চেতনার মান এই শতাব্দীর ভাঙ্গা মানের চেতনা
দীপেন্দু চৌধুরী
উচ্চকোটি বাঙালির যে দর্প ছিল, গর্ব
ছিল, ‘জীবে প্রেম করে যেইজন সেজন সেবিছে ঈশ্বর’। বাঙালি সমাজ মানেই সংস্কৃতি,
আভিজাত্য, ‘বার ঘর এক উঠোন’। সংস্কারমুক্ত সমাজ, মুক্তমনা পরিবার, যুক্তিবাদী
সমাজ। গাজন মেলা, পঞ্চরসের আসর, আলকাপের
গান, ভাদুর গান। কবিগানের লড়াই, চণ্ডী মণ্ডপ, অবাধ মেলামেশা। যৌথ-পরিবার,
যৌথ-সমাজ। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ছিল। পাশাপাশি আর্তের সেবায় বাঙালি
সমাজের ঐকান্তিক আত্মনিবেদন পণ্ডিত বিদ্যাসাগরের পথেই বাঙালি চেনে। অবিভক্ত বাংলা
‘প্লেগে’-র মতো মহামারি দেখেছে। শরৎচন্দ্রের গল্প উপন্যাসে আজও জ্বল জ্বল করছে।
চেনা অচেনা প্লেগ রুগীর সেবায় আপামর মানুষ সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বেশিদিন আগের কথা
নয়, গত শতাব্দীর আশির দশকের (সম্ভবত) শেষ দিকের একটি ছবির কথাও মনে পড়ছে। বিশ্ব
বরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘গণশত্রু’। প্রোমোটারের কায়েমি স্বার্থের
সঙ্গে একজন সমাজ সচেতন ডাক্তারের লড়াই। ‘পথের পাঁচালী’-র পরিচালক আমাদের আবারও মনে
করিয়ে দিয়েছিলেন সমাজকে জাগতেই হবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের বলতে
হচ্ছে এ কোন সমাজে এসে আমরা পৌঁচেছি?
একবিংশ শতাব্দীর মারণ রোগ ‘করোনা
ভাইরাস’ বাংলায় যখন ধরা পড়ল, জানা গেল আক্রান্ত দুই যুবকের পরিবারই অভিজাত। তাদের
পরিবারের সদস্যরা রাজ্য সরকারের পদস্থ আমলা। প্রশ্ন উঠছে তাদের চেতনার মান নিয়ে।
সচেতন উচ্চশিক্ষিত পরিবারের অভিভাবক এবং তাদের সন্তানের এই ভূমিকা কি হওয়া উচিত
ছিল? ছেলে আক্রান্ত জেনেও সার্বজনীন হাসপাতালে ভর্তি না করে দু’দুটো দিন অবাধে
কলকাতা শহরে ঘুরে বেড়ালেন তারা? অভিযোগ উঠছে ডাক্তারের নির্দেশ অমান্য করে ইউরোপের
আলো দেখা লন্ডন কলেজের দু’ই ছাত্র সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, স্বাধীনভাবে মহানগরে
ঘুড়ে বেড়ালেন? তাদের বলারমতো প্রশাসনিক এবং সামাজিক অভিভাবক কেউ নেউ? সংবাদে
দেখানো হচ্ছে একজন আমলা তিনি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে স্বেচ্ছায় গৃহ পর্যবেক্ষণে
গিয়েছেন। এটা যদি সত্যি হয় তা হলে তিনি রবিবার ডাক্তারের পরামর্শ মেনে ছেলেকে
বেলেঘাটার আই ডি হাসপাতালে ভর্তি করলেন না কেন? তার বুদ্ধি, বিবেচনা, প্রশাসনিক,
সামজিক জ্ঞান সম্পর্কে আমাদের ধারণা আছে। বিশেষত সংবাদ মাধ্যমের কর্মী এবং রাজ্য
সরকারের কর্মীদের। তবু প্রশ্ন উঠছে। মানুষ সতর্কতা অবলম্বন করতে চায়। আপনি বা
আপনার পরিবার পাশে থাকবে না কেন? সন্তান স্নেহ কি আপনাকে অন্ধ এবং বধির করে
রেখেছিল?
বহুধা
বিভক্ত বর্তমান সমাজে ‘ঐকতান’-র সুর হারিয়ে গেছে। ‘করোনা ভাইরাস’ কি জৈব অস্ত্র?
অনেকেই সন্দিহান, পরীক্ষামূলকভাবে এই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে কি? ইউরোপ, আমেরিকা
এবং চিনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ বর্তমান উত্তর বিশ্বায়ন সমাজকে এক মহা সঙ্কটে এনে
দাঁড় করিয়েছে। ঠিক সেই সময় ‘করোনা’ নামক এক অচেনা ভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
‘হু’ এই রোগ সম্পর্কে আমাদের বিভিন্ন সতর্কতার কথা বলছে। ‘মহামারি’ জেনেও আমরা চুপ
করে বসে থাকব? আজ আর ‘রাজনীতির’ কূটকেচালির সময় নয়। আমাকে বাঁচতে দিন আপনি নিজে
বাঁচুন। সামনে আরও ভয়ঙ্কর সময়ের সঙ্গে আমাদের জুঝতে হতে পারে। আসুন আবার উচ্চারণ
করি, ‘সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নায়’
Comments
Post a Comment