সরকারী আইন এবং প্রকৃতির সঙ্গে ওদের জুঝতে হয়






দীপেন্দু চৌধুরী
জল জঙ্গলের জীবনে মানুষ এবং প্রকৃতির যে ধরণের সম্পর্ক, সংঘাত সেটা বাস্তবে চোখে না দেখলে কিছুই দেখা হয় না। বর্ষায় মেঘে মেঘে যখন আকাশ কালো হয়ে জানান দেয়, মেঘ বলেছে যাবই যাব......। তখন শুধুমাত্র কী কবি, লেখক বা গীতিকার পুলকিত হয়? কৃষক এবং জেলেও গান ধরে, গাছপালা সতেজ হয়, ক্ষেতে ফসল ফলে। কিন্তু অতিবৃষ্টিতে প্লাবন হলে জীবজন্তু থেকে মানুষ সকলেই আতঙ্কিত এবং ক্ষতির মুখে পড়েমানুষ সভ্যতা শুরুর সময় থেকে যেমন চেষ্টা করেছে, নদীর বাঁধ বাঁধতে, তেমনি নদীর বহতা বিঞ্জানের সাহায্যে চিরস্থায়ী কল্যাণে লাগাতে। মানুষ এবং প্রকৃতির সম্পর্ক শুধুমাত্র সংঘাত নয়। কয়েক হাজার কয়েক লক্ষ মানুষের জীবনের না বলা, অথবা একসময় সাহিত্যের আঁচলে বলা উপাখ্যান। আজও সেই উপাখ্যান লেখা যায়। যে উপাখ্যান সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পদ্মানদী’-র উপন্যাসে লিখে গেছেন। রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’ ছবিতে আমরা মাঝি-মল্লাদের জীবন কাহিনী খুঁজে পাই।
নভেম্বরের শেষ হেমন্তের ভেজা ভেজা নীল আকাশের নীচে পাঁচ-ছ’জন মহিলা মাছ ধরার জাল তৈরি করছে। কয়েকজন আবার পুরনো জালের ছেঁড়া-ফুটো সারাই করছে। কাকদ্বীপ ব্লকের প্রতাপাদিত্য নগর ১ নম্বর ভুটভুটিঘাটের বাসিন্দা ওরা। তাঁদের একজন যোগমায়া দাস। বছর পঞ্চান্ন বয়স। সম্প্রতি গিয়েছিলাম ওই অঞ্চলে। কথা বলতে গিয়ে জানতে পারলাম, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা দু’মাস বন্ধ ছিল। নদীতে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। সেই জন্য বাড়ির পুরুষরা মাছ ধরতে যায়নি। যোগমায়ার দু’টো ছেলে। বড় ছেলে ১২ ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করে আর্থিক কারণে আর পড়তে পারেনি। বাড়ির প্রয়োজনে কেরালায় মাছ ধরার কাজ করতে গেছে। ৩৮ বছরের তরুণী আভা দাসের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, একই সমস্যা। বড়ছেলে মূক ও বধির। একটাই মেয়ে। বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী মাছ ধরতে যায় বঙ্গোপসাগরে। বর্ষার সময় এক সপ্তাহের জন্য মাছ ধরতে যায়। এক সপ্তাহ পরে মাছ ধরে ফিরে আসে। শীতের সময় ১৫ দিন সাগরে ট্রলার ভাসিয়ে ওরা মাছের সন্ধানে ঘোরে। পূব দিকের হাওয়া হলে মাছ ভালো হয়, কিন্তু পূবের হাওয়ার থেকে বর্তমান সময়ে উত্তরে হাওয়া বেশি। যখন কোটাল থাকে তখন নিম্নচাপ হচ্ছে, আবহাওয়া দপ্তর মাছ ধরতে যেতে নিষেধাঞ্জা জারি করছে। উথাল-পাথাল সমুদ্রে কেউ যেন মাছ ধরতে না যায়। আক্ষেপ যোগমায়া এবং আভা দাসদের। প্রতিদিন কাজ করে ওরা ২০০ থেকে ৩০০টাকা পায়। ওদের দাবি অভাব না থাকলে বাড়ির মেয়েরা বাইরে কাজ করতে আসে?
সমস্যা সমুদ্র নদীর বুকেও। পশ্চিমবঙ্গের তিনটে উপকূলীয় জেলা আছে। উঃ ২৪ পরগণা জেলা, দঃ ২৪ পরগণা জেলা এবং পূর্ব মেদিনীপুর। এই সব জেলা থেকেই মৎসজীবীরা নদী-খাঁড়ি এবং গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। ছোট মাছ যাতে না ধরতে পারে তার জন্য দুটো আইন আছে। একটা কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বিতীয়টা রাজ্য সরকারের। উপকূল এলাকা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল রাজ্য সরকারের এলাকা। কেন্দ্রীয় সরকারের এলাকা হচ্ছে ২০০ নটিক্যাল মাইল। এটাকে বলা হয় এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড)। দু’ধরণের নেট ব্যবহার করা হয় গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য। একটা ট্রল নেট দ্বিতীয়টি গ্রীল নেট। রাজ্য সরকারের এলাকা ১২ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে ট্রলনেট ব্যবহার করা যাবে না। এটা আইনে বলা আছে। রাজ্য মৎসদফতর অনুমতি দেয় ১২নটিক্যাল মাইলের মধ্যে। এক্ষেত্রে বটম ট্রলিং প্রায় বন্ধসুন্দরবনের নদীতে চড়া পরে যাচ্ছে। ফলে ১২ নটিক্যাল মাইল এলাকায় মাছ ধরা যাচ্ছে না। অভিযোগ মৎসজীবীদের।  
ট্রলনেট যন্ত্র চালিত। এই নেটে ৩০-৪০ প্রজাতির মাছ পড়ে। মৎস সংরক্ষণ আইনে গ্রীল নেটের সাইজ হচ্ছে ৯০ মিলি মিটারের কমএই সাইজের নীচের জাল ব্যবহার করা যাবে না। কারণ এই জালে ছোট মাছ আটকে যায়। বড় ট্রলার নিয়ে যারা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায় তারা যন্ত্র চালিত জাল (ট্রলি জাল) ব্যবহার করে কাচিয়ে সব মাছ তুলে নিয়ে চলে আসে। ছোট মাছ মারা যায়। বড় হতে পারে না। ট্রলনেটের হা মুখ হচ্ছে ১০০ ফুটের। ফলে যা মাছ আসবে সব জালে পড়বে। বড় ট্রলারে বরফ রাখার জায়গা আছে। ছোট নৌকায় বরফ রাখার জায়গা নেই, ফলে মাছ সংরক্ষণ করে ছোট নৌকার মৎসজীবীরা আনতে পারে না। ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত মাছ ধরার অনুমতি পাওয়া যায়। মৎস সংরক্ষণ আইনে বলা আছে বছরে ৪৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। ৯০ দিন করার জন্য রাজ্য এবং কেন্দ্রকে অনুরোধ করেছিল মৎসজীবীদের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনাইটেড ফিশারম্যান অ্যাসোসিয়েশন। কিন্তু করা হয়েছে ৬০ দিন। ৯০ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকলে মাছের অভাব হবে না। সংগঠনের প্রস্তাব, গ্রীল নেটের মাছ ধরা ৯০ দিন বন্ধ থাক। আর ট্রল নেটের মাছ ধরা ১২০ দিন বন্ধ থাক। কারণ মাছের ডিম পাড়া এবং বড় হওয়ার জন্য সময় দেওয়া প্রয়োজন। তাঁদের আরো প্রস্তাব, ট্রল নেটের পরিবর্তে স্কোয়ার নেট যদি যৌথভাবে অনুমোদন করে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার তা হলে ছোট মাছ জাল থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। মাছ বড় হওয়ার সুযোগ পায়।   
ফিশারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, তারা রাজ্য মৎস দফতরকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, মাছ ধরার এলাকা কমে যাচ্ছে। ৬ সিলিন্ডার ক্ষমতা সম্পন্ন যে বোটগুলি আছে সে গুলোর নতুন করে রেজিস্ট্রেশন বা অনুমতি যেন না দেওয়া হয়। ১/২ সিলিন্ডার ক্ষমতাসম্পন্ন এবং ইঞ্জিন বিহীন (দাঁড়পাল) নৌকাকে নতুন করে অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। বর্তমানে দু’ধরণের লাইসেন্স দেওয়া হয়। ১) বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি)। রাজ্য বন দফতরের বাঘ সংরক্ষণ দফতর থেকে এই লাইসেন্স দেওয়া হয়। সুন্দরবনের যেসব নদীখাঁড়ি আছে সেখানে মাছ ধরার জন্য। ২ সিলিন্ডার যুক্ত নৌকা আছে উঃ ২৪ পরগণা এবং দঃ ২৪ পরগণায় ১২ হাজার। দাঁড়পাল নৌকা আছে ১০, ৫০০। তালের ডোঙ্গা আছে ২০০। সে ক্ষেত্রে বনদফতর মাত্র ৪০০ বিএলসি দিয়েছে। রাজ্য ফিশারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সহকারী সম্পাদক বিজন কুমার মাইতি বিষয়গুলির উল্লেখ করে বলছিলেন, লাইসেন্সের জন্য আবেদন জমা পড়েছে ২৩ হাজাররাজ্য বন দফতর মাত্র ১৭০০ লাইসেন্স দিতে চাইছে। এই সমস্যাগুলো সংগঠন থেকে রাজ্য বন দফতর এবং মৎস দফতরকে জানানো হয়েছে। এই প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিলাম রাজ্য বন দফতরের সুন্দরবন জীববৈচিত্র সংরক্ষণ বিভাগের যুগ্ম ডাইরেক্টর ডঃ এস কুলান্ডাইভেলের কাছে। তিনি একমত হলেন। বললেন, ‘জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ৪০০ বিএলসি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে মাছ ধরার জন্য। আমরা যন্ত্র চালিত নৌকা বন্ধ করতে চাই। তাহলে বেআইনি মাছধরা অনেকটা কমবেরাজনীতি এক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করলেন সুন্দরবনের বাদাবন না থাকলে কলকাতাকে বাচানো যেত না। বাদাবন নিয়ে কেউ ভাবছে না। বুলবুলের দাপটে শুকনো মাছের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে’
বুলবুলের দাপটে শুকনো মাছের যে ক্ষতি হয়েছে সেই প্রসঙ্গে বিজনবাবু বাঁশ আর হোগলা দিয়ে তৈরি একটা ভেঙে পড়া‘বাসা’-র ছবি দেখালেন। সমুদ্রের বালির চড়ায় সামুদ্রিক মাছ শুকনো করার এইসব বাসা বা ঘর তৈরি করা হয়। শুকনো মাছের ব্যবসা হয় মূলত ফ্রেজারগঞ্জের বালিয়ারা, কালীস্থান, কাকদ্বীপ, সাগরে শুকনো মাছের বাজার। বুলবুল ঝড়ে শুকনো মাছের ঘর সব উড়ে গিয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে মৎসজীবী এবং মৎস ব্যবসায়ীদের। সরকারী আইন এবং প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেই ‘বে অব বেঙ্গল’-র মৎসজীবীরা জল-মাছের সামাজিকতায় বেঁচে আছেন। (ছবিগুলি তুলেছেন সুব্রত চট্টোপাধ্যায়) 
                               

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?