ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আইপিসিসি বিষয়ক অভিনব কর্মশালা





দীপেন্দু চৌধুরী
একসময় কলকাতা শহরকে পুকুরের শহর বলা হত। বা জলাশয়ের শহর (সিটি অব পন্ডস) হিসেবে প্রখ্যাতি পেয়েছিল কলকাতা। সময়টা ব্রিটিশ শাসনের সময়কাল। ব্রিটিশ আমলে আমাদের এই শহরের জগৎজোড়া এমনই খ্যাতি ছিল। ‘ন্যাশন্যাল অ্যাটলাস অ্যান্ড থিম্যাটিক ম্যাপিং অর্গানাইজেশন’ (ন্যাটমো)-র রিপোর্ট বলছে, কলকাতা শহরে কয়েক দশক আগেও ৮৭০০-র বেশি জলাশয় ছিল। প্রায় ৪০ শতাংশ বিগত দু’তিন দশকে ভরাট হয়ে গেছে। বর্তমান সময়ে রাজ্যের জলাভূমির ছবিটা হচ্ছে, স্থায়ী বা ক্ষণস্থায়ী বড়ো এবং ছোটো মাছ ধরার পুকুর, মাছচাষ ব্যবস্থা, লবণাক্ত জলাভূমি, ম্যানগ্রোভস, অগভীর হ্রদ, স্বাদু বা নোনা জলের অগভীর হ্রদ, নিকাশী ব্যবস্থার জল দ্বারা পুষ্ট জলাভূমি, জলের গর্ত, নদী উপত্যকা, পার্বত্য জলধারা, নদী-উপনদী, ব-দ্বীপ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জলাভূমি সংক্রান্ত বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে। গঠন এবং জল সংক্রান্ত বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জলাভূমিকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। (১) গাঙ্গেয় পলিসমৃদ্ধ সমতলের জলাভূমি, (২) সমুদ্র তীরবর্তী জলাভুমি, (৩) রাঢ় অঞ্চলের জলাভুমি এবং (৪) হিমালয়কেন্দ্রিক জলাভূমি।
পশ্চিমবঙ্গের ৫৪টি প্রাকৃতিক এবং ৯টি মানুষের তৈরি এমন বৃহৎ জলাভূমি রয়েছে যে গুলির আয়তন ১০০ হেক্টরের বেশি। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ছোট বড়ো নানা ধরনের জলাভূমি। নদী ব্যবস্থার ধারেকাছেই রয়েছে বেশিরভাগ উদ্ভিদাণু ও জীবাণুপুষ্ট জলাভূমি। যেগুলি জৈব-ফিল্টার (Bio-filter) ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। পশ্চিমবঙ্গের জলাভূমিগুলি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদ্ভিদ বৈচিত্রে সমৃদ্ধ। ৩৮০টির বেশি উদ্ভিদ প্রজাতি রাজ্যের জলাভূমিগুলিতে পাওয়া যায়। এরমধ্যে পলিভিত্তিক সমতলের জলাভূমি ও গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের জলা ভূমিগুলি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়।
রাজ্যের পরিবেশ তথা বিশ্ব উষ্ণায়ন বিষয়ে আরও তথ্য জানা গেল। কলকাতার দু’টো স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, ৪টে বিশ্ববিদ্যালয়, ৭-৮টা কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, জলবায়ু এবং পরিবেশ বিষয়ের কয়কটি বইয়ের লেখক জয়শ্রী রায়। আইপিসিসি (ইন্টারগভরমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) বিষয়ে কতজন শুনেছ? বিশ্বউষ্ণায়ন কতজন জান? আইপিসিসি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং রাজ্য পরিবেশ দপ্তর আয়োজিত দু’দিনের কর্মশালায় কলকাতার বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী সেদিন উত্তর দিতে পারছিল না অথবা দ্বিধাবোধ করছিল। ১৪ নভেম্বর এবং ১৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নিউটাউনের বিশ্ববাংলা কনেভেনশন সেন্টারের ৬ নম্বর সভাঘরের ছাত্র-ছাত্রীদের নীরবতা ভাঙার দায়িত্ব তুলে নিলেন অধ্যাপক জয়শ্রী রায় এবং পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যান রুদ্র। ইংরেজিতে লেখা আইপিসিসির তিনটে প্রতিবেদন ১৫ নভেম্বর বাংলায় অনুবাদ করে শোনালেন উল্লেখিত দু’জন পরিবেশ বিঞ্জানী। আইপিসিসি-র তিনটে বিশেষ প্রতিবেদন হচ্ছে (i) বিশ্বউষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, (ii)  ভূমি এবং জলবায়ু পরিবর্তন, (iii) সমুদ্র এবং হিমশৈল
ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও জানতে পারলাম, ১৯৫টা দেশের বিভিন্ন বিঞ্জানী, রাষ্ট্রনেতা একসঙ্গে বৈঠক করে আইপিসিস নামক এই মঞ্চ গড়ে তুলেছেন বিশ্ব পরিবেশ এবং উষ্ণায়ন বিষয়ে আলোচনার জন্য। ওই ১৯৫টি দেশের বিঞ্জান ভিত্তিক আলোচনার মঞ্চ হচ্ছে আইপিসিসি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমরা সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারব কিনা সেই সমস্যা খুঁজে দেখছে আইপিসিসি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে আমরা কিভাবে জানতে পারব সেই বিষয়ে গবেষণার কাজ করে এই সংস্থা। ২০০৭ সালে আইপিসি বলেছিল জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের তৈরি সমস্যা। তিনটে প্রতিবেদনে জীব বৈচিত্রের বিষয়ে গবেষণা রিপোর্ট তৈরি করা হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি দহনের জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস দ্বারা সারা পৃথিবীর নির্মল আবহাওয়া দূষিত হওয়া শুরু হয় শিল্পায়ন ও নগরায়নের কারণে। ১৭৫০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আবহাওয়ায় কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব বাড়ে ২৭৮ ppm থেকে ৪০১ ppm এবং এই সময়ের মিথেনের ঘনত্ব বাড়ে ৭০০ ppm থেকে ১,৮০০ ppmআবহাওয়ায় গ্রিন হাউস গ্যাসগুলির বর্ধিত হারে একত্রিত হওয়ার জন্য তার মধ্যে শক্তি আটকে পড়ে এবং এই কারণে জলবায়ুর পরিবর্তনের হার ত্বরান্বিত হয়আর এখন জলবায়ু পরিবর্তন মনুষ্যজাতির কাছে একটি জ্বলন্ত সমস্যা।
১৮৫০ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত জলবায়ু অনুকূলে ছিল। দারিদ্র দূরীকরণ, জীব বৈচিত্রের ভারসাম্য, উষ্ণায়ন, জলের উষ্ণতা বাড়লে প্রবাল মরে যায়। যেমন সুন্দরী গাছের শিকড় জলোচ্ছাস, ঝড়, ঘূর্ণিঝড়েও মাটির ঘনত্ব ধরে রাখতে পারে। খাদ্য উৎপাদন বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে এইসব বিষয়ে বলা হয়েছে। অন্য আরও একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০৩০-২০৪০ সালের মধ্যে কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন যদি বন্ধ করতে না পারা যায় তাহলে উষ্ণায়ন বৃদ্ধি কমানো যাবে না। নগরায়নের ক্ষেত্রে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। কি কি গাছ, কতটা কার্বন ধরে রাখতে পারে এই বিষয়ে আমাদের ‘গাছ বুড়ো’ হতে হবে। কয়লায় কার্বন ধরা আছে। আগামী ২০-২৫ বছরে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ কতটা কমানো যায় সেটাই আইপিসিসি-র অন্যতম কাজ। ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় বিশ্বকে আনতে হবে। সারা বিশ্বের জমিগুলো উষ্ণায়নের জন্য মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। জমিগুলোর গুনগত মান কমে গেলে খাদ্যশস্য কি করে উৎপাদন করা হবে সেই বিষয়েও আইপিসিসি গবেষণা করছে। যেমন সুন্দরবন। এটা কি শুধুমাত্র জঙ্গল? সুন্দরবন আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত উত্তরবঙ্গ থেকে সুন্দরবনের ভূপৃষ্ঠের জল কমছে। নদীর গতিবিধির পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।  
রাজ্য পরিবেশ দফতরের প্রধান সচিব প্রভাত মিশ্র উল্লেখ করলেন, রাজ্যে বৃষ্টিপাতের প্রসঙ্গ। গত বছর ২৫ শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছিল। এই বছর স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে। ২০২০-২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করে আমাদের রাজ্যেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবে রাজ্য পরিবেশ দফতরবায়ুদূষণ, জলদূষণ, পানীয় জল নিয়ে রাজ্য সরকার বিশেষভাবে চিন্তিত। রাজ্য পরিবেশ দফতর আতঙ্কিত সাগরদ্বীপের জন্যবুলবুলের ঝড়ে সাগর দ্বীপের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে। বুলবুলের তান্ডবে ৬০ হাজার বাড়ি ভেঙ্গেছে সুন্দরবনে। সাগর ব্লকে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা অনেক অঞ্চলে এখনও স্বাভাবিক নয় বুলবুল ঝড়ের তান্ডবে। ১৯০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭৮টি ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছে ‘বে অব বেঙ্গল অঞ্চল’।     
নোবেল শান্তি পুরষ্কারের অর্থ সারা বিশ্বের ছাত্র-ছাত্রীদের গবেষণা করার জন্য দেওয়া হয়। এই অর্থ পাওয়াটা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ভীষণ সম্মানজনক। পরিবেশ বিঞ্জানীরা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আবেদন করেন স্কুলে,পাড়ায় বাড়িতে গিয়ে বলতে হবে তোমাদের, তোমরা কি শুনলে এদিন। আইপিসিসির তরফে ছাত্রছাত্রীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এই বিষয়ে, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে কি জান তোমরা? সেদিন ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে নিজেদের পছন্দমত চারটে বিষয়ে লিখিত প্রশ্ন সংগ্রহ করে উদ্যোক্তারা। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পরে উৎসাহ লক্ষ করা যায়। অধ্যাপক জয়শ্রী রায় নিজে লিখিত প্রশ্নগুলি সভাঘরে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেন। সংগৃহীত প্রশ্নগুলি থেকে  মনোনীত কয়েকটি প্রশ্ন আইপিসিসির ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। এমনটা ঘোষণা করেন আইপিসিসি প্যানেলভুক্ত বিঞ্জানীরা। সত্যিই বলতে হবে সরকারি উদ্যোগে ‘পরিবেশ আন্দোলন’-র এই কর্মশালা অভিনবত্ব দেখাতে সফল হয়েছে।                      

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?