শাহিন বাগের দাদিদের মনে রেখে
দীপেন্দু চৌধুরী
এই বছরের নারী দিবসের প্রাক্কালে এবং নারী দিবসের দিন দিস্তা দিস্তা লেখা প্রকাশ হবে। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি সহ বিভিন্ন ভাষায়। কোনও লেখায় নতুন নাগরিকত্ব আইন (সিএএ), এনআরসি বাতিলের দাবিতে শাহিন বাগ, কলকাতার পার্ক সার্কাস সহ ভারতের বিভিন্ন শহরের মহিলাদের সমাবেশ আমাদের মনে করিয়ে দেবে, মনে করিয়ে দেবে প্রাক স্বাধীনতা আন্দোলন। হাজারে হাজারে শিক্ষিত-অশিক্ষিত মহিলার দল ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল সেই সময়। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় মহাত্মা গাঁধির আন্দোলনে। সশস্ত্র বিপ্লবে, মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে। আজাদ হিন্দ ফৌজে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে। এবং পরে বামপন্থী আন্দোলনেও। ভারতীয় নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা ইতিহাসবিদরা লিখে গেছেন। সেইসব বিষয় বেছে নেওয়া হয়েছে ওই সব লেখায়। সে সময়ের নারীদের বিভিন্ন ভূমিকা মাথায় রেখে। পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের স্বাধীনতা কতটা ছিল? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি। নারীরা সামনে থেকে আন্দোলন করলেও তাদের ক্ষমতায়ন কতটা ছিল সেই প্রশ্ন আজ থেকে ৭৩ বছর আগেও ছিল বর্তমানেও আছে। এই সাত দশকে প্রাপ্তি বলতে ইন্দিরা গাঁধির প্রধানমন্ত্রী হওয়া। এবং কংগ্রেস সরকারের আমলে মহিলা রাষ্ট্রপতি।
অতীতের ইতিহাস দাবি করে,
আমাদের অবিবক্ত বাংলায় প্রথমে যারা চরমপন্থী রাজনীতি করত পরবর্তীতে তারা এবং তাদের
মহিলা কর্মীরা কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিল। এদেরই এক গোষ্ঠী একটা পত্রিকা প্রকাশ করত।
নাম ছিল ‘মন্দিরা’। মেয়েদের পত্রিকা মেয়েরা চালাবে এমনটা সবাই জানে। তবু যখন নিয়ন্ত্রণটা নজরে
আসে তখন জানা যায় পুরুষরা আড়াল থেকে এই পত্রিকার নিয়ম নীতি ঠিক করে থাকত। ১৯৪৮ সালের পরে এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব অরুণ গুহের হাতে তুলে দেওয়া
হয়েছিল। সেই ইতিহাস এবং ধারাবাহিকতা থেকে কি আমরা আজও মুক্তি পেয়েছি? কিন্তু সত্তর
বছরের প্রাপ্ত বয়স্ক গণতন্ত্র আমাদের অন্য কহিনীর কথা শোনায়। সম্প্রতি দিল্লির
শাহিনবাগ আন্দোলন এবং পার্ক সার্কাস আমাদের ভিন্ন কিছু ভাবতে বলে।
ভারত সহ সারা বিশ্বে
নারীরা পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সামনে থেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ভারতের
ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। নারী ছিনিয়ে আনতে পেরেছে
নিজেদের অধিকার। দীর্ঘ আইনি এবং বিভাগীয় লড়াইয়ের পর। পাশাপাশি আজও সামন্ত ভারতের
ছবি জ্বল জ্বল করছে। যে ভারত ‘ইন্ডিয়া’ নয়। ধর্ষণ নামক এক দানবীয় সংস্কৃতি আধুনিক
গণতন্ত্রের ভারতকে ধমকাচ্ছে। চমকাচ্ছে। পারিবারিক হিংসার পরিসংখ্যান প্রতি বছর
লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আইন আদালতকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে গ্রামীন ভারতে সামন্ত শাসন
অব্যাহত। দলিত, গরিব পরিবারের মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া প্রভাতি সংবাদ পত্রের
প্রতিদিনের খবর। শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত পরিবারে তুচ্ছ কারণে ‘ডিভোর্স’ অবলা নারীকে
মর্যাদাহীন বে-আব্রু করে দিচ্ছে। আজও ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে ‘একলা নারী’
(সিঙ্গল উইমেন) এক ঘরে। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় তাদের। পরিবারে, অফিসে পুরুষের
রক্তচক্ষু, লোভ লালসা নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদের একলা চলতে দিতে অনুমতি দেয় না। নতুন
এক সংস্কৃতিকে সুচতুরভাবে সমাজে চাগিয়ে দেওয়া হয়ছে যে, সংসার চালাতে গেলে ‘নারী দেহ’কে
বাজারে প্রয়োজনে ব্যবহার কর। পরম্পরাগতভাবে যেটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
আজ যে নারী ব্যক্তি
জীবনে আপত্তি করছে, কাল পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থায় পুরুষের শাসন সে মেনে নিয়ে
আত্মসমর্পণ করবে। এই ট্র্যাডিশন অব্যাহত। তথ্য-প্রযুক্তি
নির্ভর ভোগবাদী ভারতে একজন নারী লড়াই করতে করতে এক সময় হয়ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য
হয়। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের এই গল্পের কথা ৬ মার্চ কলকাতা থেকে প্রকাশিত
বাংলা দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকায়’ প্রকাশ হয়েছে। প্রথম পাতায় প্রকাশিত সাংবাদিক
সুনন্দ ঘোষের করা খবরের শিরোনাম ছিল ‘যৌন ব্যবসায় নামায় মা, ক্ষমা কন্যার’।
নিদারুণ এই মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের তথাকথিত স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবার থেকেই উঠে
আসে। মাত্র ১৮ বছরের মেয়ে অহনা (আসল নাম নয়।) একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকের সাংবাদিককে যে প্রত্যয়ের কথা
শোনায় সেখান থেকেই আমাদের আশাবাদ জাগে। আমরা ভরসা পাই ভারতের প্রথম শ্রেনীর নারী
যেমন স্বাধীনতা চাইছে, স্বাধীনতা পেতে চায় দারিদ্র পীড়িত পরিবারের মেয়েরাও। আরও ভোগ, আরও ভালো থাকা এই মূল্যবোধ সর্বস্ব মা-বাবা এবং পরিবারের অন্যান্য
সদস্যদের বারে বারে ভাবা উচিত নয় কি? ভবিষ্যৎ কি উচ্চারণ করবে? তথাকথিত সংস্কৃতির
ধারক বাহক হলে? দিল্লির শাহিন বাগ, কলকাতার পার্ক সার্কাস এবং লখনৌর ঘন্টাঘর থেকে
ভারতীয় নারী পথ চিনিয়েছে। এই নারীরা দায়িত্ব নিয়েছে তথাকথিত এক ভারতীয় দর্শনকে
ধ্বংস করার। তারা স্লোগান তুলছে ‘ইয়ে সব ঝুটা হ্যায়’।
রবীন্দ্রনাথ লিখে
গেছেন, ‘’প্রাণহীন এ মমতা না জানে পরের ব্যথা/ না জানে আপন/ এর মাঝে কেন রয়/
ব্যথাভরা স্নেহময় মানবের মন! (কবিতাঃ সিন্ধু তরঙ্গ, পুরী তীর্থযাত্রী তরণীর
নিমজ্জন উপলক্ষে, মানসী কাব্যগ্রন্থ।)
Comments
Post a Comment