উত্তর আপনাকে এবং আপনাদের দিতে হবেই




দীপেন্দু চৌধুরী
আমরা প্রস্তুত আপনাকে অভিনন্দন জানাতে। স্বাগত জানাতে। ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে আপনাকে সহিষ্ণু ভারতের সামিয়ানার নীচে, বহুবর্ণ প্রাঙ্গণে পুষ্পবৃষ্টি সহযোগে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারত সরকার। ট্রাম্প সাহেব আপনাকে বলছি। আমরা ৭০ লক্ষ কেন কয়কে কোটি ভারতবাসী আপনার মত ব্যক্তিত্বকে সাদরে এবং সসম্মানে বরণ করে নিতে প্রস্তুত। কারণ আমরা ভারতীয়রা ঐতিহ্যগতভাবে অতিথিবৎসল। মোদিজি আপনাকে ভারতের তিনটে বিশেষ স্থানে নিয়ে যাবেন। গাঁধিজির স্মৃতি মন্থন করতে আপনাকে নিয়ে যাবেন সাবরমতি আশ্রমে। আপনি যাবেন আগ্রায়। প্রেমের স্মারক সমাধী তাজমহল দেখতে। এবং দিল্লিতে কেজরিবাল সরকারের পরিচালনায় একুশ শতাব্দীর ভারতে সরকারি স্কুল দেখতে যাবেন আপনি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, আপনি ভারতের সঙ্গে ‘বাণিজ্য চুক্তি’ বাতিল করতে চাইলেন কেন? ভারতে এমনিতেই চাকরির আকাল। আপনারা বিনিয়োগ করলে আমরা চাকরি পাই। এই বিষয়টা একবারও আপনি বা আপনার উপদেষ্টামণ্ডলী ভেবে দেখলেন না। আপনার বাণিজ্য সচিব আপনার সফরের আগে প্রস্তাবিত ভারত সফর বাতিল করলেন কেন? এসব প্রশ্ন তোলাটা কি অন্যায় হবে? বাতুলতা হবে? দক্ষিণপন্থী বিজেপি সরকার বর্তমান মার্কিন সরকারের দোসর বলেই আমরা জানি। তবু কেন আপনি ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করলেন? তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আপনাদের বাধ্য প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। উদার অর্থনীতির যে ভিত অর্থনীতিবিদ ডঃ মনমোহন সিংহ তৈরি করেছিলেন ভারতসহ ভারতীয় উপমহাদেশে সেই বনিয়াদ কি অটুট নেই? তা না হলে ভারতীয় বণিকসভাও বিনিয়োগ করতে চাইছে না কেন? দেশের বৃদ্ধির হার তলানিতে। সেই সময় আপনি এলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পআপনার কাছে হয়ত যোগী আদিত্যনাথ এই বার্তা পৌঁছে দেবে। সোনভদ্রে সোনার খনি পাওয়া গেছে। এবার ভারতীয় অর্থনীতি নিজের পায়ে দাঁড়াবে। 
ভারতের ঐতিহাসিক সার্বজনিক সংবিধান আপনাদের দেশের বৃহত্তম এবং উদার গণতন্ত্রকে সামনে রেখেই বাবাসাহেব অম্বেদকর,পণ্ডিত নেহরু সহ কয়েকজন সংবিধান বিশেষঞ্জ রচনা করেছিলেন। ভারতের বহুচর্চিত সেই সংবিধান আজ আহত। ব্যথিত শুধুমাত্র এবং নিছক এক ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’ স্লোগানে। এই স্লোগানকে বাস্তবায়িত করার বর্তমান সরকারের অ্যাজেন্ডায় বা কর্মসূচীতে।
ধর্মনিরপেক্ষ আমেরিকা এবং ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষ। মিশ্র সংস্কৃতির দুটো দেশ। আমাদের দুই দেশের মিল এখানেই। বৈচিত্রের দেশ বলেই আমাদের দেশে ‘দোল যাত্রা’, ‘হোলি উৎসব’-র মতো উৎসব আমরা পালন করি। আমেরিকা এবং ভারতেরমতো দুই দেশের  সম্মিলিত সংগীতকে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ এবং আপনার পূর্বসূরী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একটা উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আম নাগরিকের কথা মাথায় রেখে। ২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দার কবল থেকে বিশ্ব অর্থনীতিকে উদ্ধার করেছিলেন দুই দেশের প্রধান দুই শাসক। ভারতে নয়া নাগরিকত্ব আইন পাস হওয়ার পর সিএএ, এনআরসি নিয়ে দেশ উত্তাল। ভারতের সংবাদমাধ্যম অনুমান করছে, আপনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মুখোমুখী বৈঠকে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার’ প্রসঙ্গ তুলবেন। ব্যস এটাই আপনার দায়িত্ব? বিশ্বের উন্নত তথা আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপতি আপনি। অথচ আপনি নিজেকে আড়াল করছেন। আড়াল করছেন আপনার দেশের উদার কণ্ঠস্বরকে। ভারত সরকার ভারতের দারিদ্রকে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে এবং বহুমতকে আপনার থেকে আড়াল করছেন। ভারত সফরে এসে আপনি ট্যুইট করেছেন,
Our two national constitutions both begin with the same three beautiful words: “We the people.” That means that in America and India alike, we honor, respect, trust, empower, and fight for the citizens we proudly serve!
বর্তমান সফরে আপনার প্রয়োজন মাত্র ৭০ লক্ষ ভারতীয় নাগরিক। অথচ একবার ভেবে দেখুন ট্রাম্প সাহেব আমরা ১৩০ কোটি বহু ভাষাভাষীর ভারতীয় আপনাদের দেশের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যনীতির সমর্থক। উদার গণতন্ত্রের সমর্থক, উদার অর্থনীতির সমর্থক। আমরা জানি এই বছর আমেরিকায় ভোট। আপনার প্রয়োজন অনাবাসী ভারতীয়দের ভোট। তারপরেও আটলান্টিক মহাসাগর দিয়ে স্বচ্ছ অস্বচ্ছ জল প্রবাহিত হবে। আর আমাদের দেশে বিজেপির প্রয়োজন আপনার সমর্থন। তবু কি স্বচ্ছ ভারতের স্লোগান সফল হবে? ‘স্মার্ট ইন্ডিয়া’, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ সফল হবে? আমরা কি চাকরি পাব? আপনি কি জানেন আমাদের দেশের এমএ, এমবিএ পাস ছেলেরা সাফাইওয়ালা পদে চাকরির জন্য আহুত ইন্টারভিউতে বসছে? এটা আমাদের ট্রাজেডি। আপনি এই রকম একটা সময়ে সফরে ভারতে এলেন। আপনি জানেন আপনাকে এই বিষয়ে কোনও কৈফিয়েত দিতে হবে নানা উত্তরও আপনাকে দিতে হবে না।   
আমাদের কাছে অঙ্ক সোজা মনে হচ্ছে কেন? আপনি জানেন? ভারতের আম নাগরিকের দায়িত্ব তাহলে কারা নেবে? উত্তর আপনাকে দিতে হবেই মাননীয় ট্রাম্প সাহেব সহিষ্ণু ভারত এবং মার্কিন নাগরিক একসঙ্গে আবৃত্তি করছে, আমরা বৃহত্তম বিশ্বের সহ-নাগরিক। পদাতিক কবির মিছিলের ফুটপাথ আমাদের এক আকাশের নীচে হাঁটতে বলে। উত্তর নরেন্দ্র মোদিকেও দিতে হবে। কারণ দিল্লির শাহিনবাগ, কলকাতার পার্কসার্কাস সেই পথের কথা আমাদের জানান দিয়েছে। সভ্যতার নতুন নতুন পৃষ্ঠা এভাবেই আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায় পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।        

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?