মানবাধিকার দিবসে কলকাতায় ভিক্টোরিয়া


দীপেন্দু চৌধুরী
ভারতে কেন সারা বিশ্বে সমস্ত আন্দোলন এখনও রাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করেই হয়ে থাকে। এই নিয়ে বৃহত্তর বিতর্কের মঞ্চেও কোনও দ্বিরুক্তি হবে না। কিন্তু আন্দোলন করলেই যে রাষ্ট্র উত্তর দিচ্ছে এমনটা প্রায় দেখতেই পাওয়া যায় না। রাষ্ট্র দলীয় বৃত্তের বাইরে এসে সার্বজনীন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এমনটা দেখতে পাওয়াটাও প্রায় অলীক স্বপ্ন। রাষ্ট্রশক্তি সামনে দাঁড়িয়ে নত মস্তকে গণতন্ত্রের স্বার্থে মানবতার কথা বললেও বাক স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে। রাষ্ট্রের এইরকম রঙ বদলের চরিত্র বলে দেয় মানবাধিকার কতটা লঙ্ঘন হচ্ছে আমাদের দেশে। বিভিন্ন উদাহারণ টেনে আনা যায়। বর্তমান গণতন্ত্রে মানবাধিকার নির্ভর করছে ভোট ম্যানেজমেন্ট, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এবং মেসেজ ম্যানেজমেন্টের উপর।
 ক্যালকাটা ন্যাশন্যাল মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী ঐশ্বী রায় যেমনটা বললেন, ‘গণতন্ত্রের বিশেষত্ব বাক স্বাধীনতা। এবং বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। সরকারের অপছন্দের কারণে বাক স্বাধীনতা থাকে না। সরকারের পছন্দ না হলে দেগে দিচ্ছে ‘দেশদ্রোহী’ বলে। এই দেশে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণে। আইনের নিরপেক্ষতা অলীক কল্পনা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সমাজ বিপন্ন, সমগ্র মানবজাতির পক্ষে গণতন্ত্রই ভবিষ্যতের কথা বলে।’ ঐশ্বী কথাগুলি বললেন মানবাধিকার নিয়ে একটি বিতর্কসভায়। ১০ ডিসেম্বর কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল আয়োজন করেছিল ‘অ্যান ইন্টার-কলেজ ডিবেট অন দ্য অকেশন অব হিউম্যান রাইটস ডে’ অনুষ্ঠানের। বিষয় ছিল ‘ডেমোক্রাসি প্রমিসেস রাইটস বাট ডাজ নট এনসিউর দ্য ফ্রিডম টু এক্সারসাইজ দেম’। কলকাতার ৭টি কলেজের ১৪ জন প্রতিযোগী এই বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন।
যেমন প্রশ্ন এসেছিল ধর্মের কি গণতন্ত্রের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আছে? বিতর্কে উঠে এলো বৃহত্তর গণতন্ত্রের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের প্রসঙ্গ। যে দেশে গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষ। সেই পথেই ভারতের মতো দেশের সংবিধান তৈরি হয়েছিল। বিতর্কে উঠে আসে দিল্লির বিশ্ববিদ্যলয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর লাঠিচার্জের মতো বিষয়। দেশে মানবিধিকার আক্রান্ত। নারী নির্যাতন দিনের পর দিনে বেড়ে যাচ্ছে। ধর্ষণ যেন প্রতিদিনের খবরের কাগজের প্রথম পাতার হেডলাইন। বিচার ব্যবস্থা পঙ্গু। বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রীতার কারণে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যেমন গণপিটুনিরমতো ঘটনা ঘটছে ধারাবাহিকভাবে। সরকার আইন আনলেও সেই আইন মানছে না আম নাগরিক। প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক মদতে এসব হচ্ছে কি? এইসব ঘটনায় দোষী ব্যক্তিরা জামিন পেয়ে যাচ্ছে। সে গণপিটুনিতে অভিযুক্ত হোক অথবা ধর্ষণে অভিযুক্ত। মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। ধর্ষণে অভিযুক্তদের শাস্তি না হওয়ার কারণে মানুষ গণতন্ত্রে আস্থা রাখতে পারছে না। অন্যমাত্রার বিতর্ক তৈরি হচ্ছে দেশে। সেই বিতর্ক থামাতে রাষ্ট্র নিজের হাতে ক্ষমতা তুলে নিচ্ছে। হায়দারাবাদে ধর্ষণে অভিযুক্ত চারজনের ভুয়ো সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হচ্ছে ভারতে। মানবাধিকার দিবসে বিতর্কের মঞ্চে এই জাতীয় বিভিনন প্রসঙ্গ উঠে এলো। গণতন্ত্র ব্যর্থ দেশের নাগরিককে গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে।
তবু বলতে হচ্ছে আধুনিক গণতন্ত্রে নতুন আইন সংযোজনের সুযোগ আছে। তবু অনেকেই বলল, যতই গণতন্ত্র মানবাধিকারের কথা বলুক, গণতন্ত্র ছোট্ট পরিসরে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই সীমাবদ্ধতা গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে দিতে পারে। গণতন্ত্রের ‘ডি ফ্যাক্টো’-কে ঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় কি? বিশেষত গণতন্ত্রের দু’টো দিক রয়েছে, সামাজিক গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক গণতন্ত্র। অন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার তুলনায় গণতন্ত্র কম ক্ষতিকারক। বিতর্কসভায় ৭টি কলেজের অংশ গ্রহণকারী ছাত্র-ছাত্রীদের বক্তব্যে উঠে এলো প্রত্যেকেই সাংবিধানিক গণতন্ত্রে বিশ্বাস রাখে। এদিনের প্রতিযোগিতায় পক্ষে এবং বিপক্ষ মিলিয়ে পাঁচজন ছাত্র-ছাত্রীকে পুরস্কৃত করা হয়। বিতর্কসভার বিচারক ছিলেন রাজ্য নারী ও শিশু সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী এবং রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সদস্য অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ম্যাক্সনেল গে ওয়ার্ড। সঞ্চালনা করেন ক্যালকাটা ডিবেট সোসাইটির অন্যতম সদস্য এবং কয়েকটি বইয়ের লেখক স্বাতী গৌতম।                 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?