নাগরিক মিছিলের শঙ্খনাদ আহ্বান
দীপেন্দু চৌধুরী সম্প্রতি তৃণমূলকংগ্রেসনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যবাসীকে আবারও মনে
করিয়ে দিয়েছেন যে, সিপিএম এবং কংগ্রেস একজোট হওয়ার কারণে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়েছিল। ইতিহাস এই অভিযোগ অথবা এই সত্য আগেও মেনে নিয়েছে বর্তমানেও
মেনে নেয়। ভবিষ্যতেও মানবে। ভারতের রাজনৈতিক সমাজ অথবা রাজনীতি সচেতন নাগরিক এই
তথ্যের সঙ্গে একমত। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে তৃণমুল কংগ্রেস গঠনের প্রাক সময়কালটা একটু
পিছন ফিরে দেখা যাক।
সালটা ১৯৯৭। প্রদেশ কংগ্রেসে তীব্র গোষ্ঠীদ্বন্দের আঁচ দিল্লিতে
হাইকমান্ডের কাছে পৌঁছেছে। তৎকালীন ভারতীয় ১১৩ বছরের কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরেও চলছে
গোষ্ঠীদ্বন্দ। রহস্যমাখা দুর্বোধ্য অবস্থান
থেকে এগিয়ে আসছেন সনিয়া গাঁধি। এই ধরণের ঘটনা যে ঘটতে পারে ১৯৯৭-এর ডিসেম্বর
পর্যন্ত কংগ্রেস দলের কেউ বুঝতে পারেননি। অন্তত আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের
কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দে অন্তঃপুরবাসিনী সনিয়া গাঁধী সরাসরি হস্তক্ষেপ করবেন এটা
বাংলারও কেউ অনুমান করতে পারেননি।
স্বভাববিরোধী এই অবস্থান নিয়ে সনিয়া গাঁধী মমতার বিষয়ে কিছুটা উপযাচক হয়েই
এগিয়েছিলেন। কারণ ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গে দলের ভাঙন আটকাতে। সনিয়া গাঁধীকে এই
ভূমিকা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন এই রাজ্যের দুই হেভিওয়েট কংগ্রেসি নেতা। তারা
হলেন অজিত পাঁজা এবং সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। এই দু’জনে আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন কংগ্রেস
দলটা যেন না ভাঙে। বিভিন্ন নেতার মধ্যে সমীকরণ ভিন্নতর হতে পারে। আমি নির্দিষ্ট
একজন কংগ্রেসি নেতা অথবা গোষ্ঠীর হাতে তামাক খেয়ে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করছি না।
সময়কাল এবং ঘটনার পরম্পরা তুলে ধরাটাই একজন নিরপেক্ষ কলমচি অথবা প্রতিবেদকের কাজ।
সেই কাজটা করার এ এক অক্ষম প্রয়াস।
কংগ্রেস এবং সিপিএমের জোট বা সখ্যতা আজকের নয়। ইতিহাস আরও অধিক সংযোজন করে।
১৯৬৪ সালে সিপিআইএমের জন্মলগ্ন থেকে কংগ্রেসের রাজনৈতিক অবস্থানের মানদন্ডে সিপিএম
কংগ্রেসের সঙ্গে পথ চলা শুরু করেছে। সিপিআই তারও অনেক আগে থেকে এই পরিক্রমার
অন্যতম অংশীদার। কংগ্রেস নামক একটি সর্বভারতীয় শতাব্দীপ্রাচীন দল প্রয়োজনমতো
রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বামেদের সঙ্গে এক মঞ্চে এসেছে। কারণ তৎকালীন জনসংঘ এবং
বর্তমানের বিজেপি দল এবং তার আদর্শকে আটকাতে। এক কথায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে
প্রতিরোধ করতে কংগ্রেস বামেদের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা করেছে। ধর্মনিরপেক্ষ দল
হিসেবে।
১৯৬৬ সালে দেশের গভীর এক সঙ্কটের সময় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে
গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছিল। সেই ঘটনা বাদ দিলে মার্ক্সবাদী কমিউনিষ্ট পার্টির
জনগণতন্ত্র থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে চলে আসার মূল্যায়ন সম্ভব নয়। ১৯৬৬ সালের ১২
জানুয়ারি তাসখন্দে প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুর পর কংগ্রেস
দলের অভ্যন্তরে ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়ে মোরারজী দেশাই
নিজের দাবি রাখেন। কংগ্রেস হাইকমান্ড এমন একজনকে চাইছিলেন যার রাজনৈতিক ইমেজ আছে। এর
পরেই হাইকমান্ড সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে দাড়িয়ে ৩৫৫-১৬৯ ভোটে প্রকাশ্য
প্রতিযোগিতায় মোরারজী দেশাইকে হারিয়ে ইন্দিরা গাঁধি ১৯৬৬ সালের ২৪ জানুয়ারি ভারতের
তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই ইন্দিরা গাঁধি ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করেন,
এবং রাজন্য ভাতা বিলোপের সিদ্ধান্ত নিলেন। সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচীর মাধ্যমে সিপিআই
এবং সিপিএমের সমর্থন আদায় করলেন। ১৯৬৯ সালে সিপিআই ‘প্রগতিশীল’ ইন্দিরার সঙ্গে
প্রত্যক্ষ শ্রেণী- সহযোগিতার লাইনের প্রসঙ্গের কথা বলল। ১৯৭০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি
সিপিএমের মুখপত্র পিপলস ডেমোক্রাসি সংখ্যায় লেখা হল, ‘’ইন্দিরা গাঁধি অংশের মধ্যে
একটি সুস্থ ধারা বর্তমান। তারা বৃহৎ জমিদার ও একচেটিয়া পুঁজিপতিদের ঘৃণা করে.........এই
অংশ জনগণের একচেটিয়া পুঁজিবিরোধী আশা আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কতকগুলি
শ্লোগান তুলেছে বা ব্যবস্থা নিয়েছে।‘’
এই দু’টি উদাহারণ থেকে আমরা কংগ্রেসের সঙ্গে বামপন্থীদের সখ্যতার বিষয়টা
প্রাসঙ্গিক হিসেবে দাবি করতে পারি। রাজনীতির চোরাস্রোতে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক
দলগুলির নীতি এবং কৌশল সাধারণ মানুষ সহজেই অনুধাবন করতে পারলেও বামপন্থী দলগুলির
নীতি এবং কৌশল বুঝতে তাদের অনেকটা সময় লাগে। যেমন সাম্প্রতিক উদাহারণ এক দুই তিন
চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের উপর থেকে বামেদের সমর্থন তুলে নেওয়ার
ঘটনা। ২০০৯ সালে সমর্থন তুলে নেওয়ার পরে সিপিএম দল আড়াআড়িভাবে দু’ভাগে ভাগ হয়ে
গিয়েছিল। বিশেষত কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে আদৌ আন্দোলন করা সম্ভব কিনা এই প্রশ্নে। অবশেষে
সীতারাম ইয়েচুরি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরে সিপিএম ভাঙ্গা ঘর
গুছিয়ে তুলতে চাইছে। বন্ধ দরজা নয় কুঠুরি খুলে ভোরের আলো আনতে চাইছে দলে। এবং
ভারতীয় সমাজে। বিশেষত আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে।
৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে ২০১১ সালে কংগ্রেস এবং তৃণমূলকংগ্রেসের জোটের
কাছে পরাজিত হয়ে বামেরা অথৈ জলে পড়ে। দিশাহীন নাবিকেরমত আলোর খোজ করতে থাকে। বন্ধ
ঘরের দরজা খুলে আলো দেখতে চায়। সিপিএম দলের নেতৃত্বে বামপন্থীরা এই সেদিন পর্যন্ত
গাঁধি, রবীন্দ্রনাথ, নেতাজীকে স্বীকৃতি দিতে চাইত না। বিভিন্ন বিশেষণ বরাদ্দ ছিল
এই সব বরেণ্য মনিষীদের জন্য। অথচ ১৯৫৪ সালে হো-চি-মিন বলেছেন, ‘’গাঁধিজি, তিনি তো
আমাদের সকলের গুরু। এশিয়া ভূখন্ডে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মুক্তি সংগ্রামে,
......মূর্ত করার কাজে গাঁধিজি আমাদের পথপ্রদর্শক।‘’ ফরাসি দার্শনিক রোমা রোঁলা
বলেছেন, ‘’হে রবীন্দ্রনাথ! হে গাঁন্ধিজি! ভারতের সিন্ধু-গঙ্গা দুটি নদী। পূর্ব ও পশ্চিমকে যুগল
আলিঙ্গনে আবেষ্টন করেছেন আপনারা। প্রথমজন আপনি আলোর স্বপ্ন। দ্বিতীয়জন আপনি মহাত্মা,
আত্মোৎসর্গ ও সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি। আপনারা উভয়ে ভগবানের আত্মজ। আজ হিংসার
হলাঘাতে জর্জরিত বিচ্ছিন্ন পৃথিবী, তার বুকে আপনারা বিধাতার বীজ বপন করুন।‘’
৩০ জানুয়ারি গাঁধিজির প্রয়াণ দিবসে একসঙ্গে দেখা গেল বাম এবং কংগ্রেস দলের
নেতৃত্বকে। মিছিলের ভিড় ছিল চোখে পড়ারমতো। গাঁধির
মৃত্যুদিবসে এন্টালির রামলীলা ময়দান থেকে বেলেঘাটার গাঁধি ভবন পর্যন্ত মিছিলে
শামিল হয়েছিল বামফ্রন্টের দলগুলি। এবং আরও ১৭টি বামদল। সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস। এই
১৮ দলের সঙ্গে মিছিলে যোগ দিয়েছিল ওয়েলফেয়ার পার্টি অব ইন্ডিয়া (ডব্লিউপিআই)।
উল্লেখ করতে হয় গাঁধিজির দেড়শো বছর পূর্তিতে প্রথম বার বিধান ভবনে গিয়েছিলেন
বামফ্রন্টের রাজ্য নেতৃত্ব। দ্বিতীয়বার বামফ্রন্টের নেতৃত্ব এই মহা মিছিলে
অংশগ্রহণ করে বর্তমান সময়কে স্বীকৃতি দিলেন। গাঁধির মৃত্যুদিবসে সংবিধানের
ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ রক্ষার দাবি এবং বিভাজনের রাজনীতির প্রতিবাদে ছিল এই মিছিল।
আড়ে বহরে ঠাসা এই মিছিলে প্ল্যাকার্ড হাতে মিশে যাওয়া মানুষের শঙ্খনাদ আওয়াজ
শুনলাম সেদিন। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) মানছি না মানব না। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি)
মানছি না মানব না।
Comments
Post a Comment