গোষ্ঠী উত্তরণের কথা আমাদেরই বলতে হবে





দীপেন্দু চৌধুরী
হ্যা সবাই বলছেন, পাঁচ পাঁচটা দিন কেটে গেল না উত্তর পাওয়া গেল না। না উত্তর আমরা পেলাম না। ধাঁধা রয়েই গেল। সংবাদ মাধ্যমও প্রশ্ন তুলছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ২০ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজের মধ্যে কেন্দ্রের সরকারি খরচের পরিমাণ কতটা? সরকার কত টাকা দিচ্ছে? করোনা পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের এই টাকা কতটা ছোট ব্যবসায়ী, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের কাজে লাগবে? আমরাও প্রশ্নটা তুলছি, আগামীদিনে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকস্তরের অর্থনীতিবিদেরা ব্যাখ্যা খুঁজবেন। আমাদের বলবেন। ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ২০ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজের ঘোষণা করতে পাঁচদিন সময় নিলেন। খুব সম্ভবত সঠিক সিদ্ধান্ত, কারণ ভারতীয় উপ মহাদেশে পঞ্চ প্রদীপ, পঞ্চ জবা (মাঙ্গলিক অর্থে ব্যবহার হয়), পঞ্চ নারী যথা সতী, সাবিত্রী, বেহুলা, অহল্যা এবং দ্রোপদী।
আমরা বাঙ্গালিরা পঞ্চব্যঞ্জন বলি। সেই অর্থে ভারতের অর্থমন্ত্রী সাতদিন বা দশদিন নয় পাঁচ দিন সময় নিয়ছেন ২০ লক্ষ কোটি টাকা ত্রাণ প্রকল্পের ধ্রুপদী ব্যাকরণ বোঝাতে। এটা কি ভেবে চিন্তেই নিলেন তিনি? বিজেপি পরিবার এবং ঘরানার সঙ্গে পরামর্শ করে? হতেও পারে তবে সারা দেশে বিরোধী স্বর অন্য কথা বলছে। আর্থিক বিন্যাস সংবাদ মাধ্যমে ইতিমধ্যেই প্রকাশ হয়েছে। তাই নতুন করে বিন্যাসে যাওয়ার খুব একটা প্রয়োজনবোধ করছি না। সেই যোগ্যতা আছে এমনটা দাবি করতে চাওয়াটাও ঔধত্য হয়ে যাবে
সংবাদে প্রকাশ, আর্থিক বিশ্লেষকদের হিসেবে, সরকারের ঘর থেকে মাত্র ২ লক্ষ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে। এর পরিমাণ জিডিপির ১ শতাংশের সামান্য বেশি। অর্থাৎ এই হিসেব হচ্ছে বাজেট অতিরিক্ত খরচ। করোনা এবং লকডাউনের কবল থেকে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দাওয়ায় ছিল ‘ফিস্কাল স্টিমুলাস’। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য জিডিপি-র ১০ শতাংশ খরচ হবে। বাস্তবটা আমরা অর্থনীতিবিদ এবং বিশ্লেষকদের কাছ থেকে জানতে পারলাম।    
প্রধানমন্ত্রীর ২০ লক্ষ কোটি টাকা আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণার অনেক আগে থেকেই করোনা আবহে ‘আর্থিক প্যাকেজ’ নিয়ে ব্যাবসায়ীদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। আমরা আমাদের ব্যবসায়ী বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তারা এই প্যাকেজের ব্যাপারে কতটা আশাবাদী? আমি এমন দু’জন ব্যবসায়ী বন্ধুর সঙ্গে কথা বলি, যাদের বাৎসরিক টার্নওভার এক কোটি টাকা। তারা জানায়, দু’জনেই নিজেদের ব্যাঙ্ক থেকে আলাদা আলাদাভাবে ফোন পায়। পৃথক পৃথক ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বলেন, অতিরিক্ত ‘ওভারড্রাফট’ ঋণ হিসেবে নিতে আগ্রহী হলে তারা ব্যাঙ্কে এসে যোগাযোগ করতে পারেন। আগের যা ঋণ আছে তার উপর ২০ শতাংশ হারে আরও অতিরিক্ত ‘ওভার ড্রাফট’ নিতে পারেনসুদের হার একই থাকবে। দু’ই ব্যবসায়ী বন্ধুই ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের ফোনের উত্তরে জানিয়েছিলেন, তারা ভেবে পরে জানাবেন।
তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ব্যবসা করেন যে ব্যবসায়ী বন্ধু তিনি আমাকে এপ্রিল মাসে এই কথা উল্লেখ করে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক প্যাকেজ যাই ঘোষণা করুক তাতে আমাদের লাভ কিছু হবে না। লকডাউনের কারণে আমার মাসে ২ লাখ টাকা করে খরচ হচ্ছে। ১০-১২ জন কর্মচারীর বেতন, অফিস, গোডাউনের ভাড়া, ব্যঙ্ক ঋণের সুদ। ইএমআই ইত্যাদি খাতে। অথচ ব্যবসা বন্ধ। টানা এই লোকসানের দায়িত্ব কি কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকার নেবে? সরকার কি আমাদের ছ’মাস অথবা তিন মাস বিনা সুদে ঋণ দেবে? অথবা আগে নেওয়া ঋণের জন্য সুদ মকুব করবে? ভদ্রলোক আরও প্রশ্ন তুলে দিলেন, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে সব কর্পোরেট সংস্থা থেকে আমরা পণ্যদ্রব্য এক মাসের চুক্তিতে নিয়েছি তাদের টাকা আমাদের দিয়ে দিতে হচ্ছে তাহলে লোকসানের বহরটা একবার ভাবুন। তার অভিযোগ ছোট এবং মাঝারি শিল্পের ব্যবসা যারা করে তাদের এখনও বিভিন্ন আইনি জটিলতার মুখে পরতে হয়। দেউলিয়া আইন নিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখবেন।
উৎপাদন শিল্পের ব্যবসা করা অন্য ব্যবসায়ী বন্ধুটির প্রশ্ন, লকডাউনের কারণে বিদ্যুতের বিলে তিন মাসের ছাড় দেওয়া হবে? ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণে কত শতাংশ আমাদের মকুব করবে সরকার? ইএমআইয়ে কতটা ছাড় দেওয়া হবে? অথবা মকুব করা সম্ভব? স্কুল কলেজে আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের ফি কি মকুব করা হবে? বাড়ি ভাড়া তিন মাসের জন্য মকুব করা সম্ভব? এই বন্ধু আরও বলেন, শুনুন ব্যাঙ্কের টাকা প্রতারণা করে বিদেশে চলে যেতে পারব না। কেন্দ্র আবার এদের বিপুল পরিমাণ ঋণের টাকা ‘অনাদায়ী ঋণ’ হিসেবে মকুব করে দেয়। আমাদের জন্য কিছু করবে না। এপ্রিল মাসের আলোচনা আজকের বাস্তবতায় কতটা মিলে যেতে পারে এই দু’টি উদাহারণ থেকে বোঝা যাচ্ছে। উল্লেখ করা যায়, দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে সারা দেশে কয়েক হাজার কৃষকের কৃষি ঋণ মকুব করা হয়েছিল।
অর্থনৈতিক উনয়ন মাপবার প্রচলিত ব্যবস্থা হল আয়। একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত আয়। যৌথ পরিবারের ক্ষেত্রে একটি পরিবারের যৌথ আয়। একজন ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে তার বাৎসরিক আয়। ঠিক একই রকমভাবে একটি দেশের ক্ষেত্রে জাতীয় আয়। মাথাপিছু জাতীয় আয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় কোন দেশ কতটা সমৃদ্ধ। করোনাভাইরাস আক্রান্ত বিশ্বের আগে ছিল পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থা। মানুষের কাছে সেটা ছিল এক বিকল্পহীন উপভোগের অন্যতম উন্নতমানের সামাজিক ব্যবস্থা। পাশাপাশি আছে কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। সমাজতান্ত্রিক এই গুটি কয় দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এতটাই উন্নত এবং সার্বজনীন যে করোনা আবহে তারাই দ্রুত সামলে উঠতে পেরেছে।
ধনী এবং দরিদ্র দেশের পার্থক্য বোঝার জন্য নব্বইয়ের দশকের একটি হিসেব আমরা ব্যবহার করতে পারি। তৎকালে বিশ্বের বেশি আয় করা কুড়ি শতাংশ দেশের নিয়ন্ত্রণে ছিল পৃথিবীর মোট জাতীয় আয়ের ৮৪.৭ শতাংশ। বিশ্বের দরিদ্র কুড়ি শতাংশ দেশের হাতে ছিল পৃথিবীর মোট জাতীয় আয়ের মাত্র ১.৪ শতাংশ। বিশ্বে যা বিনিয়োগ হয় তার ৮৪.২ শতাংশ ছিল ধনী দেশগুলির হাতে। নব্বই দশক থেকে উদার অর্থনীতির সুবাদে ভারত ক্রমশঃ বাজার অর্থনীতির সামনের সারিতে এগিয়ে এসেছে। গরিব দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উত্তরণ হয়েছে
কংগ্রেস ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজকে পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছে। কংগ্রেসের বক্তব্য, সরকারের এই প্যাকেজ ৩.২২ লাখ কোটির। কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি আবারও দাবি করেছেন গরিব মানুষের হাতে নগদ টাকা তুলে দিতে হবে। প্রয়োজনে কেন্দ্র কংগ্রেসের ‘ন্যায়’ প্রকল্পের নাম বদলে নতুন নামে এই প্রকল্প চালু করতে পারে। রাহুল গাঁধির বারে বারে এই দাবি থেকে বোঝা যাচ্ছে আমাদের দেশের সম্পদ বন্টনের অসাম্য। 
সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে অসাম্যের কারণে আমাদের দেশে ধনী দরিদ্রের হার ১০:৯০। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনায় এসে পড়ছে পরিযায়ী শ্রমিকদের অমানবিক দুর্গতি। সূত্রের খবর, ৩১ জন রাজমিস্ত্রী চেন্নাই থেকে লালগোলা আসার জন্য বাস মালিকদের সঙ্গে কথা বলে। বাস মালিকরা দাবি করছেন ২, ১৭০০০ টাকা। হায়রে মানবতা! প্রখর সূর্যের উত্তাপে ওরা বাড়ি ফিরবে। ওরা হাটছে একমাস, দু’মাস, নতুন সভ্যতা চিন চিনে ওরা হাঁটছে! ওদের কাজ গেছে। মাথার ছাদ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ওরা বাড়ি ফিরবে! গরম ভাত, পান্তা ভাত আর সন্তানের ওম পেতে চায় ওরা। ‘আত্মনির্ভর ভারত’! আমার দেশ আমার আত্মা।  
আমাদের এক সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধু আজ বললেন, দেশে যদি এই মুহূর্তে নির্বাচন হয় এনডিএ জোট ১০০ টা আসন পাবে বলে মনে হয় না। সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা এতটাই নিম্নগামী। কোথায় যেন উচ্চারিত হচ্ছে মানবতার ধ্বনি। অধিকার হ্যা অধিকার, আমরা উত্তরাধিকারের অধিকার নিয়ে গোষ্ঠী উত্তরণের কথাই বলব। এটা আমাদের দায়বদ্ধতা। রাজনীতির চোরা গলিতে, আমলাতন্ত্রের কৌশলী রঙিন চোখের শাসনে গোষ্ঠী উত্তরণ হারিয়ে যেতে পারে না। গোষ্ঠী উত্তরণের কথাই আমাদের বারে বারে বলতে হবে।                             

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?