তুমি কি সেই আগের মতোই আছ?




দীপেন্দু চৌধুরী

তুমি কি সেই আগের মতোই আছ? মান্না দের গানটা মনে পড়ছে। কাকে বলব? কার কাছে জানতে চাইব? সময় হ্যা সময় চলে যায় সময়ের মান দন্ডে। আক্ষেপ হয়। কে বা কারা যেন আমাদের অন্তঃপুরের আড়াল থেকে মুচকে হাসে। কতদিন, কত কাল কত বছর হয়ে গেল। পারিবারিক কর্তব্য, সামাজিক দায়বদ্ধতা, টালমাটাল রাজনীতির মিছিল থেকে ‘আবেগ ঘন’ অন্বেষণ শেষে যখন বুঝলাম আমার পথ হারিয়ে গেছে। তাই বলি তুমি বা তোমরা কি আগের মতই আছ? ‘লক্ষ্মীবুড়ি দোলায় চেপেছে’ গল্পে অমলেন্দু চক্রবর্তী লিখছেন, ‘’মৃদু বাতাসে গাছপালার পাতায় পাতায় ঝির ঝির শব্দটা আবার স্পষ্ট হয়ে উঠতেই কাছে দূরে পাখিরা ডাকছে, পুকুরপারে খানাখন্দে ব্যাঙের ডাক। এতক্ষণ এরা ছিল, এতধ্বনি, বোঝা যায়নি কিছুই। এবং আদ্যিকালের প্রাচীন ধ্বনিগুলি ধীরে ধীরে জেগে উঠতেই, ঘরবাড়ির আনাচে-কানাচে, ফাঁকে-ফুকুরে ঘরের বৌ-ঝিরা। যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা ঘোমটা টেনে, আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ঘরের দিকে পালায়। ...............যারা মিছিলে যায়নি, যেতে পারেনি, হঠাৎ নিজেদের খুঁজে পেয়ে ঝিম মেরে যায়।‘’ এই স্মৃতি মন্থন একটা ছবি। না ঠিক ছবি নয়, একটি পোস্টার। সিপিএম-কংগ্রেসের যৌথ জনসভা বীরভূমের নলহাটিতে ৮ ফেব্রুয়ারি ছিলআমার শহরের আকাশের সীমানা ছড়িয়ে ছটিয়ে কত বড় হয়েছে? একটা ‘টি’ শেপের শহর আজ আরও অনেক রাস্তা নিয়ে নতুন ম্যাপ তোইরি করেছে নিশ্চয়। ১৯৫৮ সাল থেকে ২০১১ প্রত্যক্ষভাবে চল্লিশ বছর রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মিছিলে ভিড়ে ছিলাম। শৈশব থেকে যৌবনের প্রখর রোদভেজা অহংকারে। পরোক্ষভাবে আরও দশ বছর। তারপর রাজনৈতিক-সামাজিক টানাপড়েন ছিটকে দিল তরঙ্গায়িত হ্রদয়ের বন্ধন।
পরিবর্তন শব্দটার সঙ্গে আমাদের যৌবনে পরিচয় ছিল না। ১৯৭৭ সালে আমাদের বয়স আর কত ছিল? কলেজে পড়ি। ১৭ বছরের ছেলে। বাংলা লেখায় হাত থাকায় স্থানীয় উচ্চ শিক্ষিত আমলা, শিক্ষক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী মহলে আলাদা একটা পরিচয় ছিল। এটা আরও ভালো অবস্থানে এসেছিল তার কারণ লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করা। ১৯৭৭ সালে যেদিকে তাকাই লালে লাল। কৃষ্ণচূড়া-পলাশ ফুলে লালে লাল। কিন্তু বড় হয়ে রেল লাইন টপকে কলকাতায় এসে বুঝলাম ‘লাল’ শব্দের অনেক ভাগ আছে। ব্যপ্তি আছে, মানে আছে। আলাদা ব্যকরণ আছে। কেউ কেউ বলল, পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থার মধ্যেই আঞ্চলিকতার সাব টেক্সট (sub text) আছে। কারণ অভিযোগ উঠছিল কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে উপনিবেশ করতে চাইছে। কিন্তু উল্টো ফসল উঠে এসেছে। একটা করে দশক গেছে আমাদের রাজ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রের বামপন্থীদের দাপট বেড়েছে। বিশেষত তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী বামফ্রন্টের। কংগ্রেস নেতা পান্নালাল দশগুপ্ত বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকতা কি শেষে আঞ্চলিকতায় রূপান্তরিত হল? 
তিন দশক শাসনের পরে বামফ্রন্ট ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিদায় নিল। একটি দল বা সেই দলের নেতৃত্বে আরও কয়েকটি সংসদীয় বামদলের সংগঠন চালানোর ব্যর্থতা ছিল অন্যতম কারণ।
দলগতভাবে সিপিএমকে এককভাবে দায়ী করা উচিত হবে না। যে বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের আগের দুই দশক বিশ্ব অর্থনীতি এবং রাজনীতির পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, বিশ্বায়ন, ভারতে উদারপন্থী অর্থনীতির দাপটে বাপপন্থীদের আত্মবিশ্বাস টাল খেয়েছিল। আমরা যারা সরকারের বা সরকারি দলের প্রসাদ খাইনি আমাদের উপর সব রকমের আক্রমণ প্রবলভাবে নেমে আসে। ‘ভাগ কর এবং শাসন কর’ এই দর্শনে এক শ্রেণীর নেতা এবং গোষ্ঠী আমাদের মত সমাজ নিরপেক্ষ এবং দল নিরপেক্ষদের আক্রমণ করতে সুবিধা পেয়ে গেল। বিশেষত একুশ শতাব্দীর প্রথম দশকে। ২০০০ সাল থেকে ২০১১-র মধ্যে বাংলার ‘সুশীল সমাজ’ ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। রিজওয়ানুরের অস্বাভাবিক মৃত্যু, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নেতাই বাংলার রাজনীতিতে ব্যপক প্রভাব ফেলল। আবার এক ‘পরিবর্তন’-র মুখোমুখি হলাম আমরা। রেলের খালাসিদের মতো কয়কেটা দলের নেতারা তখন আমাদের ধরে টানছে এবং স্লোগান দিচ্ছে। ‘জোরসে মারো হেঁইয়ো’, আমার দলে আসবে তুমি হেঁইয়ো। শুধু দল নয়। স্লোগান শুনতে পাচ্ছিলাম, ‘আমাদের দলে আমার গোষ্ঠীতে থাকতে হবে।’ জোরসে মারো হেঁইয়ো। কারা যেন তখন ‘আমরা-ওরা’ শব্দবন্ধ রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সমাজে নতুন দর্শন হিসেবে ছড়িয়ে দিয়েছে। আমরা যারা ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজ নিরপেক্ষ, দল নিরপেক্ষ এবং পরিবার নিরপেক্ষ থাকতে চাইলাম, তারা বেশি করে আক্রান্ত হলাম। বারে বারে প্রমাণ দিতে হয়েছে ‘আমি ধর্মনিরপেক্ষ’তবু নিস্তার পেলাম না। আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হল। সামাজিকভাবে প্রায় এক ঘরে করে দেওয়া হল। মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারলাম না আর। দু’কাঠা জমির মাটির বাড়িটা কুথায় যেন হারিং গেল গো। যার ঘর লায়, বাড়ি লায়, মা লায় সমাজে তার বা তাদের কুনও মান থাকে? মান্যতা থাকে? ‘উন্নয়ন’ শব্দের আড়ালে ভালোবাসা কুথাকে হারিং যায়?             

পারিবারিক বন্ধন, দারিদ্রক্লান্ত হা-হুতাশ করা যৌবন টপকে নলহাটি ছিল আমার রোজ নামচার প্রাত্যহিক খাতা। রামপুরহাট ছিল আমার যৌবনের বারাণসী। আবেগ তুমি ঘুমিয়ে থাক। আমি উচ্চারণ করি, রবীন্দ্রনাথ, ‘’আজি অন্ধতামসী নিশি।/ মেঘের আড়ালে গগনের তারা সবগুলি গেছে মিশি।/ শুধু বাদলের বায় করি হায়-হায় আকুলিছে দশ দিশি।।‘’         
 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?