শতাব্দীর পর শতাব্দী আধাঁর কেড়ে নেয় আমাদের দৃষ্টি



দীপেন্দু চৌধুরী
‘দি আইজ অব ডার্কনেস’ উপন্যাসটা আমি পড়িনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি দু’টি পোস্ট নজরে পড়েছে। সম্প্রতি একটি বাংলা দৈনিকে এই বিষয়ে একটি লেখা পড়লাম। নিজের চোখের চিকিৎসার কারণে কয়েক মাস অথবা কয়েকটা বছর গভীরভাবে পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। গবেষণামূলক পড়াশোনা এবং লেখালেখি থেকে কিছুটা গুটিয়ে ছিলাম নিজেকেগত ৪০-৪৫ বছর আমরা অনেকেই ‘দি আইজ অব ডার্কনেস’ সময়ের মধ্যে নিজদের জীবনযাত্রা বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়েছি। এর মূল কারণ অবশ্যই দৃশ্যমান রাজনীতি এবং না দেখা না চেনা, অচেনা রাজনীতির মার প্যাঁচ। আমার প্রসঙ্গ এলেও সেটা সম্পূর্ণ ভাবে নিজস্ব তদুপরি ব্যক্তিগত ব্যাপার। ‘চাল বাড়ন্ত ঘরে জন্মে’ লড়াইটাকে লড়াই বলেই মেনে নিতে হয়।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে রাজনীতির এরিনায় ‘দাস সমাজ’ ব্যবস্থা থেকে যান্ত্রিকভাবে অবশ্যই উন্নত হয়েছে উত্তর বিশ্বায়ন তথা তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ উন্নত বিশ্ব ও উন্নতশীল বিশ্ব। শিল্প বিপ্লবের পর ইউরোপ যে আধুনিকতার আলো দেখেছে তারপর থেকে সভ্যতা কখনও মন্থর গতিতে এগিয়েছে। কখনও জেড গতিতে। প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের অধিকার, নারীর ভোটাধিকার, নারীর কাজের স্বাধীনতা, শ্রমিকের আট ঘণ্টা মজুরির অধিকার ইত্যাদি। আমেরিকার উন্নত গণতন্ত্র, শিল্প বিপ্লব এইসব অধিকার আমেরিকাকে দিল। ইউরোপকে দিয়েছে এবং পরে আরও পরে এশিয়া সহ আফ্রিকাকে দিয়েছে। 
প্রথম বিশ্ব, দ্বিতীয় বিশ্ব এবং.........? প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর বিশ্বে আমরা  সমাজতান্ত্রিক বিশ্বকে দেখেছি। লেনিনের নেতৃত্বে ইউএসএসআর, হো চি মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনাম, মাও সে তুং-য়ের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক চিন। ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবা। পুঁজিবাদী বিশ্বের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের যে আর্থ-রাজনৈতিক দ্বন্দ, শ্রম এবং পুজির লড়াইয়ে কখনো সমাজতান্ত্রিক শিবিরের জয় হয়েছে আবার কখনো পুঁজিবাদী শিবিরেরপ্রথম বিশ্ব যুদ্ধের বিদ্ধংসী প্রেক্ষাপট সারা বিশ্বের যুদ্ধ বিরোধী শান্তিকামী মানুষকে এক মঞ্চে নিয়ে আসে। দিকে দিকে যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলনের স্লোগান ওঠে ‘যুদ্ধ নয় শান্তি’ চাই'। কমিউনিস্টদের ভাষায় ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থান, এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকায় ক্রমাগত অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আগ্রাসন আরও একটি বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে হয়ত বা।
যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের বিভিন্ন মাধ্যমকে ব্যবহারের কথা সামরিক ইতিহাস থেকে জানা যায়। যেমন একটি সুত্র থেকে জানা যাচ্ছে, প্লেগের সময় উইলিয়ম শেক্সপিয়র ছিলেন গৃহবন্দি। ১৬০৬ সালে বিউবনিক প্লেগ বা ব্ল্যাক ডেথে লন্ডনের হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। ১৬৬৫ থেকে ১৬৬৬-র দ্য গ্রেট প্লেগ-এ লন্ডনে এক লক্ষ মানুষ মারা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালে নিউক্লিয়ার বোমার ভয়াবহ বিভীষিকার ইতিহাস মানবতার অভিশাপ বলেই খ্যাত হয়েছে। সময় যত এগিয়েছে, বিঞ্জান প্রযুক্তি ততই উন্নত হয়েছে, উন্নত হয়েছে যুদ্ধাস্ত্রের গঠন ও মান, কার্যকারিতা শক্তি আরও আধুনিক হয়েছে। সর্বোপরি এসে গেছে জৈব জীবাণু অস্ত্র।
মার্কিন লেখক ডিন কুনৎজ-এর লেখা ‘দি আইজ অব ডার্কনেস’ বইটি ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইটি নিয়ে সাংবাদিক দেবাশিস ঘড়াই চলতি বছরের ২২ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় পাতায় ‘অন্ধকারের চোখের পলক পড়ে না’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। সেই নিবন্ধ থেকে, ‘’সম্প্রতি করোনাভাইরাসের প্রেক্ষাপটে ‘দি আইজ অব ডার্কনেস’-এর কথা বার বার উঠে আসছে সামাজিক মাধ্যম-সহ সাহিত্য-সমালোচক ও সংবাদমাধ্যমের একাংশের আলোচনায়।
আলোচনার সূত্রপাত গত মাসে ড্যারেন প্লাই মাউথ নামে একজনের করা একটি টুইট থেকে। টুইটে এই রহস্য-থ্রিলারের ৩৯ নম্বর পর্বের কিছু পৃষ্ঠা তুলে বলা হয়, এই উপন্যাসেই প্রথম করোনাভাইরাসের পূর্বাভাস ছিল। কারণ, ড্যানি যে জৈব-অস্ত্রের দ্বারা সংক্রামিত হয়েছিল, সেই ভাইরাসের নাম ছিল ‘উহান-৪০০’।
ওই ভাইরাসকে ‘বায়োলজিক্যাল ওয়েপন’ বা জৈব-অস্ত্রের কার্যক্রমের কর্মসূচী হিসেবে নিজেদের গবেষণাগারে তৈরি করেছিল চিন। টুইটারে উপন্যাসের কিছু অংশ লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত করে দেখানো হয়, ওই অংশে লেখা- ‘তারা (সামরিক বাহিনী) এর নাম দেয় ‘উহান-৪০০’,  কারণ উহান শহরের অদূরেই তাদের আরডিএনএ গবেষণাগারে এটি তৈরি করা হয়েছিল। ‘উহান-৪০০’ নামের কারণ এই টুইটটি ভাইরাল হয়ে যায়।
শুরু হয় তর্ক, পাল্টা তর্ক। কারণ, বাস্তবে করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থলও চিনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানের একটি বাজার।  একটি অংশের আবার দাবি, উপন্যাসে উল্লেখিত ‘আরডিএনএ ল্যাব’ হল আসলে ‘ঊহান ইন্সটিটিউট অব ভাইরোলজি’, যা করোনাভাইরাসের উৎপত্তির কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে। রহস্য-থ্রিলার বা সায়েন্স-ফিকশন-এর কোনও ঘটনার সঙ্গে পরবর্তী কালে বাস্তবের ঘটনা মিলে গিয়েছে, এমন বহু উদাহারণ রয়েছে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের মতো বিশ্বব্যাপী এক জরুরি অবস্থায় পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠেছে, যখন মার্কিন সেনেটরদের একাংশ উপন্যাসের কাহিনি-কাঠামোর ধাঁচেই প্রশ্ন তুলছেন, চিন কি সত্যিই জৈব-অস্ত্র নিয়ে কোনও পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিল? পরীক্ষায় কোনও ফাঁক থাকার কারণেই কি এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে? না কি সচেতন ভাবেই তাকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে? এই ভাইরাসকে ‘উহান ভাইরাস’ ও বলছেন অনেকে। যাতে স্বভাবতই ক্ষুব্ধ চিন বিদেশমন্ত্রক।‘’
নিউক্লিয়ার বোমাও বানানো হয়েছিল অত্যন্ত গোপনে। নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর প্রাথমিক পর্যায় শেষ হলে সেই বোমাকে প্রতিপক্ষ দেশের অসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা নিয়ে আপত্তি জানান ম্যানহাট্টান প্রকল্পে কর্মরত বিঞ্জানীরা। তথ্য দাবি করছে, হিরোসিমা-নাগাসাকিতে নিউক্লিয়ার বোমা ফেলার আগে ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে একটি স্মারকলিপি দিয়েছিলেন বিঞ্জানী নীলস বোরবিষয় ছিল নিউক্লিয়ার বোমা নিক্ষেপের পর বিশ্বব্যাপী এই বোমা তৈরির সামরিক প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে। মার্কিন বিঞ্জানীদের সতর্কবানী পরবর্তী দশকগুলিতে সত্যে প্রমাণিত হয়েছে। করোনাভাইরাসের থাবা যে ভাবে আমাদের উপর আঘাত হেনেছে, গত শতাব্দীর মার্কিন বিঞ্জানীদের সতর্কবানীকে মনে করিয়ে দেয়। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-র সময়কালকে আমরা জানি। রাষ্ট্রপুঞ্জ নির্দেশ দেয় বিপজ্জনক এবং মানবতাবিরোধী অস্ত্র তৈরি বন্ধ করতে হবে। এই ধরণের সমস্ত অস্ত্রের ভান্ডার ধ্বংস করার দাবিও প্রবল হয়ে ওঠে।

‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-র অবসানের পরে উদার অর্থনীতির শুরুতেই সারা বিশ্বের মানুষ চমকে উঠেছিল। একুশ শতাব্দীর প্রথম বছরেই ‘টু ইন টাওয়ার’ ভেঙ্গে পড়ার ঘটনায়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নতুন রাজনীতির উত্থান। গত কুড়ি বছর বাজার অর্থনীতি এবং সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি সারা বিশ্বে যেমন নিজদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে প্রতিযোগিতায় আছে, পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদ নামক এক ভয়ঙ্কর মানবতাবিরোধী ভয়াবহ শক্তির সঙ্গে লড়তে হয়েছে এই দুই বিশ্বকে। একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় খেটে খাওয়া মানুষ কি নতুন এক জৈব মারণাস্ত্রের সঙ্গে লড়বে? অচেনা এক নতুন রাজনীতির আঙিনায় কি আমাদের টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? সময় বলবে সময়ের উত্তর দিয়ে। আমরা পিতা-মাতা, ভাই-বোন, ছেলেমেয়ে, বন্ধু, প্রতিবেশীর সুস্থতা এবং আরোগ্য কামনায় ব্যস্ত রাখি নিজেদেরকে। নতুন বিশ্বের রাজনীতি থেকে বাঁচতে।                                              


Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?