আত্মীয়ের আহবানঃ আমরা করব জয়





দীপেন্দু চৌধুরী
গত বেশ কিছুদিন থেকে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক এবং মৃত্যু নিয়ে আমরা ভারতীয়রা অত্যন্ত উদ্বেগে আছি। সারা বিশ্বের সঙ্গে সৌভাতৃত্ব অনুভবে। আমাদের দেশে লকডাউন ইতিমধ্যেই ১৭ মে পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ৪ মের পর থেকে আরও দু’সপ্তাহ। লাল, সবুজ, গোলাপী রঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে চিহ্নিত করে কেন্দ্র এবং রাজ্য কল কারখানা, দোকান-বাজারহাট খুলে রাখার ক্ষেত্রে কিছু  ছাড় ঘোষণা করেছে। কোভিড-১৯ উত্তর অর্থনীতি নিয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব বেসরকারিস্তরে উঠে আসছে। এসবের মধ্যেও পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে শুরু হয়েছে বিভিন্ন চাপানউতোর। রাজনীতির দড়ি টানাটানি। করোনা আক্রান্ত ভারতের এই বিষয়টি আন্তর্জাতিকস্তরেও আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাঙ্ক ‘পরিযায়ী’ শ্রমিকদের বিষয়ে ইতিমধ্যে ভারত সরকারকে কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছে। সারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রায় ৪ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক কাজ হারিয়ে আটকে রয়েছে ঘরে ফিরতে পারছে না। অত্যন্ত অমানবিক অবস্থায় এই সব শ্রমিকরা আটকে রয়েছেন। তারা নিজের গ্রামে, নিজের দেশে নিজেদের আত্মীয়ের কাছে ফিরে আস্তে চাইছেন। সুস্থ থাকার অধিকারে তারা বাড়ি ফিরতে চাইছে আত্মীয়ের আহ্বানে।
মালদা জেলার প্রায় ৩৭-৩৮ হাজার পরিযায়ী শ্রমিক বিভিন্ন রাজ্যে আটকে রয়েছে। ২১ টি রাজ্যের শ্রমিকেরা বিভিন্ন রাজ্যের অস্থায়ী ত্রাণ শিবিরে আটকে আছেন। নেপালের পরিযায়ী শ্রমিকেরাও এই দলে আছেন। তারা এবার বাড়ি ফিরতে চাইছেন।  
কিন্তু ফিরব বললেইতো হাজার হাজার কিলোমিটার দূর থেকে ফেরা যায় না! বাণিজ্যিক সংবাদ মাধ্যমে ‘পরিযায়ী শ্রমিক’-দের নিয়ে একটা দু’টো হার্ড স্টোরি প্রকাশ হচ্ছে। সারা দেশে যে ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শ্রমিকেরা আছেন তার কতটাই বা আমরা জানতে পারছি? কেউ কেউ হেঁটে, সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কয়েক জন হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে ক্লান্ত শরীরে ঝিমিয়ে পড়ে রাস্তায় শুয়ে পড়েছে। অনিবার্য মৃত্যু। একজন শিশু শ্রমিকের মৃত্যুর খবরও আমরা পেয়েছি। মর্মান্তিক মৃত্যু এবং করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে এক সময় সিদ্ধান্ত হয় পরিযায়ী শ্রমিকরা যে যে রাজ্যে আটকে পড়েছে সেই রাজ্য তাদের থাকা এবং খাওয়ার দায়িত্ব নিক। এতদিন কেন্দ্রের এমনতর গাইডলাইন মেনেই শ্রমিকরা বিভিন্ন আস্তানায় আশ্রয় নিয়েছিল। কারণ লকডাউন চলাকালীন ট্রেন বাস বন্ধ। কিন্তু কতদিন ভিন রাজ্যের অস্থায়ী আস্তানায় মারণরোগের আতঙ্ক নিয়ে থাকা সম্ভব? ছোট একটা ঘরে ঠাসা ঠাসি করে পরস্পরে পরস্পরের নিঃশ্বাস নিতে নিতে আটকে থাকা! অর্ধাহার, অনাহার, অমর্যাদা, অসম্মানকে সঙ্গে করে করোনা দিন করোনা রাত যাপন করতে বাধ্য হওয়া।
অনিশিচিত এক অগস্ত যাত্রারমতো কেউ কেউ আবার হাঁটতে শুরু করেছিল। তারা বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু না শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। প্রশাসনিক কারণে তাদের ভিন রাজ্যের বিভিন্ন আস্তানায় বাধ্য হয়ে থেকে যেতে হয়েছে। কিভাবে থাকেন তারা? সামাজিক মাধ্যম থেকে পাওয়া একটা উদাহারণ। ‘ট্রেন চালু হতে পারে, খবর পেয়ে জানতে গেলাম ধারাভি থানায়। পুলিশ বলল, নিজেরা টাকা দিয়ে মেডিক্যাল চেক আপ করতে হবে, মুম্বই থেকে হাওড়া অবধি টিকিট লাগবে ৭৮৫ টাকা করে। আমরা বীরভূমের তিরিশ জন এখানে আছি, বেশিরভাগই কাজ করছে এমব্রয়ডারির। লকডাউনের সময় খানিকটা টাকা যা পেয়েছি, এই কয়দিনে খাবার জোটাতে শেষ। কেউ নিজেরা চাল-ডাল কিনে রান্না করে খাচ্ছি। দশ-বারোজনের বাড়ির লোক হয়ত ট্রেন ভাড়ার টাকা পাঠাতে পারবে, বাকিদের কী হবে? খুব চিন্তায় আছি। রফিকুল হক, ফোন- ৮৭৯৬৪২৪৪২৯’ (সাংবাদিক স্বাতী ভট্টাচার্যের ফেসবুক ওয়াল থেকে) মেডিক্যাল টেস্ট করার জন্য জন পিছু ১০০০ টাকা করে দিতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে গৃহবন্দি শ্রমিকরা কোথায় চিকিৎসা করাবে? যাদের কাছে খাবার টাকা নেই তারা ১০০০ টাকা কোথায় পাবে? সব রাজ্যে রাজ্য সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে শারীরিক পরীক্ষা করার। সরকারি খরচে এই পরীক্ষা করানো উচিত নয় কি?   
পর্যবেক্ষকদের অভিমত ভিন রাজ্যে আটকে রয়েছেন যেসব শ্রমিক তারা ত্রাণ শিবিরে আর থাকতে ইচ্ছুক নন। ‘স্ট্যান্ডার্ড ওয়ার্কার্স অ্যাকশন নেটওয়ার্ক’-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, ৫ সপ্তাহ লকডাউনে কাটানোর পরে ৬৪ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিকের হাতে ১০০ টাকাও নেই। ৯৭ শতাংশের বেশি শ্রমিক সরকারের থেকে কোনও নগদ সাহায্য পাননি। ১৬ শতাংশ আংশিক মজুরি পেয়েছেন। হকার, ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালাদের ৯৯ শতাংশের কোনও রোজগার হয়নি। সমীক্ষায় ৫০ শতাংশ শ্রমিক জানিয়েছেন, তাঁদের হাতে ১ দিনের মতো রেশন রয়েছে। সুত্রঃ এবিপি     সারা দেশ জুড়ে গড়ে ওঠা প্রবল জনমতের কারণে এবং বিরোধী দলগুলির সম্মিলিত চাপে সম্প্রতি ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘শ্রমিক স্পেশাল’ ট্রেন চালানোর। কিন্তু পকেটের রেস্ত খরচ করে নিজের নিজের টিকিট কেটে ট্রেনে উঠতে হবে। সূত্রের খবর, শ্রমিক স্পেশাল ট্রেনে স্লিপার ক্লাসের ভাড়া দিতে হবে। তাছাড়া সুপারফাস্ট চার্জ হিসেবে ৩০ টাকা এবং খাওয়ার জন্য অতিরিক্ত টাকা দিতে হবে পরিযায়ী শ্রমিকদের।
দীর্ঘদিন কর্মহীন থাকার পরে এত টাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের পক্ষে যোগার করা আদৌ কি সম্ভব? কেন্দ্র এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকারের দ্বিধাগ্রস্ত মানসিকতার কারণে, অথৈ জলে ভাসতে থাকা মনুষ্যেতর জীবন যাপনে বাধ্য হওয়া শ্রমিকের দল বাড়ি ফেরার জন্য আমাদের রাজ্যের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বিশেষ করে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে তারা নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলে। তারা বাড়ি ফিরতে চায়। কিন্তু বিষয়টা শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের নয়। সমস্যাটা সারা দেশের।
এরকম এক পরিস্থিতিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এগিয়ে এলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধি। জননেত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তিনি কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। তিনি বলেন, ‘জাতীয় কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রত্যেক দুঃস্থ শ্রমিক ও পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার জন্য রেলের ভাড়ার দায়িত্ব নেবে প্রতিটি রাজ্যের প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব। সনিয়া গাঁধি আরও বলেছেন, ‘বিদেশ থেকে নিখরচায় ভারতীয়দের ফেরাতে পারে মোদী সরকার তা হলে পরিযায়ী শ্রমিকদের কেন ফেরাবে না?’
ভারতের করোনাভাইরাস কেন্দ্রিক পরিবেশে সনিয়া গাঁধির নেতৃত্বে কংগ্রেস আগেই ঘোষণা করেছে বর্তমান সময়টা রাজনীতি করার নয়। তারপরেও রাজনীতি হচ্ছে। যেটা আম মানুষের কাছে বাঞ্ছিত নয়। বিশেষত মহামারীর আবহে। দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রথমসারির নেতৃত্বের উচিত সাংস্কৃতিক সমন্বয় গড়ে তোলা। মারণভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার জন্য সব দলের নেতৃত্ব মানবিক আবেদনে এক অদৃশ্য মানব শৃঙ্খল গড়ে তোলাই হবে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু সেটার পরিবর্তে আমরা পেলাম ভিন্নতর এক সংস্কৃতির পরিচয়। চেনা সংস্কৃতি নতুন মোড়কে অরাজনৈতিক মঞ্চের এক প্রতিনিধির মুখে। তিনি দেশের নামজাদা সাংবাদিক এবং সম্পাদক। সনিয়া গাঁধিকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করলেন। ‘বিদেশিনী’ শব্দের চেনা ছন্দে। যদিও এই শব্দবন্ধের সঙ্গে কংগ্রেস সভানেত্রী অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। কারণ তিনি ভারতের মানুষের আত্মার আত্মীয় হতে পেরেছেন। ৪৮ বছর আছেন ভারতের মানুষের সুখে দুঃখে। কংগ্রেস পরিবারের উত্থান পতনের অন্যতম সাক্ষী সনিয়া গাঁধি। নেহরু গাঁধি পরিবারের পুত্রবধূ হয়ে এসে আমাদের অজান্তে দেশের সাধারণ মানুষের আত্মীয় হয়ে গেছেন কখন যেন।  
ভারতে মানব কল্যাণে কাজে আসে এমন অর্থনীতির অন্যতম প্রবক্তা সনিয়া গাঁধি। এই অর্থনীতির জনক যদিও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। ইউপিএর চেয়ারপার্সন হিসেবে ‘ঝোলাওয়ালা অর্থনীতি’-র কাজ শুরু করেছিলেন সনিয়া গাঁধি। ১০০ দিনের কাজ হচ্ছে সেই গরিবকল্যাণ কর্মসূচীর অন্যতম। কোভিড-১৯ আক্রান্ত ভারতের আজও সনিয়া গাঁধিরমতো এক নেত্রীর প্রয়োজন রয়েছে। বিরোধীরা দাবি করছে, সনিয়া গাঁধির এক কৌশলী চালে বিজেপি নেতৃত্ব দিশাহারা।
আমরা সুদূর প্রান্ত থেকে প্রান্তিক সীমা ভেঙ্গে শুনতে পাচ্ছি, কারা যেন বলছে, কোন বিশ্ব কাকে পাহারা দেবে? আমার আত্মার আত্মীয়ের খোঁজে পথে নেমেছি। বস্তিতে খুঁজছি। প্রথম বিশ্বের সাদা-কালো ছবির পাতায় খুঁজেছি। দ্বিতীয় বিশ্বের সেলুলয়েডের ছবির পর্দায় ‘মানবতা’-র আত্মীয়দের খুঁজে পেয়েছি। তৃতীয় বিশ্ব? আজ কে কাকে পাহারা দিচ্ছে? আজ কে কাকে পাহারা দেয়?      
                                      
 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?