‘মানবতা’ আদেশ দাও হে রুদ্র কথা কও কথা কও




দীপেন্দু চৌধুরী
অভিভাবকের মতই তোমরা দাঁড়িয়ে আছ! সবুজে সবুজ। সোনালী রোদের মখমলের আলোয় ঝলমল করছ। নীল আকাশের নীচে কত যুগ, কত বছর কতনা সময় ধরে আমাদের ছায়া দিয়েছ। আমাদের বাঁচার জন্য অক্সিজেন দিয়েছ। মানবসভ্যতা শক্তি পেয়েছে। গ্রীষ্মের প্রখর তপন তাপে হাত ধরে নিয়ে গেছ। তোমার ছায়ার তলায় বসতে আহ্বান জানিয়েছে। পথের পথিক বসেছে। হরবোলা পাখি বসেছে। জন্তু-জানোয়ার আজও আশ্রয় খোঁজে তোমার ছায়ায়। তোমার মায়ায়। কেউ আলাদা করে জানতে চায়নি তোমার বয়স কত? আজ আমার মনে হল একবার অন্তত একবার, তোমাদের সঙ্গে চুপি চুপি কানে কানে কথা বলি। জান আশির দশকে ‘বরাইবুরু’ বেড়াতে গিয়েছিলাম। হ্যা এই মুহূর্তে তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার মনে পড়ে গেল। যেমন জলান্ধ্রেরর মানুষ ২১৩ কিলোমিটার দূরের হিমাচল প্রদেশের পাহাড়ে শ্বেতশুভ্র পাহাড় দেখতে পাচ্ছে। জান কয়েকদিন আগে দৈনিক কাগজে ছবিও প্রকাশ হয়েছে।
আমার আজ ‘বরাইবুরু’ গভীর জঙ্গলের কথা মনে পড়ছে। আশির দশক অবিভক্ত বিহারের সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ে পাকদন্ডি রাস্তা। পাশের রাজ্য ওড়িশা। আঁকা বাঁকা পাহাড়ি রাস্তার দুধারে তোমাদের সবুজের আয়োজন। সময়টা ছিল শরৎকালের শেষ আর হেমন্তের শুরু। বুনো ফুলের গন্ধ। তোমাদের কাঁধে ভর করে ঝুলছে সবুজ-হলুদ লতাগুল্ম। যে দিকে তাকাই সবুজ আর সবুজ আদিগন্ত সবুজ। একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। চেনা, নাম না জানা পাখিরা চলন্ত বাসের মাথার উপর দিয়ে পাহাড়ি যুবতি মেয়ের মতো পত পত করে উড়ে চেলে যাচ্ছিল। সদ্য যৌবনের কৌতুহলী মন দু’চোখ দিয়ে স্মৃতির ক্যানভাসে ছবি এঁকে দিয়েছিল। আজ সেই স্মৃতির ক্যানভাস থেকে সংযোজন করে আবার যৌবন পান করছি। সেদিন সকাল দশটাতেও আমাদের মনে হচ্ছিল রাত শেষে সবে ভোর হচ্ছে। ভেজা প্রকৃতি। নীল আকাশ। আলো আধাঁরী নিঝুম সকাল। আজও এই প্রৌঢ় বয়সে তোমাদের কথা মনে আছে। তারপর গত তিন দশকে তোমাদের অভিমান আমরা চিনতে চাইনি। তোমাদের ব্যথা জানতে চাওয়ার আগ্রহ দেখাইনি। আমরা মানে মানব সভ্যতার প্রহরীরা যারা
প্রহর শেষের কথা বলছি না! উদ্ভ্রান্ত আদিম যুগের তর্পণ করার আগ্রহ নিয়ে তোমাদের সঙ্গে আলাপের একটা প্রয়াস বলতে পার। কেন জান? তোমাদের হিল্লোলিত সবুজের ডাকে এই প্রখর গ্রীষ্মে কত ফুল ফোটে কত পাখি গান গেয়ে ফিরে যাচ্ছে। নীল আকশে পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘেদের সহাস্য আনাগোনা। এরই নাম পরস্পর পরস্পরের হাত ধরা।  কিন্তু আমরা বড় অসহায়! বড্ড অসহায়। মানব সভ্যতা আজ মহা সঙ্কটে। ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সভ্যতা কাঁদছে। উন্নত সভ্যতা মুখ থুবড়ে পড়েছে। আত্মীয়-অনাত্মীয় মহাকালের কাছে আত্মসমর্পণ না করে এক মানবিক শক্তি অর্জন করেছে। যৌথ পরিবার, যৌথ সমাজ, সামাজিক বন্ধনে আমরা ফিরতে চাইছি। বিশ্বাস কর। আমারা প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাইছি। এখানে ফুল যেমন ফুটছে, গাছে গাছে ফল হয়েছে। বোরো ধানের সোনালী শস্য ঘরে আনতে গেছে আমার ভাই, দাদা। সবুজ ঘাসের উপরে কে লিখে রেখেছে ‘প্রিয়তমাসু’। আহ্বান আছে জীবনের আর এক নাম লড়াই। জীবনের আর এক নাম বেঁচে থাকা।
তোমার তরতাজা সবুজ দেহে হাত রেখে, নীল আকাশের ভাঁজে ভাঁজে ফুরফুরে আগুন্তুক সভ্যতার আল্পনা। তবু শোন আমাদের কথা। আমার-আমাদের অপরাধ স্বীকার করছি। আমরা বাঁচতে চাই, ক্ষুধা, অনাহার, অতিথি শ্রমিকের চোখের জল, নারী-শিশুদের চাপা কান্না। না তবু অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি না আমরা। প্রখর তপন তাপে শুধু আলো আর আলো। সমুদ্রের নীল ফেনিল ঢেউ আছড়ে পড়ছে জলের বুকে, নতুন সভ্যতার আহ্বান শুনতে পাচ্ছে। পাহাড় থেকে আবার তির তির করে ঝর্না নির্ঝর তরঙ্গে নেমে আসছে। ১৪২৭ বঙ্গাব্দের শুরুতে তোমার কাছে প্রার্থনা করছি। শুকনো ঠোঁট, ভেজা চোখে আমি উচ্চারণ করছি ‘মানবতা আদেশ দাও হে রুদ্র কথা কও কথা কও’।      
            

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?