দুয়ার খুলে জেগে আছে পাড়া
দীপেন্দু চৌধুরী
নতুন বছর ২০২০ নাকি একটা নতুন যুগের সূচনার বছর। এমনই দাবি জ্যোতিষবিঞ্জানীদের।
ডিসেম্বরের বড় দিনের উৎসবের পরে সারা বিশ্ব অপেক্ষায়
থাকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যরাতের জন্য। সন্ধ্যে থেকে শুরু হয়ে যায় রঙিনআলোয় উদ্ভাসিত
রাস্তায় ভিড়, গির্জার ঘণ্টাধ্বনি, হোটেল-রেস্তরায় অপেক্ষা। ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’
উন্মাদনার। পুরনোকে বিদায় জানিয়ে নতুনের আহ্বান। নতুন বছরকে
আলিঙ্গন করে নতুন পরিকল্পনা, নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছোট্ট শিশুরমতো হাঁটতে শেখা। কিন্তু
আমাদের দেশ ভারতে নতুন বছর এল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)-এর বিরুদ্ধে
প্রতিবাদের শঙ্খনাদ বাজিয়ে।
এই বছর ১ জানুয়ারি ইন্ডিয়া গেটে খোলা আকাশের নীচে
আয়োজন হয়েছিল নতুন এক অচেনা সুরের বর্ষবরণের আয়োজন। সংবিধান ছুঁয়ে তাকে রক্ষা করা,
ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে রক্ষা করার শপথ নিলেন কয়েকশো ধনী-দরিদ্র, ছাত্র-যুব,
এরা নির্দিষ্ট কোনও ধর্মকে আশ্রয় করে বাঁচতে আগ্রহী নয়। এই দলে হিন্দু মুসলিম সহ
বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। তারা স্লোগানে স্লোগানে ইন্ডিয়া গেট
মুখরিত করেছে ‘হম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে’, ‘তানাশাহি নেহি চলেগা’। এই জনস্রোতের
ভিড়ে অধিকাংশই ছিল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। ভয় নায় ওরে ভয় নায়। একুশ
শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে সূচনা হচ্ছে এক নতুন যুগের। ‘ওরে নতুন যুগের ভোরে, দিসনে
সময় কাটিয়ে বৃথা সময় বিচার করে।’ মধ্যরাতের ঘণ্টাধ্বনি খান খান করে দিল নতুন
প্রজন্মের যুগাবসনের আহ্বানে, অন্ধকার রাতের দুঃস্বপ্ন। সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ
করে ওরা গর্জে উঠল এক নতুন ভোরের শপথ বাক্যে। ৩১ ডিসেম্বর হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় শিশু
কোলে মাসহ প্রতিবাদীরা বসেছিলেন শাহিনবাগের ধর্নায়। ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাতের সন্তানদের কথা মনে করিয়ে
দিতেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ ‘জাতীয় সঙ্গীত’ গেয়ে ওঠেন। উড়তে থাকে
জাতীয় পতাকা। শান্ত অথচ গভীর মর্মান্তুদ এক মূর্ছনা আছড়ে পড়েছে গোটা দেশে। গাঁধিজী
আড়াল থেকে বলছেন আমি আছি। নতুন যুগকে স্বাগত জানান তারা। কলকাতার পার্কসার্কাস
পায়ে পায়ে এক হয়ে গেছে মুম্বাইয়ের গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে। শাহিনবাগের সঙ্গে।
ইংরেজি নববর্ষে ভারতে এ কোন শ্বেত কবুতরের উৎসব? সমাপতনও
আছে। ১ জানুয়ারি ভীমা কোরেগাঁওয়ে লাখো দলিত ও জনজাতি পুণের কাছে ওই এলাকায় সমাবেশ
করে। অত্যাচারী পেশোয়ারদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের স্মারক ‘জয়স্তম্ভ’-এ
ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তারা। দু’বছর আগের ছবিটা ছিল ঠিক উল্টো। দু’বছর আগে এই দিনের ভীমা কোরেগাঁওয়ের
অনুষ্ঠানে হাজির দলিতদের ওপর মাহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকারের পুলিশ নির্বিচারে
লাঠি-গুলি চালিয়েছিল। গন্ডগোল ছড়িয়ে পড়েছিল সমস্ত এলাকা জুড়ে। এই বছর
শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস জোটের নতুন সরকার আগে থেকেই সতর্ক ছিল। এলাকায়
শান্তিরক্ষায় বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছিল বর্তমান মহারাষ্ট্রের জোট সরকার। নতুন যুগের আহ্বান মিশে গেল নতুন বছরের প্রথম
দিনে। ভারতের ছাত্র-যুব, দলিত-জনজাতি, হিন্দু মুসলিম মিলে মিশে একাকার। সেন্ট
স্টিফেন্স কলেজের ছাত্রছাত্রীরা গত তিন দশক পরে এই প্রথম বিবেকের টানে রাস্তায়
নেমে এল। ক্লাস বয়কট করল। জওহরলাল নেহরু বিশ্ব বিদ্যালয়ের পরিকল্পিত ছাত্রনিগ্রহের
প্রতিবাদে সারা দেশে শুধু মিছিল আর মিছিল। একটাই স্লোগান ‘হম কাগজ নেহি
দিখায়েঙ্গে’। বাপু-নেহরুর স্বপ্নের ঐকতান বেজে উঠল রবীন্দ্র-নজরুলের একতারায়।
ভারতে ‘ফিউশন’ নামক এক ধারার প্রাসঙ্গিকতা চর্চায়
এসে যাচ্ছে। কারণ কি হিংসা? ঘৃণা? ১২ জানুয়ারি শাহিন বাগের রাস্তায় কেউ পড়ছেন
গীতা, কেউ পড়ছেন কোরান কেউ বাইবেল। ধর্মগ্রন্থ পাঠের সঙ্গেই ভারতীয় সংবিধানের
প্রস্তাবনা পাঠ। ‘ভারতের সমাজতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষ’ চরিত্রকে বজায় রাখতে শপথ
নিলেন সকলে। জাগ্রত ভারতীয় ছাত্র-যুব। ধর্মনিরপেক্ষ ভারত। ভারতীয় সংবিধানের
প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রকে সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক
সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তোলার শপথের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৮৬ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি
এবং ২০০৫, ২০০৯ সালের জাতীয় পাঠ্যক্রম কাঠামোতে সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে, সমস্ত
শিক্ষা প্রকল্প হবে ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের সুদৃঢ় চিন্তার ভিত্তি। গণতন্ত্রের
পাশাপাশি সাম্য, ন্যায়, স্বাধীনতা, মানুষের মর্যাদা এবং অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা ও
ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি শিক্ষার দায়বদ্ধতা থাকবে।
রবীন্দ্রনাথ তার ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে লিখছেন,
‘’জগমোহনের নাস্তিকধর্মের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল লোকের ভালো করা। ...... নাস্তিকের
পক্ষে লোকের ভালো-করার মধ্যে নিছক নিজের লোকসান ছাড়া আর কিছুই নাই- তাহাতে না আছে
পুণ্য না আছে পুরষ্কার, না আছে কোনো দেবতা বা শাস্ত্রের বকশিসের বিঞ্জাপন বা চোখ
রাঙানি। যদি কেহ তাঁহাকে জিঞ্জাসা করিত, ‘প্রচুরতম লোকের প্রভূততম সুখসাধনে আপনার
গরজটা কী।’ তিনি বলিতেন, কোনো গরজ নাই, সেইটেই আমার সব চেয়ে বড়ো গরজ।‘’ ভারতে
সাম্প্রতিককালে যে যে বিষয়গুলি অপ্রধান থেকে প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে, সেটা হল
নাগরিক স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার।
জেলখানায় অত্যাচার, ধর্মীয় এবং বর্ণবৈষম্য এবং রাজনৈতিক দমন গত কয়েক বছরে
‘উন্নয়ন’-এর ঝুলি থেকে নতুন করে বেড়িয়ে এসেছে। যার রূপ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। ভারতে
নাগরিক স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর যে ক্রমবর্ধমান আক্রমণ তা হঠাৎ অথবা
আকস্মিক ঘটনা নয়। এটা পূর্ব পরিকল্পিত ঘটনা। দীর্ঘদিনের প্রয়াসে এই রোডম্যাপ তৈরি
হয়েছে। মানুষ যতদিন অঞ্জ থাকে রাষ্ট্র ততদিন এই সুযোগ কাজে লাগায়।
ফরাসি বিপ্লবের পরে ফরাসিরা ঘোষণা করেছিল,
‘’......মানুষের দুর্ভাগ্যের এবং সরকারের দুর্নীতির প্রধান কারণ হচ্ছে অঞ্জতা,
অবহেলা ও মানুষের অধিকারের প্রতি অবঞ্জা।‘’ গত পাঁচ বছর ‘উন্নয়ন’ নামক ধনীকশ্রেণীর
‘স্যুটবুটে’-র দেরাজ দেখিয়ে আমাদের চুপ করিয়ে রাখার চেষ্টা চলেছে। কিন্তু সেটা
সম্ভব হয়ে উঠল না ‘উন্নয়ন’ আজ মিথ্যের ফানুস হয়ে ভারতের আকাশে উড়ছে। সংবাদ মাধ্যম
দাবী করছে, তলানিতে নামার নতুন নতুন রেকর্ড করতে চলেছে দেশের অর্থনীতি। বিশ্ব জুড়ে
আর্থিক মন্দার পরে এত খারাপ দশা হয়নি ভারতের। কারখানার উৎপাদন, বিনিয়োগ বৃদ্ধির
হার ১৫ বছরে সব থেকে খারাপ। নতুন যন্ত্রাংশে পুঁজির বৃদ্ধি দু’দশকে সর্বনিম্ন।
রাজকোষ ঘাটতির লক্ষমাত্রা ধরে রাখা কঠিন। আমজনতার আয়ও বাড়বে অপেক্ষাকৃত কম হারে। ২৩
ডিসেম্বর রাজঘাটের সত্যাগ্রহ মঞ্চ থেকে সেইজন্যই কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধি মনে
করিয়ে দিয়েছেন আমাদের। তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে উদ্দ্যেশ্য করে বলেছেন,
‘’আপনি একটাই কাজ পারেন। আর সেই কাজ আপনার থেকে ভাল কেউ পারেন না। ভারত কী ভাবে
ভাগ করবেন, কী ভাবে ঘৃণা ছড়াবেন, অনেক বছর ধরে আপনাকে আপনার সংগঠন শিখিয়েছে। আর
তাতে আপনি নম্বর ওয়ান।‘’ আমরা কি এখন বলতে পারি না? নতুন ভারত জাগছে, দুয়ার খুলে
জেগে আছে একুশ শতাব্দীর ভারতের দ্বিতীয় দশকের পাড়া। নতুন যুগের পাড়া।
Comments
Post a Comment