ভাঙা পাল্কী দেখা গোধূলিবেলার আত্মস্মৃতি



দীপেন্দু চৌধুরী 
বর্তমান সমাজে থেকেও ব্যক্তিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে তর্পণ করার মত গঙ্গাসাগর খুঁজে পাওয়াটা হয়ত বিড়ম্বনা হয়েই থেকে গেল। এই বিষয় নিয়ে কিছু লেখার আগে নিজের কাছে প্রশ্ন করা উচিৎ। নারী বিষয়ক বিশেষত নিপীড়িত নারীর সামাজিক বিষয়ে লিখতে চাইছি কেন? গত তিন দশকের নোনা ঘামের স্বাদ বারে বারে ফিরিয়ে নিয়ে যায় কয়েকজন সুবিধাবাদী ব্যক্তি এবং তাঁদের সম্পৃক্ত সমাজের কাছে। খুব সম্ভবত তারা অপেক্ষায় থাকে নতুন কোনও ছিদ্র পথে আঘাত হানার। এঁদেরকেই কি বলে ‘বাঙ্গালি কাঁকড়া?’ এরাই কি সেই ‘আত্মঘাতী বাঙ্গালি’দের প্রতিনিধি? আমাদের এই সব খ্যাতনামা বন্ধুরা আছেন রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়, ‘পারলে একবার মালদা এসো’ বাক্য আজও ‘বিন্দুবাসিনী’ পাহাড়ের আকাশে বাতাসে গুমরে কাঁদছে। রবীন্দ্রনাথের ‘পলাতকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘নিষ্কৃতি’ কবিতায় মঞ্জুলিকা পুলিনকে বিয়ে করে ফরাক্কাবাদ চলে গিয়েছিল। বাস্তবের এক মঞ্জুলিকা সমাজ পরিবারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বারান্দার গ্রিলটা ভাঙ্গতে পারলেও মা এবং কৌশলী দাদার হুকুমকে উপেক্ষা করতে পারেনি। তাই চোখের জলে বয়সে অনেক বড় দোজ বরকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। আর পাঁচজন গ্রাম বাংলার সাধারণ মেয়ের মত। যতদূর জানি ভাঙ্গা মন নিয়ে আজও নীরবে সংসার করছে ভারতীয় নারীর আত্মসমর্পণের সংস্কৃতি মেনে। পুলিন সেই চোখের জল দেখেছিল কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর জ্যোৎস্না ভেজা এক নির্মল সন্ধ্যায়। বাস্তবের পুলিনের চামড়ায় তখনো পালিশ লাগেনি। বাস্তবের পুলিন ছিল হত দরিদ্র পরিবারের পর উপকারি এক বুদ্ধিদীপ্ত তরতাজা যুবক।  সে তাঁর ত্যাগের ব্রত আগলে রেখে বন্ধুদের কাছে বলত ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে’’। আসুন সঙ্গে আমরা বৃন্দ গান গাই, ‘’ব্যর্থ প্রেমের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো।‘’  
বাস্তবের মঞ্জুলিকার নাক উঁচু, উচ্চগর্বী দাদার মত বাংলার খাপ পঞ্চায়েতের অনেক সদস্য আমাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এঁরা আমাদের গড়ে তোলা বৃত্তে হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ে ব্যক্তি স্বার্থের প্রয়োজনে। নিজেদের পারবারিক প্রয়োজন না মিটলেই বাস্তবের পুলিনদের নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। যখন থেকে বর্ণ হিসাবে সামাজিকভাবে ‘ব্রাহ্মণ’ হতে পারে তারা, গাঁয়ের চামড়ায় নাগরিক পালিশ লাগে, বাস্তবের পুলিন হয়ে ওঠে প্রথম শ্রেণির নাগরিক। তখন থেকে এঁরা পারিবারিক বন্ধনে টানতে চায়অনেক অনেক ধন সম্পদের বিনিময়ে। মনে পড়ছে শ্রদ্ধেয় কবি সমর সেনের কথা। তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি। ‘’......বন্ধক রেখে বিদেশে পড়তে যেতে পারব না।‘’ বাস্তবের পুলিন সেদিন এই বাক্য মনে মনে আউড়ে ছিল।  
আমাদের তথাকথিত সেইসব পরিচত বন্ধুদের বাড়ির পাল্কী ছিল স্বর্ণখচিত। আমি আজ ছোট্ট আরও এক পারুল বোনের কথা দিয়ে শুরু করি। পাল্কীর গান শুনলেও পারুল নিজে আর পাল্কীতে চড়তে পারেনি সালটা ১৯৮৫। তপসিলি জাতির পরিবারের বড় মেয়ে। অত্যন্ত গরিব। মাটির বাড়ি। বাবা ক্লাশ টেন পর্যন্ত পড়েছে। বাজারে সব্জি বিক্রি, কখনও ট্রেনে ডিম সেদ্ধ হকারি করে স্ত্রী, দুই মেয়ে এবং এক ছেলে নিয়ে সংসার চালায়। ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলো। ফুটফুটে ফর্সা। প্রানচঞ্চল পারুলসকলের কাছে সে পাড়ার ভালো মেয়ে। মেধাবী ছাত্রী। সে বছর পারুল ক্লাশ এইটের ছাত্রী। লাল মোড়ামের রাস্তার ধারে মাটির দেওয়াল, খড়ের ছাউনি দেওয়া বাড়ি ওঁদেরগড়পড়তা প্রায় প্রতি মাসে ওঁদের বাড়ির সামনে দিয়ে তাসা পার্টি, ব্যান্ড পার্টির দল সানাই বাজিয়ে পাল্কীর শোভাযাত্রা করে বর-বৌ নিয়ে যায়। সানাইয়ের আওয়াজ শুনলেই পারুল ছুটে যায়। পাড়ার অন্যান্য মা-মাসি, দিদি-বৌদিরাও ছুটে যায় নতুন বৌয়ের মুখ দেখতে। পাল্কীর সিল্কের পর্দা টেনে সরিয়ে নতুন বৌয়ের লাজকু মুখটা তুলে ধরে বলে, ‘’দেখি দেখি মুখটা দেখি।‘’ নিজেই ঘোমটা সরিয়ে ভিন গাঁয়ের মেয়ে পাশের গ্রামের নতুন বৌয়ের লাজুক মুখ দেখে বলে ‘’ও গো এ যে আমার স্কুলের বন্ধু।’’ পারুলের বয়স তখন ১৩ কি ১৪ বছর। ওই পাড়ার তপসিলি জাতির প্রথম মেয়েযে সাফল্যের সঙ্গে ক্লাশ এইটে উঠেছে। বিএ পাশ করে স্কুলের মাস্টার হয়ে ছাত্র পড়ানোর স্বপ্ন ওর দু’চোখে। পারুলের একটা হাত বাঁকা ছিল। বাড়ির গরু, ছাগল বিক্রি করে ওর বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতার বড় সরকারি হাসপাতাল থেকে ঠিক করিয়ে এনেছিলাম। পারুল আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিল। কিন্তু তারপর?
সালটা ১৯৮৫। রাত এগারটা বারটা হবে। আমি আর আমার এক বন্ধু বাড়িতে ছিলাম। শুক্ল পক্ষের রাত। আমাদের গঞ্জ শহরের মাটির বাড়ির শিউলী ফুলের গাছটার পাতা চুঁইয়ে চাঁদের আলোছায়া গোবরলেপা উঠোনে এক উঠোন চাঁদের আলো লুটোপুটি খেলছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকা বিরামহীনভাবে ডেকে চলেছে। য়ারা গাছে বাদুড় পাকা পয়ারা খাচ্ছে। রাতচরা পাখী আলোর আকাশে পত পত করে উড়ে গেল। এক আলোআঁধারী পাতার ছায়ায় আমরা তখন বসে আছি। পারুলের বাবা হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে এসে বলল, ‘ভাই পারুল কে কোথাও খুঁজে পেছি না। বিকাল বেলায় খানিক বাজার থেকি আসছি বুলে চলি গ্যালে। তারপর আর খুঁজে পেছি না ভাই।’’
পারুলকে আমরা খুঁজে পেলাম পরের দিন সকালে পাঁচ কিলোমিটার দূরে রেল লাইনের ধারে। মৃত অবস্থায়। কেন পারুল মারা গেল? আমরা জানলেও বলা যাবে না। আমার ছোট্ট প্রাণচঞ্চল ছটফটে বোনের সমাধিতে সাদা ফুল রেখে শপথ করেছিলাম। আমি কাউকে কিছু বলব না বোনপারুলের মত কতশত মেয়ে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাচ্ছে অজানা অচেনা নাগরিক সমাজে।
১৯৮৭ সালের কোনও দিন হবে। তখন আমি ‘বসুমতি’ পত্রিকার ‘বিনোদন’ পাতার আবেগপ্রবণ সাংবাদিক। সম্পাদক বললেন, একটা ভালো সফট স্টোরি লিখতে। আমার স্টকে এরকম অনেক ছিল। আমি মনে মনে ভেবে নিয়ে সটান হাজির ‘সোনাগাছি’সেখানে এক সপ্তাহ খোঁজ করার পর সেই নারীর খোঁজ পেলাম। তিনি বাংলা সাহিত্য বা ভারতীয় সাহিত্যের সেইসব নারীদের একজন। বাঁসলই নদীর তির তির জল ভেঙ্গে যে কাশবনের জঙ্গলে ছুটে বেড়াত। বালুকাবেলার নদীর বালি পায়ে মেখে, কলস কাঁখে সে বালি খুড়ে স্বচ্ছ নির্মল জল বাড়ি নিয়ে যেত।   সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাড়িতে তাঁত ছিল। স্কুলে ক্লাশ এইটে পড়ার সময় পাশের গ্রামের ধনী পরিবারের ছেলের সঙ্গে প্রেম। কলেজে পড়ার সময় প্রেমিকের কথামত দিল্লি গিয়েছিল। আর বাড়ি ফেরা হয়নি। প্রেমিক ছেলেটি আর তাঁর দাদা ‘নিষিদ্ধপল্লী’র অন্ধকার ঘরে ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিল। তারপর কেটে গেছে ২০-২৫ বছর। তাঁর জীবনের রোজগারের সমস্ত অর্থ গ্রামের দুঃস্থ ছেলে মেয়েদের পড়ার জন্য তিনি গোপনে নিজের গ্রাম এবং আশপাশের গ্রামে পাঠাতেন। আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছিলেন একটা শর্তে,  তাঁর জীবন নিয়ে কোনদিন কিছু লেখা যাবে না। অত্যন্ত ব্যথায়, যন্ত্রণায় নিজের সম্পর্কে শেষ কথা বলেছিলেন, ‘’শরৎবাবুর চন্দ্রমুখী হয়েই থাকতে চাইআমার আসল নাম জানতে চাইবেন না।‘’ আপনার আসল নাম আমি আজও জানি না। আপনি বেঁচে আছেন কিনা তাও জানি না। আপনি আমার প্রণাম নেবেন ‘অন্নদাদি’
ভারতে প্রত্যন্ত গ্রামে আজও নাবালিকার বিয়ে দেওয়াটা যতটা না সংস্কার তাঁর থেকে ঢের বেশি কারণ আর্থ-সামাজিক। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়ন উত্তর আধুনিক মেয়েদের সমাজে আমরা কতটা সচেতন?  কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে নিয়ে বিদ্বজ্জন সমাজ ধারাবাহিকভাবে আদৌ সোচ্চার কতটা? প্রদীপের নীচেই আলো থাকে। বিচ্ছিন্নভাবে হলেও গ্রামের সাধারণ পরিবারের মেয়েরা নিজেরাই সচেতনভাবে এগিয়ে এসে নিজেদের বিয়ে রুখে দিচ্ছে।
করোনা আবহেও আমাদের রাজ্যের একটি জেলায় ঘটেছে এমন ঘটনা। কয়েক কিলোমিটার হেঁটে এসে থানায় অভিযোগ জানিয়েছে এক নাবালিকা। সমাজপ্রভুদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন অমেরিকা সহ মধ্য প্রাচ্যের যে টুকরো টুকরো ছবি আমাদের সামনে আছে, এবং সিরিয়া ইরাকের গৃহযুদ্ধের কারণে শরণার্থীর যে ঢল ইউরোপে আছড়ে পড়েছে সেই উদ্বাস্তু দলেও হাজারে হাজারে শিশু কন্যা আছে। ওঁদের আগামী ভবিষ্যতের দায়িত্ব উন্নত দুনিয়ার গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব তথা মানবিক সংগঠকদের নিতে হয়েছে হয়ত বাএই দাবি করা আজকের বাস্তবতায় নিশ্চয়ই অনধিকার চর্চা হবে না। সেই কথা মাথায় রেখে ‘ইউনেস্কো’ ২০৩০ সালকে সময় সীমা ধার্য করেছে। যাতে নাবালিকা বিয়ে নামক সভ্যতার এই অভিশাপ থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি।
 http://www.unesco.org/new/fileadmin/MULTIMEDIA/HQ/ERI/icons/quotes-L.png;pvc3ecf34125d1d84aThe world has changed since 1966 – but our determination to provide every woman and man with the skills, capacities and opportunities to become everything they wish, in dignity and respect, remains as firm as ever. Literacy is a foundation to build a more sustainable future for all.http://www.unesco.org/new/fileadmin/MULTIMEDIA/HQ/ERI/icons/quotes-R.png;pv8d1b40b45afc01ce                                                                                                              UNESCO Director-General     
 সংবাদ সংস্থার খবর, করোনা পরিস্থিতিতে ভারতে গার্হস্থ্য হিংসা বাড়ছে। নথিভুক্তি হয়ত কম হচ্ছে। আরও খবর, স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। ওই রিপোর্ট দাবি করছে, ইটালি সহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে ১৪৮২ জনের উপর সমীক্ষা করে জানা গিয়েছে, করোনা আবহে আনুমানিক ৮০ শতাংশের বেশি দম্পতি সন্তানধারণের পরিকল্পনা বাতিল করেছেন। আগামী ভবিষ্যতের আর্থিক অনিশ্চয়তা এর অন্যতম কারণ বলে তাদের মত। রাষ্ট্রপুঞ্জের করা পৃথক একটি সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, করোনা আবহে অবাঞ্চিত মাতৃত্বের হার বাড়বে। এবং রিপোর্ট আরও দাবি করছে এ বছর মার্চ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে সারা বিশ্বে ১১ কোটি ৬০ লক্ষ শিশু জন্ম নেবে। ভারতে এই শিশুদের সংখ্যা সর্বাধিক হবে এমনটা দাবি করা হয়েছে উল্লেখিত রিপোর্টে।                                                         
 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?