সংবেদনশীল সমাজের অংশীদার হতে চাই





দীপেন্দু চৌধুরী
লাইনে দাঁড়াতে চাই কিন্তু কোন লাইনে? গত সপ্তাহে স্থানীয় একজন জানতে চাইছিলেন, বাজার বন্ধ কতদিন থাকবে? ভদ্রলোকের পাড়ায় একটা দোকান আছে। বেশ চালু দোকান। লটকোনার জিনিস, মণিহারী, আলু, পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা সব কিছু পাওয়া যায়। আমাদের রাজ্যের যে কোন জেলার কোনও গঞ্জ শহরে গেলে এই ধরণের দোকানের খোঁজ পাওয়া যাবে। এইসব দোকানকে উন্নত দেশের উন্নত সভ্যতার ‘ ডিপার্টমেন্টাল স্টোর’ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। রাজ্যে ‘লক ডাউন’ ঘোষণা হওয়ার আগেই অতি সচেতন মানুষ আগে খবর পেয়ে যায় কি করে? কোন সূত্রে? দেশের সরকারের কোনও বড় সিদ্ধান্তের আগে কিছু মানুষ আগাম অনুমান করে নেয়। এদিনের অভিঞ্জতা সেই কথা বলে হয়ত।  সেদিন আমি সেই ভদ্রলোকটিকে ভরসা জুগিয়েছিলাম। রাজ্যে সাড়ে চার দিনের জন্য ‘লক ডাউন’ ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। ২২ মার্চ রবিবার ‘জনতা কার্ফু’ ছিল। সকাল ছ’টা থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত কার্ফু ছিল। ‘জনতা কার্ফুর’ দিনে রাস্তা ছিল সুনসান। শুধুমাত্র বিকেল পাঁচটার সময় দেশের ‘অনুশাসন’ ছিল হাততালি দিতে হবে এবং কাঁসরঘণ্টা বাজাতে হবে। দেশের নব্য ঘরানার নাগরিকদের। সোমবারের (২৩ মার্চ) বাংলা দৈনিকের পাতায় ছবি ছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আহ্বানে গোটা দেশে জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের অভিবাদন জানাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নিরাপত্তারক্ষী ও কর্মীরা। দৈনিকটি এই ছবির নিচে মন্তব্য করেছে, তবে সংস্পর্শ এড়ানোর বিধি শিকেয় তুলে এত লোক জড়ো হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আলোচ্য প্রতিবেদকের প্রশ্ন, ‘ব্রেক দ্য চেন’-র বৈঞ্জানিক ভিত্তি এবং বিশ্বাসযোগ্যাতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এদিন এই ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে’-র সংস্কৃতির অনুশীলন করানো হল না তো? আমরা গর্বিত হিন্দু ভারতের নাগরিক হিসেবে।
পাড়ার দোকানদারের উদ্বেগের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন দোকানে লাইন। মানুষ বাড়িতে খাদ্য দ্রব্য মজুত করতে চাইছে। আমার কাছে একটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ আসে ২২ তারিখ রাতে, তাতে লেখা ছিল, ‘আগামীকাল বিকেলের মধ্যে আপনার সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিপত্র থেকে খাদ্য শস্য ঘরে মজুত করতে হবে।’ মানে সবজি বাজারে, মাছের দোকানে, লটকোনার দোকানে, ওষুধের দোকানে, ফলের দোকানে মায় মদের দোকানেও লাইন দিতে হবেরাজ্যে ‘লক ডাউন’ শুরু হওয়ার আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ভিডিও দেখলাম। মদের দোকানে লাইন। তরুণ থেকে সব মানুষের ভিড়। ভিডিওতে একজন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলছে, ‘দেখুন এদের কান্ডঞ্জান দেখুন! মানুষ বাঁচতে চাইবে তা না......’
আমার মনে পড়ল দিন দু’ই আগে একটা গাছে বসে হুতোম গাইছিল, ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে......।’ রাজনীতির প্যাঁচ পয়জারে কে কত দঢ় সেটা বোঝাতে এই শতাব্দীর মানুষ একটা মারণ রোগের আক্রমণের ক্রান্তিকাল সময়েও হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকতে চাইছেন কেন? মানুষ কি এতটাই বিলাস বিলাসিতায় মজে রয়েছে? আর্থিক এবং সামাজিক নিরাপত্তাই কি এর অন্যতম কারণ? অথবা চরম হতাশা? চাকরি নেই, চাকরির নিরাপত্তা নেই। উচ্চ শিক্ষিত হয়েও ‘হাউস স্কিপিং’ নামক আলঙ্কারিক বিভাগে সাফাইকর্মী, চতুর্থ শ্রেণির চুক্তিকর্মী হিসেবে কাজ করতে হচ্ছে তাদেরস্মার্ট ফোন হাতে ইঁদুর দৌড়ে পিছিয়ে থাকাটা কি আমাদের চরম হতাশায় নিমজ্জিত করছে?  হুতোমের গানের কারণটা সেদিন  বুঝিনি, আজ বুঝলাম।
মনে পড়ল ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা-র’ লেখক কালী প্রসন্ন সিংহ মহাশয়ের কথা। কালী প্রসন্ন লিখছেন, ‘’এদিকে সহরে সন্ধ্যাসূচক কাঁসর ঘণ্টার শব্দ থামলো। সকল পথের সমুদায় আলো জ্বালা হয়েচে। ‘’বেলফুল!’’ ‘’বরফ!’’ ‘’মালাই!’’ চীৎকার শুনা যাচ্চে। আবগারীর আইন অনুসারে মদের দোকানের সদর দরজা বন্ধ হয়েচে অথচ খদ্দের ফিচ্চে না—ক্রমে অন্ধকার গা ঢাকা হয়ে এলো; এসময় ইংরাজি জুতো, শান্তিপুরে ডুবে উড়নি আর সিমলের ধুতির কল্যাণে রাস্তায় ছোটলোক ভদ্দরলোক আর চেনবার যো নাই। তুখোড় ইয়ারের দল হাসির গররা ও ইংরাজি কথার ফররার সঙ্গে খাতায় খাতায় এর দরজায়, তার দরজায় ঢু মেরে মেরে বেড়াচ্চেন------------------‘’
‘করোনা ভাইরাস’ নিয়ে তামাম দুনিয়া আজ সরগরম। মানুষের মৃত্যু মিছিল দিনের পর দিন বাড়ছে। দায় কার এই অনুসন্ধান করার সময় এখন নয়। দায়বদ্ধতা আমাদের সকলের। সূত্রের খবর, ইটালিতে ৬০ মিলিয়ন লোক গৃহবন্দি। দেশটার অলি গলি বড় রাস্তা আজ সুনসান। এক সময়ে কল কোলাহলে ব্যস্ত উন্নত দেশটা আজ কালের করাল আঘাতে ‘মানবতার’ দরজায় দরজায় কড়া নাড়ছে। শুধু সতর্ক না থাকার জন্য। চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে ইটালির অভিঞ্জতা। বর্তমান সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে আহ্বান থাক, আসুন পরস্পর পরস্পরের প্রতি সহমর্মী হই, সংবেদনশীল হইযৌথ পরিবার না থাক যৌথ সংস্কৃতি আমাদের বৃহত্তর মানব সভ্যতার লাইনে দাঁড় করিয়েছে। আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করার জন্য।                  

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?