বিপন্ন বিস্ময়ে নতুন বিশ্বমঞ্চের দামামা শুনতে পাচ্ছি






দীপেন্দু চৌধুরী
বিতর্ক থামল। হুমকি হোক অথবা দায়বদ্ধতা। ভারত তথা সারা বিশ্ব যখন ‘কোভিড-১৯’ মারণাস্ত্র নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত ঠিক তখনই আমেরিকার কাছে ভারতের আত্মসমর্পণ। এমনই অভিযোগ বিরোধীদের। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে আমেরিকার প্রবল চাপের কাছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কার্যত আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। এই ধরণের বৈদেশিক সিদ্ধান্ত আমাদের দেশের পূর্বতন প্রধানমন্ত্রীদের নিতে হয়েছিল কি-না সেই বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা বলছেন। বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র তৈরি হওয়া এবং সেই যুদ্ধে চিন-আমেরিকার ভূমিকার প্রসঙ্গ প্রাসঙ্গিকভাবেই আলোচনায় আসছে। সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতের লৌহমানবী ইন্দিরা গাঁধির কথা আপামর বিশ্ব জানে। নির্ভীক ব্যক্তিত্ব ইন্দিরা গাঁধির নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছিল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম মঞ্চ।    
অবশ্যই বলতে হবে বিতর্কের প্রসঙ্গ যথার্থভাবেই তুলছেন আলোচকরা ইন্দিরা গাঁধি, অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং মনমোহন সিংহয়ের মতো প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বিরোধীদের অনেকেই বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওই মন্তব্যের কড়া জবাব দেওয়া উচিত ভারত সরকারের। ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং সামাজিক স্বার্থ ভারতের জনগণকেই বুঝে নিতে হয়। এই ছিল ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধির অবস্থান। যে অবস্থানের ধারাবাহিকতা আরও মসৃণভাবে তৈরি করে দিয়েছেন ভারতে উদার অর্থনীতির প্রবক্তা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। আমাদের ভারতের স্বাধীন এই নীতির প্রবক্তা স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। তিনি পিছিয়ে থাকা সামাজিক কাঠামো সহ, ভঙ্গুর অর্থনীতির এক দেশ ব্রিটিশ প্রভুদের কাছ থেকে ‘স্বাধীন ভারত’ হিসেবে পেয়েছিলেন। না এই প্রাপ্তি পণ্ডিত নেহরু উত্তারাধিকার সূত্রে পাননি। ব্রিটিশদের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর অনেক রক্তাত্ত নদীর সীমানা ভেঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তরকালে ভারতের এই স্বাধীনতা প্রাপ্তি। পণ্ডিত নেহরু আমাদের দিয়ে গেছেন মিশ্রঅর্থনীতি। মিশ্র সংস্কৃতির দায়বদ্ধতা এবং উত্তরাধিকার। একদিকে বৃহৎ জোতদার, ভূস্বামী গোষ্ঠী, উল্টো দিকে বেসরকারি পুঁজি। মাঝখানে রাষ্ট্রীয় পুঁজি। একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের কাছে যা ছিল চ্যলেঞ্জ। নেহরু সেই চ্যলেঞ্জ স্বহাস্যে এবং স্বদর্পে গ্রহণ করলেন। গাঁধিজীর সুযোগ্য ভাবশিষ্য হিসেবে।  
স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী দুই বিশ্বের ঠান্ডা যুদ্ধের কালবেলায় উত্তরাধিকারের দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে এসেছিলেন। যতদূর জানি পণ্ডিত নেহরুর অবস্থান ছিল আমেরিকার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এক মেরু বিশ্বের কাছে আত্মসমর্পণ না করে কূটনৈতিকভাবে কৌশলী অবস্থান নেওয়া। বিলেতি শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত নেহরুর স্বপ্ন ছিল পশ্চিমী সংস্কৃতি, ধনতন্ত্রকে ভারতে প্রয়োগ করে উন্নয়ন করা।  তথা বৃহৎশিল্পের ভিত্তিভূমি তৈরি করা। যে কাজে তিনি সফলও হয়েছিলেন। পাশাপাশি সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মানবিক সমাজও আকর্ষণ করেছিল তাঁকে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়ার ভূমীসংস্কার, সমবায়, যৌথ খামার, সকলের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং খাদ্য ইত্যাদির স্বপ্ন নতুন ভারত গড়তে সাহায্য করেছিল তাঁকে। দুই মেরু বিশ্বের ঠান্ডাযুদ্ধের সময়কালে। নেহরু সাহায্য পেয়েছিলেন তৎকালীন ভারতের বামপন্থী নেতৃত্ব এবং তামাম বিশ্বের বামপন্থীদের কাছ থেকেও। যে ধারাবাহিকতা বজায় ছিল ইন্দিরা গাঁধি হয়ে মনমোহন সিংহ পর্যন্ত। বামপন্থীরা করোনা ভাইরাস সংকটকালেও ভারতে কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ মানবিক কর্মসূচী নিয়েছে। এবং নিচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশে কেরল সরকারের কিছু ব্যতিক্রমী সমাজবাদী কর্মসূচীর কথা উল্লেখ করা যায়। আমাদের রাজ্যে বামপন্থীদের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সেই সব কর্মসূচি বিষয়ক লেখা নজরে পড়ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘কোভিড-১৯’-এর ধাক্কার আগে অনেক আগে থেকেই নিজের দেশে বিভিন্ন বিষয়ে সমস্যার মধ্যে আছেন। এক মেরু বিশ্বের মহান শক্তিধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০৮ সালে ‘লে-ম্যান ব্রাদারস’-র ভয়াবহ পতনের সম্মুখীন হয়েছিল। বিশ্ব অর্থনীতি হোঁচট খেয়েছিল। হাভার্ড শিক্ষিত প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার ৮ বছরের মেয়াদকালে আমেরিকাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল। সারা বিশ্বের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে। এমনটা দাবি করে থাকেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীরা। নতুন উজ্জ্বল অর্থনীতির দেশ চিনের নেতৃত্বের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল। একটি সূত্র দাবি করছে, উদার অর্থনীতির সমর্থক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে একাধিক সমাজবাদী কর্মসূচীর পথপ্রদর্শক প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০১৪-২০১৬ সালের মধ্যে দেশবাসী তথা ট্রাম্প সাহেবকে একাধিকবার সতর্ক করেছিলেন। মার্স এবং সার্সের ভয়াবহতা প্রসঙ্গে। সম্প্রতি আমেরিকার আরও একটি সূত্রের দাবি, বিশিষ্ট দার্শনিক নোয়ম চমস্কি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সংবাদ মাধ্যমে আরও দাবি করা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ট্রাম্প প্রশাসনকে দোষারোপ করে বলা হয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক বাজারে বলপূর্বক করোনা প্রতিরোধের চিকিৎসা সরঞ্জাম মজুত করেছে। সংবাদে প্রকাশ, আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লক্ষ ৩৬ হাজার ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা ১৫ হাজারের কাছাকাছি।
সুত্রের আরও খবর, ১ কোটি ৬৬ লক্ষ মার্কিন নাগরিক কাজ হারিয়ে বেকার-ভাতার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। গত তিন সপ্তাহে প্রতি ১০ জনে ১ জন করে কাজ হারিয়েছেন মার্কিন নাগরিক। ধনী দেশ আমেরিকার যদি এই অবস্থা হয় তাহলে গরিব দেশগুলির কি অবস্থা হবে?  উপদেষ্টা সংস্থা অক্সফ্যামের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, গরিব দেশগুলির পাশে ধনী দেশগুলি না দাঁড়ালে বিশ্বে আরও ৫০ কোটি মানুষ অসহনীয় দারিদ্রের মুখে পড়বে। অক্সফ্যাম আরও বলছে, করোনা সংক্রমণ রুখতে যে ভাবে সারা বিশ্বের অর্থনীতির চাকা বন্ধ রাখতে হয়েছে, তাতে এই মুহূর্তে ব্যবস্থা না-নিলে দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই এক দশক পিছিয়ে যাবে। পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে এই লড়াই পিছিয়ে যেতে পারে তিন দশক।
করোনা উত্তর বিশ্বের মঞ্চ তৈরি।  ‘’......ছমছমে প্রান্তর জুড়ে খেলনা দুই মানুষ/ ভেসে ওঠে সুখেদুঃখে অস্পষ্ট অতীত দিন নিয়ে/ ভয়ে ভয়ে সরে আসে শষ্যের পাশাপাশি খুব.........।‘’ সন্ততি, শঙ্খ ঘোষ। বিপন্ন বিস্ময়ে চেয়ে আছি। সকালে মুখে কাপড় ঢাকা একদল মানুষ সাদা গণ্ডির ভেতরে দাঁড়িয়ে। আনাত্মীয়ের মতো। সারা বিশ্বের ছবি। ভোরের আলোয় ভেসে আসে পাখিদের সানন্দ কলরব, আনন্দের সকাল। ঘুঘুর ডাকে ঘুম ভাঙে। কোকিলের বিরামহীন বসন্তের আবেদন এবং আহ্বান। নিঝুম দুপুরে নেড়ি কুকুরের ক্লান্তিহীন অভিযোগ অভিমান। সভ্যতার চাকা থেমে গেছে! সীমান্তে আজ আমি প্রহরী। টিভির পর্দায়, দৈনিক খবরের কাগজে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষুধার্ত মানুষের বিরামহীন ফ্যাকাসে চেহারা। উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করাও আজ বিভ্রান্ত। নব্বইয়ের দশকে (১৯৯০) পুঁজিবাদী শিবিরের উপহার ‘বিশ্বায়ন’। বিপুল কর্মসংস্থান, উন্নত জীবনের হাতছানি ছিল তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর এই সভ্যতায়। বিশ্বায়ন সভ্যতায় আস্তে আমেরিকার নেতৃত্বে ধনী দেশগুলির সময় লেগেছিল ৪৫ বছর।   
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি নতুন করে ভাবা হয়। লেখা হয় ট্রু ম্যান নীতি। এই নীতিতে বলা হয়েছিল সোভিয়েত রাষ্ট্রকে কন্টেন করতে হবে। এই রাষ্ট্রকে নিজের সীমার মধ্যে আটকে দিতে হবে। অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের বিস্তার আটকে দিতে হবে। দারিদ্রের জন্য বিল্পবের প্রেক্ষাপট তৈরি হয় প্রতিটি গরিব রাষ্ট্রে। দারিদ্র দূরীকরণের জন্য তৈরি হয় মার্শাল ল। এই নীতিতে বলা হয়েছিল প্রতিটি গরিব রাষ্ট্রকে আর্থিক সাহায্য করে চেষ্টা করতে হবে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের জয়যাত্রা আটকে দিতে। একমেরু বিশ্বের অধিপতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই পরিকল্পনা সাফল্যের সঙ্গে রূপায়ন করে ‘বিশ্বায়ন’ সভ্যতা পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দেয়। সঙ্গে সঙ্গত করেছে অন্যান্য উন্নয়নশীল রাষ্ট্র।  
করোনা উত্তর বিশ্বে নতুন বিশ্ব রাজনীতির ভারসাম্যের দৌঁড়ে আছে উন্নয়নশীল দুই রাষ্ট্র ভারত এবং চিন। সঙ্গে থাকতে পারে বিশ্বের কয়েকটি গরিব দেশ। অক্সফ্যামের সমীক্ষায় আশঙ্কা করা হয়েছে, করোনার কারণে নতুনভাবে ৫৪ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষের দৈনিক রোজগার নেমে আস্তে পারে সাড়ে পাঁচ ডলারের নীচে। সম্ভবত এটাই বিশ্ব ব্যাঙ্কের দারিদ্রের মাপকাঠি।
বর্তমান অতিমারির সময় আঞ্চলিক ক্ষেত্রে ত্রাণ নিয়ে যেমন রাজনীতি করা উচিত নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ত্রাণ নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোর থেকে বিরত থাকতে পারলে ভালো। মানবতার কারণেই চিন যেমন ভারতে ১ কোটি ৭০ লক্ষ পিপিই ত্রাণ হিসেবে পাঠিয়েছে। প্রয়োজনে অন্যান্য সাহায্য আরও করবে। জাতীয় ক্ষেত্রেও মুই বড় না তুই বড় ভাবার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে একটি প্রবাদ, ‘রথ ভাবে আমি দেব/ পথ ভাবে আমি/ আড়ালে হাসেন অন্তর্যামী’।                       
        

                     

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?