পুরনো ক্যানভাসের ছন্দে কে আবার আঁকবে?
দীপেন্দু চৌধুরী
করোনা অতিমারি আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে এই আলোচনায় এখন ব্যস্ত
নেটিজনেরা। শুধুমাত্র নেটিজনেরা কেন? তামাম বিশ্বের অর্থনীতিবিদ, সমাজবিঞ্জানী,
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ধনী-গরিব দেশের রাষ্ট্রনায়করা। এক দশক আগেও
নিম্নমধ্যবিত্তদের হাতে স্মার্টফোন ছিল না। তাই সাধারন মোবাইল ফোনেই সামাজিক
আলোচনা করে নেওয়া যেত। অথবা ল্যান্ডলাইন ফোন ভরসা
ছিল। কিন্তু স্মার্টফোনের দৌলতে ফেসবুক, টুইটার (কিছুটা
নিয়ন্ত্রিত) এবং হোয়াটসঅ্যাপে চটজলদি মতামত দিয়ে দেওয়া যাচ্ছে।
কিছু মানুষ ব্যস্ত এখন ত্রাণ রাজনীতি নিয়ে। সেদিন সামাজিক মাধ্যমে একটা ছবি
দেখলাম, একজন গরিব মহিলাকে এক কেজি চাল দিচ্ছে ন’জন স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি। কোন
দলের তা ঠিক জানি না। ত্রাণ দেওয়ার ছবি পরিপাটি করে সাজিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে
দেওয়া হয়েছে। একজন কৌতুক করে লিখেছে, এক কিলোগ্রাম চাল দিতে ন’জন নেতাকর্মী? পাঁচ
কিলোগ্রাম চাল দিতে তাহলে কতজন নেতাকর্মী থাকবে? এই সময় রসিকতাটা কতটা বাস্তব? আমি
যে অঞ্চলে থাকি সেখানে কংগ্রেসের আঞ্চলিক নেতৃত্ব চাল, আলু, ডাল, গম হিসেবে
ত্রাণের সামগ্রী বিতরণ করছে। নিজেদের হোয়াটসঅ্যাপ গোষ্ঠীর মেসেজে একজন জানাচ্ছে
তার নেতাকে, ( ১৬ এপ্রিল, রাত ১০টা ৩২ মিনিটে), ‘একশো বিয়াল্লিশ জনকে আজকেরে দিলাম
দাদা। সাড়ে তিন কিলো চাল ও দু’কেজি আলু দেওয়া হয়েছে। কালকেরে আরও একশো আশি জনকে
দিতে হবে দাদা।’
মধ্য তিরিশের এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ আছে। আমি তাঁকে ফোন করে জানতে
চেয়েছিলাম কোন অঞ্চলে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। প্রচার বিমুখ যুবকটি প্রথমেই বলল, আপনি
হয়ত লিখবেন কিন্তু আমার বা আমাদের নাম উল্লেখ করবেন না প্লিজ। আমরা আমাদের
অঞ্চলের পঞ্চায়েত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছি। খাল পাড়ের প্রত্যন্ত এলাকা। এই
অঞ্চলের মানুষের কাছে অনেকে পৌঁছতে পারেনি। কতটা খারাপ অবস্থায় এরা আছে না দেখলে
বিশ্বাস করবেন না! এদের একদিন ত্রাণের চাল ডাল দিলে হবে না!
কথাটার সুত্র পেলাম সেদিন ফোনে আমার এক চিত্রসাংবাদিক বন্ধুর কাছ থেকে।
আমার এই বন্ধুটি দেখেছে, স্থানীয় এক বৃদ্ধা পাড়ার কয়েকজনকে বলছে, একদিনের ওই চাল
ডালে কি হবে বাবা? প্রশ্নটা এসেই গেল। এই লেখায় বাস্তবটা তুলে ধরতে চাইলাম এই
কারণে যে এই ত্রাণ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে চাপানউতোর চলছে,
অভিশপ্ত করোনাভাইরাসের আগ্রাসী ছোবলের পর থেকেই। খবরে প্রকাশ, ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব
কল্যাণ যোজনায়’ জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা মিশনের আওতায় গরিব মানুষকে কেন্দ্রীয় সরকার
তিন মাস বিনামূল্যে মাথাপিছু পাঁচ কেজি চাল এবং প্রতিটি পরিবার পিছু এক কেজি করে
ডাল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা মিশনে
৬ কোটি মানুষ আছেন। তাদের সকলের এই চাল ও ডাল পাওয়ার কথা থাকলেও রাজ্যের গরিব
মানুষ সেই রেশন সামগ্রী পাচ্ছেন না। রাজ্য সরকার এই বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে
উঠতে পারেনি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, রাজ্যই জনপ্রতি
পাঁচ কেজি করে চাল দেবে। খাদ্য দফতর সূত্রে খবর, রাজ্যের ৬ কোটি মানুষ কেন্দ্রীয়
বরাদ্দে ২ টাকা কেজির চাল পান। মুখ্যমন্ত্রী আরও ২.৪৪ কোটি মানুষকে রাজ্যের নিজের
খরচে ২ টাকা কেজি দরে চাল গম দিচ্ছেন। রাজ্যের অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী মোদীর ঘোষণা
মতো চাল-ডাল এই রাজ্যের আরও আড়াই কোটি লোককে দিতে হলে প্রায় ২০০০ কোটি টাকার খরচ
হবে। নবান্নের দাবি, রাজ্য অর্থ দফতর এই বিপর্যয়ের সময় ২০০০ কোটি টাকার বাড়তি
সংস্থান করতে পারবে না।
কেন্দ্র রাজ্যের ত্রাণসামগ্রী নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোরের সময়ে আরও একটি
চিত্রের উল্লেখ করি। সাংবাদিক স্বাতী ভট্টাচার্য ‘সংলাপ-১’, ‘সংলাপ-২’,
সংলাপ......১০ শিরোনামে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের গরিব তথা প্রান্তিক মানুষের কথা ধারাবাহিকভাবে লিখছেন। অবশ্যই
ফেসবুকে। যেমন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র নিজেদের উদ্যোগে বাঁকুড়া,
পুরুলিয়া জেলায় স্যানিটাইজার, মাস্ক নিয়ে চলে গেছে। খেটে খাওয়া নিরন্ন মানুষের
মধ্যে বিলি করার জন্য। কিন্তু তাদের অভিঞ্জতা হল অন্যরকম। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের
মানুষের ‘জনস্বাস্থ্য’ পরিষেবার থেকে খাবার পৌঁছে দেওয়াটা জরুরি কাজ। যাদবপুরের
ছাত্ররা খিচুড়ি রান্না করে গরিব মানুষের বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছে। এই রকম ব্যতিক্রমী
কাজ বেসরকারি উদ্যোগে অনেক হচ্ছে। তারা কেউ প্রচারের আলোয় আস্তে আগ্রহী নয়। তাই
আমরা জানতে পারছি না। এক সবজি বিক্রেতা স্বাতীকে জানিয়েছেন, কিছুদিন আগে গড়িয়াহাট
বাজারে তিন-চার হাজার টাকা কেজি দরে ইলিশ বিক্রি হয়েছে। জীবনযাত্রা স্বাভাবিক
থাকার সময় যেমন বিক্রি হয় ঠিক সেই একই ছন্দে এক শ্রেণির মানুষ ইলিশ কিনছেন।
দেশের এই না বলা সঙ্কটকালে এটাই সম্ভবত সঠিক দায়িত্ব পালন। অস্ফুট
যন্ত্রণাকাতর দরিদ্র মানুষগুলি নিজেদের কেমন যেন গুটিয়ে নিয়েছে। সামাজিক বিশ্বাস
ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাচ্ছে। তারপর আছে রাজনীতির মারপ্যাঁচ। ত্রাণ দেওয়া নিয়ে
রাজনীতির উল্টোপীঠটা দেখুন। কলেজে পড়া একছাত্রী আবেগঘন ভাষায় ফেসবুকে লিখছে, ‘আমার
বাবা কারও কাছে কোনওদিন হাত পাতেননি। আমরা নিম্নবিত্ত। আমার বাবা ছোট একটা
কারখানায় চাকরি করতেন। এখন কারখানা বন্ধ। বাবার কাজ নেই। আগের মাসের বেতনও পাননি।
আমি বাড়িতে ছাত্র পড়াতাম। সেটাও বন্ধ। প্রায় এক সপ্তাহ বাবা বাজার যেতে পারেনি।
হঠাত একদিন দেখলাম বাবা বাজারের ব্যাগ হাতে বেরচ্ছে। জানতে চাইলাম কোথায় যাচ্ছ? বাবা
বলল, পাড়ার ছেলেরা ত্রাণের চাল-ডাল, আলু দেবে নিয়ে আসি। আমার দু’চোখ দিয়ে অঝোর
ধারায় জল পড়তে লাগল। না এখানেই শেষ নয়। মানবতা একদিন চিৎকার করে উঠল। ফেসবুকে ছবি
দেখলাম মাথা নিচু করে, ম্লান মুখে আমার বাবা ত্রাণ নিচ্ছে। যারা ত্রাণ দিচ্ছেন তারা
হাসি মুখে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে। এই ছবি না দিলে হত না? আমার বাবা কোনওদিন কারও কাছে
হাত পাতেননি। তবুও তিনি মাথা নিচু করে আমাদের জন্য ত্রাণ নিয়ে এলেন!’
আমাদের আলোচনায় ‘লকডাউন’ চলার সময়ে কাজ হারানো প্রান্তিক মানুষের
প্রতিদিনের খাবারের জন্য যে লড়াই, সেই লড়াইয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে গত শতাব্দীর
দুর্ভিক্ষ। ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় এক শ্রেণির মানুষের কথা
আমরা দুর্ভিক্ষের ইতিহাসে পড়েছি। কালোবাজারে চাল বা অন্য খাদ্য সামগ্রী মজুত
থাকলেও মানুষ অনাহারে ‘একটু ফ্যান দাও মা’ আর্তনাদে বাংলার রাস্তায় রাস্তায়
ঘুরেছে। ইতিহাস ছাড়াও বাংলার মন্বন্তর নিয়ে শিহরণ জাগানো মানবিক গল্প, উপন্যাস,
প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। ক্যানভাসের ছবিতে ছবি একেছেন বরেণ্য চিত্র শিল্পীরা। বাংলা সাদাকালো
সিনেমায় মজুতদারদের চরিত্র আমরা দেখেছি।
বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব তৃপ্ত মিত্র লিখছেন, ‘’দুর্ভিক্ষ। ১৩৫০-এর সেই
দুর্ভিক্ষ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকে পশ্চাৎপট করে সেই একটা দুর্ভিক্ষ আমাদের জাতীয় ভিত
টলিয়ে নড়িয়ে তছনছ করে দিয়ে গেল। কত পুরনো নিয়ম বদলে গেল। নতুন একটা নাম শুনলাম
‘কালোবাজার’। ‘কালোবাজার’, এরই ফলে কত শত লোক নিঃস্ব হল। আবার কত লোক নিঃস্ব থেকে
বড়লোক হয়ে গেল। হল দুর্ভিক্ষ। আর সেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ের দুর্ভিক্ষকে
পশ্চাৎপট করেই আমাদের থিয়েটারের মোড় ঘুড়ল।‘’
‘’আমরা অত্যন্ত জরুরী দু’টি তথ্য পেলাম, এক ধ্বস্ত সমাজ ব্যবস্থায় ‘কত
পুরনো নিয়ম’-এর বদল হয়ে যাওয়া। আর দ্বিতীয়, সেই প্রেক্ষাপটে সাবেক পথ ত্যাগে গড়ে
ওঠা নতুন থিয়েটারের সংবাদ।‘’ ( তৃপ্তি মিত্র, শূদ্রক থেকে প্রকাশিত, ১৯ ডিসেম্বর,
১৯৯২)
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতকে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশ
হিসেবে আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ভারতের উন্নয়ন নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু
সারা দেশে গরিব নিরন্ন মানুষ ‘করোনাভাইরাস’-র কারণে আজ অনাহারে, অর্ধেক খেয়ে দিন
কাটাচ্ছে। শুরু হয়ে গেছে ‘কালোবাজারি’। নবান্ন সূত্রে খবর, আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন
রকমের অভিযোগে ২২৪ জন রেশন ডিলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে রাজ্য খাদ্য দফতর। ভিন
রাজ্যের সংবাদ কি হতে পারে অনুমান করে নেওয়া যায়। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে সারা
দেশের মানুষ চিন্তায় থাকলেও কেন্দ্রের সদিচ্ছা কতটা রয়েছে জানতে ইচ্ছে করে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার দাবি উঠেছে। যেটা যথার্থ দাবি। কাজ
হারানো এই ‘অতিথি’ শ্রমিকরা যাতে বাড়ি ফিরে যেতে পারে তার ব্যবস্থা আপনার সরকারকেই
করতে হবে মোদীজি। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি আবারও দাবি করেছেন,
প্রতি শ্রমিকের অ্যাকাউন্টে ৭৫০০ টাকা করে দিক কেন্দ্র। এবং প্রত্যেকের খাবারের
ব্যবস্থা করুক কেন্দ্র। ইয়েচুরি জানিয়েছেন, সরকারের গুদামে ৩০৫.৭ কোটি টন
খাদ্যশস্য পড়ে রয়েছে।
কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়ঙ্কা গাঁধী ভদরা একটি ভিডিও বার্তায় বলেছেন,
‘’করোনা মহামারীর সংকটের মধ্যে সবথেকে বেশি সংকটের সম্মুখীন দেশের বিভিন্ন
প্রান্তে আটকে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকেরা। আজ আমাদের সকলের কর্তব্য তাদের পাশে
দাঁড়ানো।‘’
কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গাঁধি সম্প্রতি একটি সাংবাদিক সম্মেলনে
বলেছেন, ‘’করোনা-সঙ্কটের পরে ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বদলের বাস্তব সম্ভাবনা
রয়েছে। কিন্তু তার আগে করোনাভাইরাসের মোকাবিলা করতে হবে। তবে চিন্তার কারণ নেই।
ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যাতে বজায় থাকে, সেটা কী ভাবে নিশ্চিত করতে হবে তা
আমরা জানি।‘’ কংগ্রেসের দাবি রাহুল গাঁধি
১২ ফেব্রুয়ারি প্রথম করোনা নিয়ে কেন্দ্রকে সতর্ক করলেও কেন্দ্র তাতে কান দেয়নি।
কেন্দ্র কেন কান দেয়নি? ‘নমস্তে ট্রাম্পে’-র অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত থাকার
কারণেই কি ‘করোনাভাইরাস’ যে একটা মারণাস্ত্র এটা ভাবার সময় পেলেন না মোদীজীর
প্রশাসন? রাহুল গাঁধি আরও বলেছেন, ‘’কিন্তু মোদীজীর কাজ করার পদ্ধতি আলাদা। আমাদের
সেই মতোই চলতে হবে।‘’ করোনাভাইরাস পরবর্তী
সময়ের কথা ভেবে আবারও আমাদের পুনরাবৃত্তি করতে হবে, জাতীয় সংকটের সময় দলীয়
রাজনীতির করিডর ভেঙ্গে অসহায় অভুক্ত মানুষ, অসহায় করোনাক্রান্ত মানুষের পাশে
দাঁড়ানোর আহ্বানে আমাদের সাড়া দিতে হবে। আবার জীবনের ছবি আঁকা হবে। নতুন ভাষায়।
নতুন ছন্দে, তুলির মোচড়ে, কব্জির জোরে। মানবতার অধিকারে।
Comments
Post a Comment