সামাজিক তর্পণে বর্তমান সময়েও গাঁধীজী চিরন্তন


দীপেন্দু চৌধুরী 
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তথা কংগ্রেস নামক দলের ইতিহাসে সবচেয় গুরুত্ব দিতে হয় তিনজন প্রথম সারির ব্যক্তিকে। তিনজন ব্যক্তি ছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গাঁধী, জওহরলাল নেহরু এবং সুভাষচন্দ্র বসু। মা ডাকতেন- মনিয়া। বাবা বলতেন মনিসেই মনি বা মনিয়া হয়ে উঠলেন মহাত্মা, বন্দিত হলেন দেশের পিতা হিসেবে। বর্তমান একুশ শতাব্দীতেও তিনি সমান প্রাসঙ্গিক। নিঃসন্দেহে হিংসার প্রশ্নে তাঁর চিন্তাধারা আজও সমান প্রাসঙ্গিকনিম্নবর্ণের মানুষ আক্রান্ত হলেই জেনে হোক অথবা না জেনে তাঁর চিন্তাধারায় আশ্রয় খোঁজে। ওই অর্ধনগ্ন দেহের একজন মানুষের কাছে ছুটে ছুটে যায়। আমার এক স্কুলের শিক্ষক আমাকে বলেছিলেন, ‘ভেবে দেখেছিস কখনো? গাঁধীজী একজন ব্যারিস্টার মানুষ। যেমন তেমন ব্যারিস্টার নন। বিলেত থেকে পাশ করে আসা ব্যারিস্টার। সেই মানুষ, হেটো ধুতি পড়ে হাতে একটা লম্বা লাঠি নিয়ে দেশের এপ্রান্ত থেকে সে প্রান্ত ছুঁটে চলেছেন। কি করে সম্ভব? ভেবে দেখ।’ আমি সত্যি সত্যি আজও ভাবি। ভারতের আত্মা চিনে ছিলেন তিনি। আউল, বাউল, ফকির, সুফি, সাধুসন্ন্যাসীদের দেশ ভারতবর্ষ। তৎকালে দেশের নিম্নবর্ণের মানুষ বছরে একবার অথবা দু’বার জামা পড়তেন। বাড়িতে কোনও উৎসবে অথবা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে। এই সংস্কৃতি তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। শুধুমাত্র এই একটা কারণই নয়। নিজের লব্ধ ঞ্জানের উপলব্ধি ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলো বলেই মনে হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকার সময় তিনি অনুভব করেছিলেন খেটে খাওয়া মানুষের হ্রদয়ে পৌঁছতে গেলে তাঁদের নিজেদের লোক হতে হবে। তাঁদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে হবে। গাঁধীজীর রাজনীতিতে আবির্ভাব হয়েছিল গত শতব্দীর দ্বিতীয় দশকে। দক্ষিণ আফ্রিকার সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সযত্নলালিত আপন চর্চা তাঁকে গণদেবতার আসনে বসিয়ে ছিলদক্ষিণ আফ্রিকার প্রেক্ষাপটটা কী ছিল? সেই দেশের নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস মূলত সেখানকার ব্যাবসায়ীরা নিজেদের দাবি সমূহ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে পেশ করত। নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেসের মাধ্যমে। এই ব্যাসায়ীরা অবশ্যই ছিলেন ভারতীয় এবং বিত্তবান। খেটে খাওয়া শ্রমিকশ্রেণীর এই সংগঠনের সদস্য হবার অধিকার ছিল না। সেই বিষয়টা গাঁধীজীকে ভাবিয়ে থাকতে পারে। তিনি ভারতে ফিরলেন এমন একটা সময়ে যখন কংগ্রেসের হাল ধরার মতো কেউ নেই। যে ব্যক্তি ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারবে আবার দেশের স্বাধীনতার দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবেন। এইরকম এক সন্ধিক্ষণে তিনি ভারতে এলেন আট বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় আন্দোলন করে ১৯১৬ সালে তিনি ভারতে এলেন। ভারতে একদিকে খিলাপৎপন্থীরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলছে। পাশাপাশি কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বাধীনতার আওয়াজ উঠছে। দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট, ব্রিটিশপ্রভুর অত্যাচারে জর্জরিত ভারতীয়রা স্বাধীনতার দাবিতে উদ্বেল হয়ে উঠছে। ভারতের এই গণআন্দোলন গাঁধিজীর জন্য প্রেক্ষাপট তৈরি করেই রেখেছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকার সীমিত এবং নিয়ন্ত্রিত গণআন্দোলনের অভিঞ্জতা ভারতের আন্দোলনে কাজে লাগাতে তিনি সচেস্ট হলেন। অভিঞ্জতা থাকলেই গণআন্দোলনের রাশ ধরা যায় না। প্রয়োজন হয়ে থাকে আরও কয়কটি বিষয়। এর মধ্যে অন্যতম উল্লেখিত নেতৃত্বের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির। যেটা গাঁধীজী সযত্নে গড়ে তুলেছিলেন। ফলে তিনি ভারতীয় রাজনীতিতে দ্রুত জায়গা করে নিলেন। পরিসর আগে থেকে তৈরিই ছিল। সঙ্গে তিনি যুক্ত করতে পারলেন নিজের সাধারণ অর্ধউলঙ্গ পোশাক, পায়ে খড়ম, আকর্ষনীয় সরল সাধারণ জীবনযাত্রা। এবং ভারতীয় প্রথম সারির ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির মিশ্রণ ঘটাতে সহায়ক হয়ে উঠলেন তিনি। ধর্ম এবং রাজনীতির এই সমন্বয় তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজেই গ্রহণ যোগ্য করে তুলল। ভারতের প্রান্তিক মানুষ, নিম্নবর্ণের মানুষ যাদের অচ্ছুৎ করে রেখেছিল সমাজের উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় শ্রেণী। গাঁধীজী তাঁদের কাছে ‘মিথ’ হয়ে গেলেন। ভারতের নিরন্ন, খেটে খাওয়া মানুষ মোহাবিষ্টের মতো তাঁর গড়ে তোলা আদর্শ, মঞ্চ, আন্দোলন, চরকা, আশ্রমে ভিড় জমাতে থাকলেন।
বিহারের চম্পারন এবং গুজরাটের খেদায় দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা কৃষক আন্দোলনের পাশে থেকে আন্দোলনের সাফল্য আনতে সাহায্য করলেন। এই দু’টি ঘটনা তাঁকে দেবত্বে উত্তীর্ণ করতে সফল হল। পরাধীন ভারত পেল তাঁর নেতা। এরপর আমরা পেলাম তাঁর সেই বিখ্যাত অসহযোগ আন্দোলন। ১৯২০-২১ এবং ১৯৩০-৩১ এর আইন অমান্য তথা অসহযোগ আন্দোলন কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো উথালপাথাল রূপ নিয়েছিল। ঐতিহাসিকরা বলছেন ‘স্বরাজ’ নামক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের জন্য দেশ প্রস্তুত ছিল না। ভারতীয় বুর্জোয়াদের স্বার্থ দেখা এবং দেশের ধর্ম-বর্ণ সহ একাধিক সম্প্রদায়ের স্বার্থ দেখাটা প্রকৃত নেতার কাজ ছিল। সেই কারণে তিনি অনেক সময় দ্বিধায় ছিলেন। আন্দোলনের রাশ যাতে লাগাম ছাড়া না হয়ে যায় এই বিষয়টা সম্ভবত ব্যক্তি এবং ব্যরিস্টার মোহনদাসকে ভাবতে হয়েছিল। এই কারণেই কী তিনি ব্রিটিশ শাসনের মধ্যে থেকে ভারতীয়দের হাতে কিছু ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে ছিলেন? ১৯২১ সালের কংগ্রেস অধিবেশন, ১৯২৭ সালের মাদ্রাজে কংগ্রেসের অধিবেশন এবং ১৯২৮ সালের কলকাতা অধিবেশনেও তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু এক বছর পরে তিনি উপলব্ধি করছেন ভারতের গণজাগরণকে আর উপেক্ষা করা যাবে না। ১৯২৯ সালের লাহোর অধিবেশনে নিজেই পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করছেন। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ ভারত ছাড়ো আন্দলনের ডাক দেশের একমাত্র এবং অদ্বিতীয় নেতা মহাত্মা গাঁধী নিজেই দিচ্ছেন। অনাহার অনশন মানুষের বলে সভ্যতা জেনেছিল। তিনি সেটাকেই হাতিয়ার করে এগিয়ে আস্তে থাকলেন। অহিংসার সেই মহামন্ত্র বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বের মানুষের আন্দোলনের প্রধান অস্ত্র। মহাত্মা গাঁধীকে নিয়ে সারা বিশ্বে নতুন করে বিশ্লেষণ হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে। অবশ্যই নতুন করে মূল্যায়ণ প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে ভারতে গাঁধীজীর মতো গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তির আবারও প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
এটাও চরম সত্য যে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট ভারতের স্বাধীনতার দিনে গাঁধীজীর অনশন আর গীতা পাঠের মধ্য দিয়ে দিন শুরু করেছিলেন। মনুবাহেন গাঁধী জানতে চেয়েছিলেন, এমন দিনে তিনি উপবাস কেন করছেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন পুণ্যদিনেই মানুষ উপবাস করে। কারণ তাতে শরীর সুস্থ থাকে। কেউ কেউ উল্লেখ করেন, না সেটা একমাত্র কারণ নয়। খুব সম্ভবত তিনি নীরবে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন। তিনি দেশ ভাগ মেনে নিতে পারেননি। ‘স্বদেশ’ বলতে বুঝতেন আর্থসামাজিকভাবে উন্নত একটি রাষ্ট্রে সব ধর্ম, সব বর্ণ, সব জাতি এক সঙ্গে থাকবেন। সেটাকেই আধুনিক উন্নত গণতন্ত্র বলে। এই শিক্ষা, সংস্কৃতি তিনি যেমন সনাতন ভারতের গ্রাম সমাজ থেকে পেয়েছেন। পাশাপাশি শিল্প বিপ্লবের পরে ইউরোপের যে আলো ভারতে এসে আছড়ে পড়েছিল। যেটাকে আমরা উনবিংশ শতাব্দীর রেঁনেশা বলি। এই সময়ের একটু আগে পরে রাজা রামমোহন রায়, কালীপ্রসন্ন সিংহ, হেনরি লুই ডিরোজিও, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একঝাঁক বাঙালি তথা ভারতীয় দেশ গঠনের জন্য কাজ করে গেছেন। গুজরাটের ছোট্ট মনিয়াও (গাঁধীজীর মা ডাকতেন) একদিন ওইসব মনীষীদের পথ অনুসরণ করে মহাত্মা হয়ে উঠলেন।
মুনিয়াকে আমরা মহাত্মা বলে সম্বোধন করতে পারি কিন্তু এটাও সত্যি তিনিও মানুষ ছিলেন। গাঁধীর মতে অথবা তাঁর দর্শনে ব্যক্তির ভূমিকা সংগঠনের চেয়েও বড়। গাঁধি কোনও অবস্থাতেই একজন ব্যক্তিকে তাঁর ভূমিকা থেকে রেহাই দিতে চাননি। একজন ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে পৌঁছতে চেয়েছেন তিনি। একজন ব্যক্তির বিকাশ সম্ভব হলে তবেই সমষ্টির বিকাশ সম্ভব। আধুনিক গণতন্ত্রও সম্ভবত সেই আধার খোঁজে। আধুনিক ভারতের আধুনিক সংস্কৃতি, তথ্যপ্রযুক্তি, সামাজিক ভারসাম্যকে মান্যতা দিতে মুনিয়া বা মহাত্মা গাঁধীকে ভারতের খুব প্রয়োজন। ইতিহাস বলছে, পণ্ডিত নেহরু ছিলেন গাঁধীজীর সব থেকে কাছের মানুষতাই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশ গঠন প্রভৃতি বিষয়ে তাঁদের মধ্যে যেমন মতের মিল হয়েছে, সভ্যতার নিয়ম মেনে মতের অমিলও হয়েছে। তবু গাঁধীজী কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে মতিলাল নেহরুর সামনে ছেলে জওহরলালের নাম প্রস্তাব করেছেন কংগ্রেস অধিবেশনে।
পরিশেষে বলা যায়, ইতিহাসবিদ, গাঁধী বিশেষঞ্জরা আগামীদিনে ব্যক্তি গাঁধী, পারিবারিক গাঁধী, রাজনৈতিক গাঁধী এবং সামাজিক গাঁধীর বিভিন্ন দিক উন্মোচন করবেন। সেইসব লেখায় ব্যক্তি গাঁধী এবং মহাত্মা গাঁধীর দ্বান্দিক বিকাশ, ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে পারিবারিক জীবনের টানাপড়েন আরও বিস্তারিত সামনে আসবে। কয়েক দশকের তাঁর ব্যপক কর্মকান্ডের কতটা আর আমরা জানি?                                   

 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?