কাজ হারানো দলছুট মানুষ আবার পুরনো জীবীকার খোঁজে!




দীপেন্দু চৌধুরী
প্রসঙ্গ প্রথমেই যেটা মনে পড়ছে কোভিড-১৯ কয়েক কোটি পরিযায়ী শ্রমিককে কাজ থেকে বিচ্যুত করেছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাঙ্কের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, লকডাউনের কারণে ভারতে প্রায় ৪ কোটি পরিযায়ী শ্রমিক চরম অনিশ্চয়তা এবং বেদনাদায়ক পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ভারত সরকারের উচিত পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা। যেমন তাদের সবাইকে নগদ অর্থ দেওয়া, স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করা এবং সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।    
আমাদের অভিঞ্জতা বলছে, যারা কাজের খোঁজে উন্নত শহরে সচ্ছল জীবিকার খোঁজে গিয়ছিল তাদের মতো সবাই নিজের গ্রাম ছেড়ে ভিন রাজ্যে যাননি। গত শতাব্দীর আশির দশকের প্রথমদিকে আমরা দেখেছি আমাদের রাজ্যের কৃষির উপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যরা নিজেদের অঞ্চলেই বিকল্প কাজ খুঁজে নিচ্ছে। অথবা বিকল্প কাজের প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। যেমন ইলেক্ট্রিসিয়ান, দর্জির কাজ, প্যান্ড্যাল তৈরির কাজ ইত্যাদি। বিশেষঞ্জরা দাবি করে থাকে এটার অন্যতম কারণ প্রাথমিকভাবে  যেমন ভূমি সংস্কার, পরে অবশ্যই উদার অর্থনীতির প্রভাব। লক্ষ করলে দেখা যাবে সাম্প্রতিককালে ভূমি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা আর কোনও আলোচনায় আসে না। জওহরলাল নেহরুর সময়কাল থেকে শুরু হয়ে টানা ইন্দিরা গাঁধির শাসনকাল পর্যন্ত ‘ভূমি সংস্কার’ ছিল অন্যতম অ্যাজেন্ডা। পরে আসে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতরাজ ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা দেশে শুরু করার ক্ষেত্রে অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধি।   
আমাদের রাজ্যে যদিও বামফ্রন্ট সরকার ভূমি সংস্কারের দায়িত্ব পালন করেই ৩৪ বছর রাজ্য শাসন করেছে। এমনটা মনে করেন অনেক তাবড় অর্থনীতিবিদেরা। উল্লেখ করা যায় কেরলে ভূমি সংস্কারের প্রয়োজনে ইন্দিরা গাঁধি সংবিধান সংশোধন পর্যন্ত করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় বামফ্রন্ট সরকারের উজ্জ্বল ভূমিকার কথাও অবশ্যই উল্লেখে থাকা উচিত।  
বামফ্রন্ট আমলে ভূমি সংস্কারের কাজ যখন শেষ পর্বে তখন আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ৫২.৯ শতাংশ পুরুষ শ্রমজীবীর জীবিকার প্রাথমিক উৎস ছিল কৃষিকাজ। ৩০.২ শতাংশ ছিল কৃষক আর ২২.৭ শতাংশ ছিল কৃষি মজুর। দশ বছরের ব্যবধানে এই চিত্রটা আস্তে আস্তে বদলে গেল। ২০০১ সালের সেন্সাস সমীক্ষায় উঠে আসছে, কৃষি নির্ভর পুরুষ শ্রমজীবী কমে হয় ৪৩.৪ শতাংশ। মাত্র এক দশকে কৃষির উপর নির্ভরশীল শ্রমজীবী কমে ৪৩.৪ শতাংশ এসে দাঁড়ায়। কৃষি থেকে বিযুক্ত হয়ে এরা বেছে নেয় অসংগঠিত ক্ষেত্রের কাজ। যেমন ছোট ব্যবসা, পরিবহন ব্যবসা, নির্মাণ শিল্প, ছোট মাঝারি উৎপাদন সংস্থা তৈরি করে জেনারেল অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজ, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে পরিষেবা সেক্টরের কাজ। আমাদের রাজ্যে ম্যানুফাকচারিং শিল্পে কাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবীর ৭৮.৬ শতাংশ কাজ করে অসংগঠিত সংস্থায়
আমরা মনে করতে পারব, এই ধরণের কাজ যত বেড়েছে, গ্রামের চরিত্র ততই বদলে গেছে। গণপরিবহণ ব্যবস্থার সুযোগ কাজে লাগিয়ে গ্রামীণ মানুষের একটা বড় অংশ কাজ খুঁজে নিয়েছিলেন নিজেদের বাড়ির কাছের গঞ্জ শহরে। অথবা বড় শহরে। বর্তমান সময়ে যারা করোনা আক্রান্ত অর্থনীতিতে সব থেকে বেশি সমস্যায় পড়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকদের মতই। দু’একটা উদাহারণ উল্লেখ করা যাক। আমার এক বন্ধু মাস্ক কিনতে কয়েকদিন আগে বাজারে গিয়েছিলেন। একজনকে দেখে সে চিনতে পারে। ভদ্রলোক বাজারে সাইকেলে ঝুলিয়ে ২০ টাকা থেকে ৬০ টাকা দামের সাধারন মাস্ক বিক্রি করছে। আমার বন্ধুটি মাস্ক বিক্রেতাকে আগে দেখেছে, ট্রেনে ব্লাউজ বিক্রি করতে। তার কাছ থেকে শুনেছিল তার স্ত্রী ব্লাউজ তৈরি করে আর সে ট্রেনে বিক্রি করে। এই কাজ করে তারা সংসার যেমন চালাচ্ছে। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করার খরচও চালাচ্ছে। সেদিন ভদ্রলোককে মাস্ক বিক্রি করতে দেখে আমার বন্ধু জানতে চেয়েছিল ব্লাউজ বিক্রির কি হল? খুব স্বাভাবিক উত্তর এল, ট্রেন চলছে না। বৌ বলল, আমি মাস্ক তৈরি করে দিচ্ছি। তুমি বাজারে নিয়ে গেলে বিক্রি হবে। আরও একটি উদাহারণ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ডোমজুড়ের অঙ্কুরহাটিতে পিপিই তৈরি করছেন রেডিমেড পোশাক তৈরির কারিগরেরা। খড়গপুর আইআইটির সহযোগিতায় শহরের একটি রেডিমেড কারখানায় তৈরি হচ্ছে পিপিই। যে খবরটা প্রভাতি দৈনিকের সুবাদে অনেকের নজরে পড়েছে।
কলকাতা সংলগ্ন শহরতলিতে যারা অটো চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা কাজ হারিয়ে বাড়ির কাছের  বাজারে সবজি বিক্রি করছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই নতুন ভাষা উঠে আসছে, আজ তো পেটে দানাপানি পড়ল। কাল খাবার মিলবে তো! ২৮ এপ্রিল প্রভাতি দৈনিকের খবর। সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রকের একটি সমীক্ষায় ৪৪ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তারা আগের মতো আর খাচ্ছেন না। খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ এক বেলা খাচ্ছেন। কারণ করোনা সংক্রমণের ভয়। এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা কাজ করছে এই ধরণের সিদ্ধান্তে। অথবা নিয়মিত আয় নেই। বিশেষঞ্জরা জানিয়েছেন, এই ধরণের সিদ্ধান্তের জন্য শরীরের রোগ প্রতিরোধ কমে যেতে পারে।   
লকডাউন নিয়ে ভারতে সাধারণ মানুষের কোনও ক্ষোভ নেই। গত ২৩ এপ্রিল পঞ্চায়েতরাজ দিবসকে সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পঞ্চায়েত প্রধানদের সঙ্গে ভিডিয়ো বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রীর ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নের উত্তরে এই কথা জানিয়েছেন পঞ্চায়েত প্রধানরা। লকডাউন আর কতদিন চলবে? সাধারণ মানুষের কৌতূহল। দেশের স্বার্থে, দেশের সচল অর্থনীতির প্রয়োজনে, মানুষের স্বার্থে লকডাউন দীর্ঘ হোক। আমাদের আপত্তি নেই কিন্তু অর্থনীতির কি হবে? গণবন্টন ব্যবস্থা আরও গতিশীল কি ভাবে হবে? বিরোধী দলগুলি দাবি করছে, রাজনীতির জল ঘোলা না করেও বলা যায়, কোনও আগাম পরিকল্পনা না করে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে দিলে কি ধরণের সঙ্কট তৈরি হতে পারে কেন্দ্র সেটা স্বীকার করুক এবার  
৩০ এপ্রিল কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন বলেছেন, অতিমারি এবং লক ডাউনের জন্য আর্থিক সঙ্কট থেকে কেন্দ্রীয় সরকার সদিচ্ছা দেখালে বেরিয়ে আস্তে পারে। সব গরিব মানুষকে সুরাহা দিতে ৬৫ হাজার কোটি টাকা লাগবে বলে প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন জানিয়েছেন। এই অঙ্কের থেকে বেশি টাকা কেন্দ্রের কাছে আছে এমনটাও তিনি দাবি করেছেন। 
 আমাদের আলোচনায় অসংগঠিত ক্ষেত্রের একটা ছবি আমরা তুলে ধরতে চেষ্টা করলাম। উপদেষ্টা সংস্থা সিএমআইই-র তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত কাজ হারানোর হিসেব যথাক্রমে গ্রামের ২০.৮৮ শতাংশ, শহরে ২১.৪৫ শতাংশ এবং সারা দেশে ২১.০৫ শতাংশ মানুষ ভারতেরমতো উন্নয়নশীল দেশে কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছেন। ছোট-মাঝারি শিল্পমন্ত্রী নিতিন গড়কড়ী ইতিপূর্বে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি ছোট-মাঝারি শিল্পের জন্য ১ লক্ষ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠনের প্রস্তাব সরকারের কাছে দিয়েছেন। প্রশ্ন উঠছে এই প্রস্তাব কতদিনে বাস্তবায়িত হবে?  
বৃহৎ শিল্পের চাকা আংশিক চালু হবে অনুমান করা যায়। কারণ বৃহৎ শিল্পের পাশে সরকার আগেও ছিল বর্তমান সময়েও থাকবে। কিন্তু ছোট-মাঝারি শিল্পের জন্য কেন্দ্র কতটা এগিয়ে আসবে? পরিযায়ী শ্রমিকরা ঘরে ফিরলে গ্রামীণ অর্থনীতির উপর বিপুল চাপ আসবে। অদক্ষ শ্রমিকের কর্মহীনতা গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে পারে। করোনা উত্তর গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় আবার নতুন করে বিদ্ধংসী এক ঝড়ের পূর্ভাবাসের আগাম ইঙ্গিত দিচ্ছে নাতো?        
    

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?