রক্তপাতহীন রণাঙ্গনে আমিও সৈনিক






দীপেন্দু চৌধুরী
দু’টি ছবি দু’টি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। ছবি দুটোই আসে সামাজিক মাধ্যমে। বর্তমান সময়ে সামাজিক মাধ্যমে আমরা সবাই নিয়ন্ত্রণহীন সামাজিক এবং অবশ্যই সাংবাদিক। বিদ্যুৎ না থাকলে টিভি চলবে না। খবরের চ্যানেল দেখা সম্ভব নয়। হাতে স্মার্টফোন আছে। সামাজিক মাধ্যমে অবিরত সংবাদ, সংবাদ বিষয়ক প্রবাহ বয়ে চলেছে সেই মুঠো ফোনে সস্তার হোক বা দামি, সবার হাতে হাতে ঘুরছে। হাতে গরম ২৪ X ৭, রাজনৈতিক খবর, সামাজিক খবর, সাংস্কৃতিক খবর, পরিবেশ বিষয়ক খবরের প্রবাহ অনির্দিষ্ট সময়কাল ধরে চলতে থাকে। মুদ্রণমাধ্যম বন্ধ থাকলেও আমাদের নির্ভর করতে হয় একবিংশ শতাব্দীর সব থেকে জনপ্রিয় মাধ্যম ‘সমাজ মাধ্যম’-র ওপর। নোভেল করোনাভাইরাসের কারণে কেন্দ্রীয় সরকারকে সারা দেশে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করতে হয়। আমরা যেখানে থাকি সেখানে চারদিন সংবাদপত্র আসেনি। আমরা মেনে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ‘লকডাউন’ প্রত্যাহার হলে আবার খবরের কাগজ পাব। এই চারদিন আমরা টিভির খবরের থেকে সামাজিক মাধ্যমের খবর বেশি বেশি করে দেখেছি  
সামাজিক মাধ্যমের সব খবর অথবা পোস্ট বিশ্বাসযোগ্য বা নির্ভরযোগ্য এমনটা দাবি করাটা অত্যন্ত বাতুলতা হবে। এবং অবশ্যই অপ্রিয় সত্য বলাও হয়ে যেতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল থেকে পাওয়া বেশিরভাগ পোস্ট আমাদের কাছে হয়ত গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক খবর থাকে যা গুজবের ওপর নির্ভর করে লেখা হয়। কিছু কিছু পোস্ট বা লেখা অবশ্যই অত্যন্ত উঁচু মানের। আর খবর?  সাধারণ বিষয়, ব্যক্তি আক্রমণ বাদ দিলে অনেক খবরই হয় মানবিক। বর্তমান সময়ে রক্তপাতহীন এক অচেনা সামাজিক শত্রুকে চিনতে আমরা সবাই অতল গহ্বর থেকে নতুন করে যাত্রা শুরু করেছি। আমরা আলোর যাত্রী হতে চাইছি। আলোকিত সভ্যতা আবার কি আফ্রিকার অন্ধকার গুহায় হারিয়ে যাবে? বিশ্বাস হয় না। প্রকৃতি আমাদের প্রাচুর্য দিয়েছে। লড়াইয়ের শক্তি যুগিয়েছে। রক্তপাতহীন ‘করোনাভাইরাস’ নামক এই অস্ত্র কালান্তক হতে পারেসাময়িকভাবে উন্নত বিঞ্জানের কাছে অচেনা হলেও আলোর সুক্ষরেখা চেনা নীল আকাশে ছলকে ছলকে উঠছে। আশায়ভরা বিদ্যুতের ঝলক। ভয় পেলে চলবে না। দু’-দু’টো বিশ্ব যুদ্ধের ‘রক্তনদী’ পেরিয়েইতো আমরা এই সভ্যতা পেয়েছি। লেখা হয়েছে ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’। লিও তলস্তয় লিখে গেছেন। এরিখ মারিয়া রেমার্ক লিখে গেছেন ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। মানবিক সভ্যতার দলিল লিখে গেছেন দু’ই বিশ্ববরেণ্য লেখক। 
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষ দিকে অর্থাৎ ১৯১৯ সালের ২৪ জুন কবিগুরুর হাতে এসে পৌঁছল একটি চিঠি। না সেটা ‘রাশিয়ার চিঠি’ নয়। বা ব্রিটেনের রানীর চিঠি নয়। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর চিঠিও নয়। চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন বিশিষ্ট ফরাসী ঔপন্যাসিক, জীবনের গদ্যশিল্পী, মানবতাবাদী ভাবুক, দার্শনিক রম্যাঁ রলাঁ। তিনি রবীন্দ্রনাথকে আবেদন করেছিলেন ‘মুক্তমনের স্বাক্ষরপত্র’-তে সই করার মানবিক আবেদন নিয়ে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, ‘ছেলেটা’, ‘সাধারণ মেয়ের’ কবি, ‘গোরা’, ‘ঘরেবাইরে’ উপন্যাসের জীবনশিল্পী বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সই  করে দিয়েছিলেন সেই ‘মুক্তমনের স্বাক্ষরপত্র’-তে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দু’ই জীবনশিল্পী সেতু রচনা করলেন। মানবিক বিশ্বের সেতু। শুরু হল এক ধ্বংসোন্মুখ পৃথিবীকে বাঁচানোর ‘পটকথা’। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা দুই মানবতাবাদী ভাবুকের কথপোকথন। ভারতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফ্রান্সে রঁম্যা রলাঁ।
    
‘করোনাভাইরাস’ ভেঙ্গে যাওয়া সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে দিতে সহায়তা করছে সম্ভবত অমানবিক সমাজের মুখ আজ ভেঙ্গে যেতে চাইছে। ‘মানবিক মুখ’ আমাদের সামনে সেবার ব্রত নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। হেথায় আর্য, হেথা অনার্য.........। সামাজিক মাধ্যমে অসংখ্য ছবি এবং খবরের ভিড়ে দু’টো উল্লেখযোগ্য ছবি এবং খবর আমি হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পাই। মানবসভ্যতা যে উচ্চতায় এসে পৌঁছেছিল আলোচ্য এই ভাইরাস সারা বিশ্বের মানুষকে ভয়াল এক আতঙ্কের মধ্যে নিমজ্জিত করেছে। তিল তিল করে গড়ে ওঠা সভ্যতার শৃঙ্খল কি টাল মাটাল? উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের রাষ্ট্র নায়কদের গড়ে তোলা এই সভ্যতা আজ ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। দর্প-গর্ব, আভিজাত্য সব কিছু কি আজ অদৃশ্য এক চ্যালেঞ্জের সামনে?  দিশাহীন উন্নত চিকিৎসা বিঞ্জান। আবার উচ্চারণ করতে চাইছি ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’ সারা বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের রাতের ঘুম চলে গেছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশের অঙ্গ রাজ্যের এক অর্থমন্ত্রীর মৃত্যুও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এই অর্থমন্ত্রীর মৃত্যু ‘করোনাভাইরাস’-এ নয়। সংবাদমাধ্যম এমনটাই দাবি করছে। এই খবরটিও প্রথমে সামাজিক মাধ্যমে আসে।     
সারা বিশ্বে মৃত্যু মিছিল। চিকিৎসকের অভাব, চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা, স্বাস্থ্যকর্মী সংখ্যা অত্যন্ত কমএক একটা দেশে ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর থেকে তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্যকর্মী অত্যন্ত কম। তবু তারা মানব সেবার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন। তাদের কুর্ণিশ জানাতেই হয়।
এমনই একজনের নাম ইন্দোনেশিয়ার ডাঃ হেদিয়া আলী। তার সম্পর্কে হোয়াটসঅ্যাপে যে লেখাটি দেওয়া হয়েছিল সেই লেখাটি তুলে দিচ্ছি। ‘মৃত্যুর আগে বাড়ি এসে গেটের মুখ থেকে বাচ্চাদের দেখে চলে গেল। তারপর দুনিয়াকে বিদায় জানালো। কত দুঃখের বিষয় যে, আমি আমার সন্তানকে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতে পারলাম না, আদর করতে পারলাম না, শুধুমাত্র মানবসভ্যতা বাঁচাতে নিজের বাচ্চাদের সঙ্গে......
এই ছবিটা সবসময় মনে রাখার। এটি একটি হ্রদয়স্পর্শ ছবি, বলিদান করার উদাহারণ। এটি হল ইন্দোনেশিয়ার ডাঃ হেদিয়া আলীর শেষ ছবি। যিনি করোনাভাইরাস রোগীদের চিকিৎসা করার সময় নিজেই করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছিলেন। যখন তার মনে হল যে, সে বাঁচবে না, সে বাড়ি গিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তার সন্তান এবং স্ত্রীর দিকে তাকিয়েছিল এবং তারপর চলে গেল, সঙ্গের ছবিটা তার স্ত্রী তুলেছে। যখন সে তার সন্তানদের দেখতে এসেছিল, তখন সে দূরে দাঁড়াল, সে চায়নি যে তার স্ত্রী ও সন্তানরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হোক।
ডাঃ হেদিয়া আলী মানুষ হিসেবে নিজেকে ঈশ্বরের দূত প্রমাণ করলেন। স্যালুট এমন ডাক্তার কে, শতকোটি প্রণাম। অশ্রুসিক্ত চোখে পোস্টটিকে শেয়ার করলাম। জানি আমার মতো এই মুহূর্তে সবার চোখে জল। ঈশ্বর তুমি মানবজাতিকে রক্ষা কর।’   
এই খবরটির সত্যাসত্য আলোচ্য প্রতিবেদক যাচাই করে দেখেনি। কিন্তু যদি খবরটি সত্যি হয় তাহলে এর থেকে মর্মান্তিক আর কিছু হতে পারে না। মহামারি আমাদের আর্তনাদ করতে বলছে না ঠিকই কিন্তু একদল তরুণ চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজসেবী, সাফাইকর্মী, পুলিশ প্রচারের আলোর বাইরে থেকে দিন রাত কাজ করে চলেছেন। আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধ থাকছি বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে। আমাদের আরও সচেতন হওয়ার আবেদন ভেসে আসছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামাজিক অধিকারের খরস্রোতা নদীর প্রবাহে। আমরা সেই আহ্বান শুনতে পাচ্ছি এই মানুষগুলির কাছ থেকে। শুনুন, আবার শুনি আমরা। এই খবরটি মুদ্রণ মাধ্যমেও প্রকাশ করা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যম থেকে তুলে দিচ্ছি, সম্প্রীতির অনন্য নজির গড়ল উত্তর প্রদেশের বুলন্দশহর। বার্ধক্যজনিত রোগে সম্প্রতি মৃত্যু হয় বুলন্দশহরের এক বৃদ্ধের। করোনাভাইরাস আতঙ্কে বৃদ্ধের সৎকারে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী কেউ আস্তে চাননি। বৃদ্ধের পরিবার চিন্তায় পড়ে যান। পাশের এক মুসলিম অধ্যুষিত মহল্লায় খবর যায়। তারা জানতে পারে বৃদ্ধের সৎকার আটকে যাওয়ার ঘটনা। ওই অঞ্চলের মুসলিম যুবকরা চলে আসেন বৃদ্ধের বাড়িতে। তারা বলেন, সৎকারের সমস্ত ব্যবস্থা আমরাই করব। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ওই বৃদ্ধের দেহ কাঁধে নিয়ে শ্মশানের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন তারা(সৌজন্যঃ দ্য ওয়াল)
তথাকথিত মূল্যবোধ ভেঙ্গে ফেলার চ্যলেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে আসছে একদল যুবক, মাঝবয়সী মানুষ। যারা মানবতার উজ্জল মোমবাতি হাতে আলোকিত করছে স্বার্থপর হয়ে যাওয়া ভোগবাদী আলোচ্য সমাজব্যবস্থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে  বিদ্ধস্ত চিনের কথা আমরা পড়েছি। পিছিয়ে থাকা চিনের মানবিক আবেদনে সারা দীয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা জওহরলাল নেহরুর উদ্যোগে চিনের মানুষের সাহায্যের জন্য একটি চিকিৎসক দল পাঠিয়েছিলেন। সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন ডাঃ দ্বারকানাথ কোটনিস।
১৯৩৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত্রি। ভারতীয় চিকিৎসক দল চিনে যাবার  উদ্দেশ্যে এস এস রাজপুত নামে এক জাহাজে উঠলেন। এই দলে ছিলেন পাঁচজন চিকিৎসক। দলের নেতা ছিলেন ডাঃ মদনমোহনলাল অটল। উপনেতা ছিলেন ডাঃ এম চোলকার। অন্যান্যরা হলেন ডাঃ দেবেশ মুখোপাধ্যায়, ডাঃ বিজয়কুমার বসু এবং ডাঃ দ্বারকানাথ কোটনিস। যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্রপচার ঘর তৈরি করে ভারতীয় এই দল চিনা সেনাদের চিকিৎসা করত। যেটা বিশ্বের কাছে উদাহারণ হয়ে আছে। ডাঃ কোটনিস পরপর ১৩ দিন একটুকুও বিশ্রাম না নিয়ে ৫৫৮ জন আহত যোদ্ধার অস্ত্রপচার করেছিলেন। এটা একটি মাত্র উদাহারণ। ভারতীয় চিকিৎসক দলের বাকি চারজন সদস্য একে একে দেশে ফিরে এলেও ডাঃ কোটনিস চিনে থেকে গিয়েছিলেন। মানবসেবায় আত্মবলিদান দিয়েছিলেন তিনি। কোটনিসের মানবিক আবেদন ছিল, ‘’নিপীড়িত নিষ্পেষিত জনগণের মুক্তির জন্য অধ্যাবসায়সহকারে অধ্যায়ন করো।‘’
বিশ্বের এই নিষ্ঠুর অচেনা শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অন্যতম শব্দ রাজনীতির উর্ধে ‘মানবতা’ এবং জাত-পাত, ধর্ম নির্বিশেষে মানবসেবা। যে পথ আমাদের দেখিয়ে গেছেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। তিনি জন্মেছিলেন আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে। সেবার আলো ছড়িয়ে দিতেন সেই আলোর স্পর্শে। যন্ত্রণাকাতর রোগী তাঁকে দেখলে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠতেন চিকিৎসার আগেই মানবিক আবেদনে ভরা ছিল তার উজ্জ্বল মুখ। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল জন্মেছিলেন ধনী পরিবারে। সেই পরিবারে আভিজাত্য ছিল, স্বাচ্ছন্দ ছিল তবু তিনি বেছে নিয়েছিলেন নার্সিং পেশাকে। লোভ ভোগের উর্ধে উঠে আর্তের সেবায় তিনি নেমে এসেছিলেন রাস্তায়। আজও তিনি সারা বিশ্বের কাছে ‘আলোর নারী’। সেবার নারী।
সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে অন্যতম চরিত্র জগবন্ধু মিশ্র বলছেন, ‘’............তুই বাঁকা পথে হাঁটিস মিশ্র। পয়সার কথাটা পরের কথা। যে লাভ বললাম সে লাভ পয়সার নয়, অথচ ওইটাই সংসারে শ্রেষ্ঠ লাভ। এক পক্ষের লাভ আরোগ্যা লাভ, অন্যপক্ষের লাভ সেবার পুণ্য। জানিস? বিশ্ব সংসারে আরোগ্যলাভই হল শ্রেষ্ঠ লাভ।‘’             

 
      

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?