাজনৈতিক সংগঠক, কর্মী
যারা, তারা গৃহবন্দি থাকতে চাইবেন না। সংস্কৃতি জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র যারা তাদের
প্রসঙ্গ বললে বলতেই হবে, তারা গৃহবন্দিত্বকে আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে একরকম উপেক্ষা
করেই গৃহবন্দিত্ব মেনে নেয়। কারণ গৃহবন্দিত্ব এক প্রকার একাকীত্ব এনে দেবে।
সৃষ্টির আনন্দে সাবলীল প্রাচুর্যের ভাষায় উঠে আসবে মুঠো মুঠো খেরোর খাতা। সারা
বিশ্বের অনুসন্ধানী পাঠক ক্রান্তিকাল আবহে নিজের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজ। অখন্ড অবসর, একাকীত্ব, উদ্বেগ
তবু ভাবুক মন ভাবতে দিচ্ছে না! সীমাহীন অনীহা মানুষকে খুঁজছে। মানুষ মানুষকে
খুঁজছে। মানুষ আজ সমাজকে খুঁজছে। বৃহত্তর সমাজকে চাই আজ আমাদের। মানুষ অবলম্বন
চাইছে। আমরা বাঁচতে চাই, আকশের নীচে সূর্যের পাহারায় আমরা নিঃশ্বাস নিতে চাই। আমরা
বাঁচতে চাই।
একাকীত্বের নির্মম যন্ত্রণা থেকেই একদিন মহান এবং ধ্রুপদী সাহিত্যের জন্ম হয়েছিল। মরমিয়া চলচ্চিত্রের
জন্ম হয়েছিল। ক্যানভাসের শরীর বেয়ে শিল্পীর তুলিতে মায়াবী রঙের ভাষা আমরা পড়েছি। প্রথম
বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত
রাশিয়ার উত্থান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সমাজতান্ত্রিক চিন, ভিয়েতনাম, কিউবার উত্থান।
বার্লিন প্রাচীর গড়ে ওঠা এবং ভেঙ্গে দেওয়া। আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে
চলেছে ভারতীয় রাজনীতি। দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ, তেভাগা আন্দোলন, নকশাল বাড়ির আন্দোলন।
ধ্রুপদী সাহিত্য, ধ্রুপদী শিল্প, চলচ্চিত্র।
একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয়
দশকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে ফেলেছে। আধুনিক পুঁজিবাদের চরম
বিকাশের পর বিশ্বপুঁজি নতুন নতুন পথ খুঁজছে। নবতর ভাষার সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে
চাইছে। বিশ্বায়ন, ভোগবাদের যে সংস্কৃতি
আমাদের উপহার হিসেবে দিয়েছে সেই নৈবেদ্য আমরা চেটে চেটে উপভোগ করলাম। তারপর একুশ
শতাব্দীর প্রথম দশক থেকেই আমরা ধর্মের নামে চরম এক ঔদ্ধত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি।
ভাতৃঘাতী সভ্যতা আমাদের ভোগবাদের প্রচারে আটকে রেখেছিল। দ্বিতীয় দশকের আকাশ কালো হয়ে ছেয়ে গেল। মৃত্যু
মিছিল। মৃত্যু আক্রান্ত মানুষের। চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত মানুষের। কাজ হারানো
মানুষের। মৃত্যু পরিযায়ী শ্রমিকের। রেল লাইনের বুকে মৃত্যু, ক্ষুধার্ত গৃহহীন আত্মীয়
শ্রমজীবী মানুষের।
বুদ্ধ পূর্ণিমার
সন্ধেয় আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। সারা আকাশ কালবৈশাখী মেঘে ছেয়ে আছে।
কিছুক্ষণ আগে ঝড় বয়ে গেছে। উথাল পাথাল ঝড়। হিন্দোলিত হচ্ছে বড় বড় গাছ। আন্দোলিত
হচ্ছে গাছের শাখা প্রশাখা। ঝরে পড়া সবুজ পাতার আত্মীয়তার আহ্বান। গোধূলি লগনের ওই
ঝড়ের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠে এলো। বাতাস হাসছে, আকাশে আলোর সামিয়ানা নিয়ে এক
আকাশ পূর্ণশশী। কেউ যেন গেয়ে উঠল ‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’।
রবীন্দ্রনাথের
জন্মদিনে তিনি নিজেও কি একুশ শতাব্দীতে গৃহবন্দি? কি রকম যেন কৌতুক লাগে!
রবীন্দ্রনাথ গৃহবন্দি! না তিনি বন্দিত্ব মানেন না। আমরা সভ্যতার অভিশাপে নিজেরা
গৃহবন্দি হয়ে তাঁকে স্মরণ করছি। রবীন্দ্রবিশেষঞ্জরা বলছেন, বার্ধক্যের শেষপ্রান্তে
পৌঁছেও জওহরলাল ও তৎকালীন বামপন্থীদের পরিচালিত সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনকে
রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করেছেন। এবং অকৃপণভাবে সহযোগিতা করেছেন। সেই সময়ের রাজনীতির
মূল বক্তব্য এবং লক্ষ ছিল, সাম্রাজ্যবাদ, যুদ্ধ, উপনিবেশবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ,
বর্ণ-বিদ্বেষ, পরজাতি বিদ্বেষ এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা। জনমত গড়ে তোলা। আধুনিক
পুঁজিবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতার বিরুদ্ধে সমাজ সচেতন কবি যৌবনের প্রথমলগ্ন
থেকেই প্রতিবাদ আন্দোলন করে এসেছেন। তাই তিনি বলতে পেরেছেন ‘মুখ ফুটে তোর মনের কথা
একলা বলরে.........’ । ভারতে জাতীয়তা ও
আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ, চতুর্থ খন্ডে নেপাল মজুমদার লিখছেন, ‘’.........
প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালে ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের উদ্ভবের পর রোলাঁ- বারবুস
পরিচালিত যুদ্ধ ও ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে এবং বিশ্বশান্তি আন্দোলনে কবি কিভাবে
সহযোগিতা করিয়া আসিতেছিলেন, পূর্ববর্তী খন্ডগুলিতে আমরা তাহার বিস্তারিত আলোচনা
করিয়াছি।
কিন্তু আলোচ্য
পর্বটিকে পৃথিবীর অত্যন্ত সঙ্কটপূর্ণ কাল বলা যাইতে পারে। বস্তুত ইতালির আবিসিনিয়া
গ্রাসের পর থেকেই দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়।
............চোখের সম্মুখে কবি দেখিলেন ফ্যাসিস্ত শক্তিগুলি একটির পর একটি দেশ
গ্রাস করিয়া চলিল। ফ্যাসিজমের সঙ্ঘবদ্ধ এই উদ্দাম বর্বরতা ও পৈশাচিক তান্ডবলীলায়
কবি যে কী মর্মান্তিক আঘাত পান, এই কালের রচনা চিঠিপত্র কবিতা বক্তৃতা বিবৃতি ও
বাণী ইত্যাদির বিস্তারিত উধৃতি দিয়া তাহার একটি পরিচয় দিবার চেষ্টা করা হইয়াছে।
...... ‘লীগ অব নেশনস’-র এর পান্ডারা কেহই প্রতিরোধ করিতে আগাইয়া আসিল না। কিন্তু
এই প্রচন্ড ক্ষোভ ও দুঃখে কবি হতাশাগ্রস্তের ন্যায় ‘হা-হুতাশ’ করেন নাই কিংবা
বিভীষিকার প্রচণ্ডতায় কখনও আতঙ্কে দিশাহারা হন নাই। মনুষ্যত্বের ‘পরে কবির স্থির
বিশ্বাস ছিল। কবির সেই বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হয় যখন দেখিলেন এই বিভীষিকাময়ী রাত্রির
অন্ধকারে মনুষ্যত্বের একটি স্থির অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত রহিয়াছে।.........’’
ভারতে করোনাভাইরাস
নিয়ে যখন দেখা যায় অপ্রয়োজনীয় রাজনীতি হচ্ছে। আরও পরিলক্ষিত হয় আক্রান্ত মানুষকে
ধর্ম নামক এক আগ্রাসী সভ্যতায় টেনে আনা হচ্ছে। করোনাভাইরাস সীমান্ত মানেনি। এই
ভাইরাস কি নির্দিষ্ট একটি ধর্মের সভ্যতা মেনে আমাদের আক্রমণ করবে? ‘জাতি’ এবং
রাষ্ট্র চিনে চিনে কি এই ভাইরাস নির্দয় প্রলয় খেলায় মেতেছে? এখানেও আমরা রবীন্দ্রনাথকে
খুঁজে পাই। তিনি ধরায় না থেকেও আমাদের রাস্তা দেখিয়ে গেছেন। ধর্ম সম্পর্কিত
প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘’ধর্মের মোহ মানুষকে নির্জীব করে রাখে। তার বুদ্ধিকে
নিরর্থক জড় অভ্যাসের নাগ পাশে অস্তিতে-মজ্জাতে নির্দিষ্ট করে ফেলে। যে দেশে
প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোনও বাঁধনে তাঁকে বাঁধতে পারে না, সে
দেশ হতভাগ্য। সে দেশ স্বয়ং ধর্মকে দিয়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেটি সকলের চেয়ে
সর্বদেশে বিভেদ।‘’ (কালান্তর, হিন্দু-মুসলিম)।
Comments
Post a Comment