কয়েকজন বিদ্বজ্জনের বিদ্যাসাগর বিষয়ক অন্বেষণ





দীপেন্দু চৌধুরী
বাংলার নবজাগরণের পথিকৃৎ তিনি। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার অখ্যাত বীরসিংহ গ্রামের ব্রাহ্মণ টোলের পরিবার থেকে বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কলকাতায় এসেছিলেন। সে সময় সুদূর বীরসিংহ গ্রাম থেকে কলকাতায় যাতায়াতের পরিবহণ ব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। কেবলমাত্র পালকি করে যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল। আর ছিল গরুর গাড়ি। বিদ্যসাগরদের পরিবারের তখন পালকি বা গরুর গাড়ি রাখার মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল না। কথিত আছে, তাই পায়ে হেঁটে মাইলস্টোন গুনতে গুনতে কলকাতায় আসেন বিদ্যাসাগর ইতিহাস লেখার আগে ইতিহাস হয়ে উঠতে থাকে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লেখা ‘বর্ণপরিচয়’-র গোপাল-রাখালের গল্প। ঋজু এবং দৃঢ় চরিত্রের ব্যক্তি বিদ্যাসাগর অন্যায়ের সঙ্গে কোনওদিন সমঝোতা করেননি। বিদ্যাসাগরের জন্মের ২০০ বছর পরে আজ আমরা আরও বেশি করে উপলব্ধি করতে পারছি তাঁর জীবনব্যাপী কর্মের গুরুত্ব। অনুভব করতে পারছি তাঁর সমাজ সংস্কার বিষয়ে আন্তরিক পদক্ষেপ।    
১৩২৯ সালের ১৭ শ্রাবণ বিদ্যাসাগর স্মরণসভায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘’আমাদের দেশের লোকেরা একদিক দিয়ে তাকে শ্রদ্ধা ঞ্জাপন না ক’রে থাকতে পারেননি বটে, কিন্তু বিদ্যাসাগর তাঁর চরিত্রের যে মহত্বগুণে দেশাচারের দুর্গ নির্ভয়ে আক্রমণ করতে পেরেছিলেন, সেটাকে কেবলমাত্র তাঁর দয়া দাক্ষিণ্যের খ্যাতির দ্বারা তাঁরা ঢেকে রাখতে চান। অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের যেটি সকলের চেয়ে বড় পরিচয়, সেইটেই তাঁর দেশবাসীরা তিরস্করণীর দ্বারা লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছেন।’’
‘রবীন্দ্রনাথের এ- কথার তাৎপর্য উপলব্ধি করা প্রয়োজন। বিদ্যাসাগরের অজেয় পৌরুষ, অক্ষয় মনুষত্ব এবং সমাজ সর্বস্ব চৈতন্যই হল বিদ্যাসাগরের সত্যকার পরিচয়। দয়াও নয়, বিদ্যাও নয়, জীবনে তাই ঈশ্বরচন্দ্র কোনোদিন ‘সমাজ’ ও ‘মানুষ’ ছাড়া অন্য কোনো ঈশ্বরের চিন্তায় মগ্ন হতে পারেননি। এই না-পারাটাই বড় কথা’’     (বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ-বিনয় ঘোষ, পরিবার, পৃষ্ঠা- ৩/৪)           
রবীন্দ্রনাথ এবং বিনয় ঘোষ দয়ারসাগর বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারের কাজকে কোনও মহৎ কাজ বলে এক কথায় নির্বাসনে পাঠাতে চাননি। তাঁর কাজের ধারা, ব্যক্তিত্ব, সামাজিক সংঘাতকে আন্তরিকভাবে নিজেদের বয়ানে, আমাদের সামনে এনে দিয়েছেন। আমরা সেই গল্পের প্রসঙ্গ নতুন করে উত্থাপন করতে নয়, যে বিষয়টা আমাদের আজও শিক্ষার জগতে সামনে থেকে দেখতে আহ্বান জানায়, সেটা হচ্ছে, ‘বিদ্বান সরব্বত্র পূজ্যতে’চাণক্য শ্লোকে আছে, বিদ্যা আয় রাজপদ কভু তুল্য নয়,/ উভয়ের মধ্যে বহু ভেদ দৃষ্ট হয়।/ কেবল নিজের রাজ্যে রাজার সম্মান,/ সকল দেশেতে পূজ্য যে জন বিদ্বান।। (সূত্রঃ কৃষ্ণচন্দ্র কাব্যতীর্থ-সঙ্কলিত চাণক্য শ্লোক, পৃষ্ঠা-১) বিদ্যা শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন মতামত অতীতে থাকলেও উত্তর ‘বিদ্যাসাগর’ যুগে ‘বিদ্যা বিনে গীত নায়’ আমরা মেনে নিয়েছি। সেই মেনে নেওয়াটা শিখিয়ে গেছেন বরেণ্য সমাজ শিক্ষক পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আরও একটা জনপ্রিয় প্রবাদ সমাজে চালু আছে, ‘লেখা পড়া করে যেই গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই’। বিদ্যাসাগর পায়ে হেঁটে, অক্লান্ত মানসিক শক্তি নিয়ে উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতায় এসেছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতা তখন সংস্কৃত টোলে বিদ্যা দান করাকে পুণ্য কাজ বলে মনে করত। যে সব পণ্ডিতরা এই কাজ করতেন তাঁদের সামাজিক সম্মান থাকলেও আর্থিকভাবে নিজেদের পরিবারে অনটন লেগেই থাকত।
অনাহার, এক বস্ত্রে সারা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার মতো অভাবী গরিব পণ্ডিত আদর্শ শিক্ষকদের আখ্যান এই সেদিন পর্যন্ত আমরা বিভিন্ন গল্প উপন্যাসে পড়েছি। এবং আমাদের ছোট বেলায় আদর্শ শিক্ষকদের কষ্টে দিন যাপন করতে দেখেছি। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেও তাঁরা শিক্ষা দান করেছেন। শিক্ষাকে মহানব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন পণ্ডিত তথা গুণীজনেরা বিভিন্ন সময়ে লিখে গেছেন। বাঙালি সমাজে, অবিভক্ত ভারতে নারীশিক্ষার বিষয়টা একেবারেই অবহেলিত ছিল। কুসংস্কার হোক অথবা পুরুষ শাসিত  পিতৃতান্ত্রিক সমাজের তথাকথিত অহংকার। আমরা যে ভাবেই দেখি না কেন, নারী শিক্ষার ব্যাপারটা কয়েক দশক আগেও কলকাতার বনেদী পরিবারেরা মেয়েদের কাছে ছিল অন্যায়। তাঁরা রক্ষণশীল পরিবারের পর্দানসীন বনেদী বাড়ির মা, মাসিমা, মেয়ে, বৌ হয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। পুরুষ শাসিত রক্তচক্ষু সমাজে সবরকমের সীমাবদ্ধতা নিয়ে অভিজাত পরিবার ছিল তাঁদের কাছে পুতুল খেলার ঘর। শিক্ষার আলোর জন্য তাঁদের বারদুয়ারে যাওয়া মানে ‘লক্ষণরেখা’ পার হয়ে যাওয়া।
এই নিবন্ধের জন্য আমরা কয়েকজন বিদ্বজ্জনের মতামত নিয়েছি। সেই তালিকায় কবি সুস্মেলী দত্ত আছেন। সুস্মেলী উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে বিখ্যাত লাহা পরিবারের মেয়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার স্নাতক সুস্মেলী দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছেন, তিনি নিজেদের পরিবারে এই অভিঞ্জতার মুখোমুখি হয়েছেন। লাহা, দত্ত, উত্তর কলকাতার এইসব বণিক তথা বনেদী পরিবারের মেয়েদের একটা সময়ে স্কুল কলেজে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঘোষিত নিষেধাঞ্জা ছিল। অবশেষে স্কুল কলেজে পড়ার অনুমতি মিললেও, ‘কো- এডুকেশন’ স্কুল অথবা কলেজে পড়া ছিল বারণ।
সুস্মেলীর নিজের কথায়, ‘বর্ণপরিচয় আমি পড়েছি। কিন্তু আমাদের পরিবারে রক্ষণশীলতার কারণে নারীশিক্ষার ব্যাপারটা অনেকক্ষেত্রেই বাঁধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। তৎকালে মানে উনবিংশ শতাব্দীর মানদণ্ডে পিতৃতান্ত্রিক শাসন এর অন্যতম কারণ। নিজের অভিঞ্জতায় দেখেছি, আমার মায়েরা সে সব দিনের রক্ষণশীলতার মূল্য দিয়েছেন। তাঁদের সময়ে এবং আমাদেরকেও ‘কো-এডুকেশন’ ব্যবস্থা আছে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়তে দেওয়া হয়নি। বাড়িতে নাচ করার অধিকার ছিল কিন্তু বিয়ের পর আর নাচের অনুমতি মিলত না। নারী-পুরুষের তথাকথিত সম্পর্কের বাইরে যে বন্ধু হতে পারে, বিষয়টা আমাদের বাড়ির পুরুষরা বুঝতে চাইতেন না। এই ধরণের অসংখ্য উদাহারণ দেওয়া যায়। বিদ্যাসাগরের নারীশিক্ষা আমাদের মুক্তি দিয়েছে। আমরা কথা বলার অধিকার পেয়েছি বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে। মুক্তির আলো পেয়েছি দয়ারসাগর বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে।‘’   
বিনয় ঘোষ লিখছেন, ‘’আধুনিক পাশ্চাত্য ঞ্জানবিদ্যার সঙ্গে এদেশের ক্লাসিক্যাল সংস্কৃত বিদ্যার যোগসূত্র স্থাপন এবং বাংলা শিক্ষা প্রচলন শিক্ষাক্ষেত্রে এই দুটি হল বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি। তাঁর অন্য কীর্তি হল, এ দেশে স্ত্রী শিক্ষা প্রচলনের চেষ্টা। ১৮৪৯-৫০ সালে ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুনের অন্যতম সহযোগীরূপে তিনি বাংলাদেশে স্ত্রী শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথম পদার্পণ করেন। আগেকার অনেক বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত চেষ্টা সত্বেও স্ত্রীশিক্ষার কোনো সামাজিক অন্তরায় তখনো দূর হয়নি। অথচ হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর প্রায় দুই পুরুষ ধরে আধুনিক পাশ্চাত্য ঞ্জান-বিঞ্জান-সাহিত্যের নিরবিচ্ছিন্ন চর্চা চলেছে।‘’ (বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ-বিনয় ঘোষ, পৃষ্ঠা- ২১১)
কলকাতার বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসের প্রথম সচিব মহঃ মাফাখারুল ইকবাল মনে করেন বাঙালির কাছে বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন আলোক বর্তিকা। তিনি বলছেন, ‘’বাঙালির জন্য বিদ্যাসাগর ছিলেন আশীর্বাদ। ওনার আদর্শিক, সাংস্কৃতিক, এবং চারিত্রিক প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই বিদ্যাসাগরকে বাঙালি এখনও অনুকরণ করে। এবং অনুসরণ করে। বিদ্যাসাগর কখনো আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। বিদ্যাসাগরকে কোনও একক গণ্ডিতে আবদ্ধ করা যাবে না। সারা বিশ্বের বাঙালি তথা মানবজাতি তাঁর আদর্শিক দিকগুলিকে স্মরণ রাখবে। তাঁর মাতৃভক্তি এবং দেশভক্তি উদাহারণযোগ্য।‘’
ইংরেজি সাহিত্যের লব্ধপ্রতিষ্ঠ বাঙালি সাহিত্যিক অমিত চৌধুরীর বক্তব্যেও আমরা সেই সূত্র এবং মূল্যায়ন খুঁজে পাই। তিনি বলছেন, ‘’ওনারমতো আদর্শবাদী এবং উদার মানুষ কম জন্মগ্রহণ করেছেন। নিজের মতের সঙ্গে মিল না হলে সেটা মেনে নিতে পারতেন এবং আলোচনা করতে পারতেন। উনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় রেনেসাঁর দু’জন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মাইকেল মধুসূদন বন্ধু বিদ্যাসাগরকে ছোট করে ‘ভিদ’ বলে ডাকতেন। ‘বর্ণপরিচয়’-এর বাইরেও তাঁর ভালো ব্যবহারের কথা বলতে হয়। এই সব ব্যক্তিদের কথা আমরা যত বেশি আলোচনা করব তত এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের মূল্যবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারব।‘’ 
আমরা এই প্রজন্মের একজনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম ওর কাছে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে। ওর নাম সুমনা চ্যাটার্জী। সুমনা কলকাতার ‘শিবনাথ শাস্ত্রী কলেজ-এর ইংরেজি সাহিত্যের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। সুমনা বলছে, ‘’বাংলা বর্ণমালার মূল রূপকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর অসাধারণ বিবেচনাবোধ এবং বৈঞ্জানিক পদ্ধতিতে গড়ে তোলেন বর্ণপরিচয়। প্রথমে দু’টি বর্ণের শব্দ, তারপর তিনটি, এভাবেই ধীরে ধীরে আ-কার, ই-কার, ঈ-কার এবং তারপর মিশ্র শব্দ। তারপর শুরু হল বাক্য গঠনের সূচনা পর্বের। আস্তে আস্তে একটি শিশু সিঁড়ির মতো এক-একটি ধাপ পেরিয়ে এসে শব্দ শেখে। শেখে তার প্রয়োগএবং সেই শিশু পরিণত হয়ে শেখে ছোট বাক্যের ছোট ছোট প্রাঞ্জল গদ্য রচনা। পাশাপাশি তিনি একজন সমাজ সংস্কারক। পিতামাতার প্রতি তাঁর ঐকান্তিক ভক্তি এবং বজ্রকঠিন চরিত্রবলয় বাংলায় প্রবাদপ্রতিম। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন প্রাচীন ঋষির প্রঞ্জা, ইংরেজের কর্মশক্তি ও বাঙালি মায়ের হৃদয়বৃত্তি।‘’
উনবিংশ শতাব্দীর মানদণ্ডে সেই সময় স্কুলে সম্ভ্রান্ত হিন্দুপরিবারের মেয়েদের ভর্তি নেওয়া যাবে বেথুন এই নিয়ম চালু করেছিলেন। উচ্চবিত্ত হিন্দু পরিবারের মধ্যেই স্ত্রীশিক্ষা সীমাবদ্ধ থাকবে। ইংরেজি শিক্ষার আদলে। এই ব্যবস্থায় বেথুনের সঙ্গে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার আন্তরিকভাবেই সহযোগিতা করেছিলেন বলে ইতিহাসবিদরা মত পোষণ করেন। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থা সাহিত্য অ্যাকাদেমী, ওই সংস্থার কলকাতার আঞ্চলিক সচিব দেবেন্দ্র দেবেশ বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে এই বক্তব্য টেনে মৃদু সমালোচনা করলেন। তিনি বলেন, ‘’শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। আমি বিহারী হিসেবে ‘বর্ণপরিচয়’ পড়িনি। তবে বড় হয়ে যুগপুরুষ বিদ্যাসাগরকে চিনেছি। বিধবা বিবাহ আইনের জন্যও তাকে আমাদের মনে রাখতে হবেশিক্ষা, সংস্কৃতি সমস্ত ক্ষেত্রে তিনি সর্বভারতীয় এবং সার্বজনীন ভূমিকা নিয়েছিলেন। তবে কিছুটা বিতর্কও আছে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের ভাইসরয় বিদ্যাসাগরের কাছে শিক্ষা সংস্কারের বিষয়ে পরামর্শ চেয়ছিলেন। তখন তিনি বলেন তাঁর স্কুলে এবং অন্যান্য স্কুলে শুধু ব্রাহ্মণদের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হোকব্রাহ্মণ না পেলে কায়স্থদের নিয়োগ করতেন। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই কথা বললাম। তবে আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছে সাহিত্য অ্যাকাদেমী থেকে আমরা বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান করব। মেদিনীপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে নভেম্বর মাসে দু’দিনের সেমিনার করার প্রস্তাব আছে।‘’
বিধবা বিবাহ, বহু বিবাহ, এবং বাল্য বিবাহের মতো তথাকথিত সমাজের সামাজিক অধিকারের ব্যাপারে তিনি গর্জে উঠেছিলেন। ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিৎ কিনা তদবিষয়ক প্রস্তাব’ এই বিষয়ে দ্বিতীয় বই, ১৮৫৫ সালে প্রকাশ হয়। এবং এই বই প্রকাশের চোদ্দো মাসের মধ্যে বিধবা বিবাহ আইন অনুমোদন করে ব্রিটিশ সরকার। প্রথম বিধবা বিয়ের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর।    
কবি জয় গোস্বামী বললেন, ‘’আমরা ভাষা শিখেছি বিদ্যাসাগরের কাছ থেকে। মেয়েদের জন্য কাজ, মেয়েদের শিক্ষার জন্য কাজ তাঁকে চিরন্তন করে রেখেছে আমাদের কাছে। বিধবা বিবাহ প্রবর্তন করেছিলেন বিদ্যাসাগরনতুন কাজ করবার জন্যা সমাজে এসেছিলেন তিনি। এঁরা আসেন। সে সময়ের সমাজপতিরা তাঁর কাজকে বুঝতে চাননি। বা বুঝতে পারেননি। সেই কারণে তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। বিদ্যাসাগরেরমতো ব্যক্তিত্ব আমাদের সমাজে আর আসেননি। তাঁকে আমাদের আজও প্রয়োজন আছে। তাঁর দ্বিশতবার্ষিকীতে গবেষণা করে আরও বিস্তারিত বলা যায়।‘’
কবি সুবোধ সরকার বিদ্যাসাগরকে নিয়ে গর্বিত। তিনি বলেন, ‘’বিদ্যাসাগর নিজের সময় থেকে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন। ইংরেজিতে যাকে ‘ভিশানারি’ বলে। তিনি যে ভাবে মেয়েদের বেদনাকে স্পর্শ করেছিলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন, সে ভাবে আজ পর্যন্ত কোনও পুরুষ বুঝতে পারেননি। তিনি মেয়েদের জন্য যা করেছেন শুধু তাঁর জন্যই তিনি অমর হয়ে থাকতে পারতেন, কিন্তু তিনি যে বাংলা গদ্য লিখে গেছেন, তাঁর জন্য তিনি দ্বিতীয়বার অমর হলেন।‘’
আমরা কথা বলেছিলাম অধ্যাপক স্বপন চক্রবর্তীর সঙ্গে? অধ্যাপক চক্রবর্তী কলকাতার ন্যাশন্যাল লাইব্রেরির ডিরেক্টর জেনারেলের দায়িত্বে ছিলেনপরে তিনি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ডিস্টিংগুইশট’ মানবিকী বিদ্যার চেয়ারের পদে ছিলেন। চলতি বছরের ৩১ জুলাই অধাপক স্বপন চক্রবর্তী কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন।
তিনি তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘’ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আধুনিক ভারতীয় এবং আধুনিক মানুষ ছিলেন বললে কিছুই বলা হয় না। তাঁর সব উদযোগের পিছনে ছিল এক বিজিত জাতির নারী-পুরুষের অবসিত বিষয়ীসততা এবং স্বাভীপসার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এই উদ্দ্যেশ্যে তিনি যেমন শাস্ত্রের সমর্থন জোগাড় করেছিলেন, তেমনই বিদেশী শাসকদের আইন-সংস্কারের একরকম বাধ্য করতে পেরেছিলেন। বিধবা বিবাহ প্রচলন, আধুনিক পাঠ্যক্রমের প্রবর্তন, নারীশিক্ষার প্রসার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, পাঠ্যপুস্তক রচনা, মুদ্রণ ও প্রকাশনার বাণিজ্যে বিনিয়োগ, বর্ণমালা ও ভাষার সংস্কার—তাঁর সমস্ত প্রকল্পের গতিমুখ ছিল পরাসৃত দেশের ব্যক্তিমানুষকে মুক্ত বিষয়ী করে তোলা, আপন ইতিহাস নির্মাণে অধিকারী বলে প্রতিপন্ন করা। বিদ্যাসাগর আমাদের চিন্তামুক্তির সাধনায় জাতিসত্তা নির্মাণের সাধনায় এ কারণেই এক অগ্রপথিক। এ কথা না বুঝলে তাঁর ত্যাগ ও করুণা কেবলমাত্র সদাশয়ের হিতাকাঙ্খায় সীমাবদ্ধ বলে মনে হবে।‘’
কবি, অনুবাদক, ফরাসী ভাষার অন্যতম ভারতীয় অনুবাদক অধ্যাপক চিন্ময় গুহ শুরুটাই করলেন দুঃখ, কষ্ট এবং বেদনার সমন্বয় করে। তাঁর মা অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি আছেন তাইতে তিনি বিদ্যসাগরের কাছে আশ্রয় খুজলেন। বললেন, ‘’আমার মা অসুস্থ, এইসময় বিদ্যাসাগরের কথাই বেশি করে মনে পড়ছে। আমরাতো কেউই জীবন ও কর্মকে তাঁর মতো করে মিলিয়ে দিতে পারিনি। তাঁর মতো করে এক তরঙ্গ দ্রাঘিমায় মিলিয়ে দিতে পারিনি। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, তিনি শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের যে কাজ শুরু করেছিলেন, তা শেষ হয়নি। তাঁর দৃষ্টির সামনে আমাদের কারও দাঁড়ানোর যোগ্যতা নেই।‘’
বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, মানবতাবাদী লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলছেন, বিদ্যাসাগর এমন একটি ব্যক্তিত্ব যার সঙ্গে অন্যদের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ তিনি ছিলেন সর্বার্থে একজন পূর্ণ মানুষ। জনপ্রিয় সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘’বিদ্যাসাগর এমন একটি চরিত্র যার সঙ্গে বাঙালির চরিত্র মেলে না। এত দৃঢ়চেতা, সময়নিষ্ট ও এতো ব্যক্তিত্বসম্পূর্ণ মানুষ বাঙালির মধ্যে তেমনটা আর নেই। তার ওপরে তিনি যেমন দানশীল ছিলেন, তেমনি অন্যদিকে ছিলেন যুক্তিবাদী, বাস্তব ঞ্জানসম্পন্ন একজন পূর্ণ মানুষ। বিদ্যাসাগর নিজে খুব নিয়মনিষ্ঠ জীবনযাপন করতেন। এবং তিনি একজন সংযমী মানুষ। আবার অন্যদিকে বন্ধু মাইকেল মধুসূদন দত্তকে কতবার সাহায্য করেছেন তার হিসেব নেই। শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে যাঁদের বুঝি তাঁদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অবশ্যই একটি দৃষ্টান্ত।‘’       
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসগর তাঁর চরিত্রের স্বাতন্ত্রতা, বলিষ্ঠতা এবং মহত্ব তিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। এমনটা দাবি করেন আধুনিক ইতিহাসবিদেরা। তাঁর মননের উদাহারণ আমরা পাই গোপাল এবং রাখালের গল্পে। গোপাল যেমন সুবোধ বালক, রাখাল তেমনটা একদমই নয়। রাখালকে আমরা দুষ্টু ছেলে হিসেবে পাই বিদ্যাসাগরের কলমে। কিন্তু তিনি রাখালের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বেশি কিছু বলেননি। বলতে চাননি। কারণ সম্ভবত মানুষ যে অবস্থানেরই হোক, যতই ছোট হোক, তবুও সে মানুষ। রাখালদেরও আত্মসম্মানবোধ আছে। যে কোনও মানুষকে অপমান করলে বিদ্যাসাগর রেগে যেতেন। তাঁর উপলব্ধি ছিল, রাখালদেরমতো দুষ্টু বালকদের আত্মচেতনা জাগিয়ে তোলার কাজ আমাদেরই করতে হবে। সেই কাজও বিদ্যাসাগর সাবলীলভাবে করতে চেষ্টা করেছিলেন। আলোকিত দার্শনিকের সেই পথের সন্ধানে বন্ধ হয়ে থাকা জানলাগুলো সত্য উত্তর সময়ে খুলে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরই 
(এই লেখাটি ২২ সেপ্টম্বর, ২০১৯ তারিখে লেখা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখপত্র ‘পশ্চিমবঙ্গ’ (বাংলা) বিদ্যাসাগর সংখ্যায় প্রকাশিত)            
                                           


Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?