গ্রন্থাগারিক সভা এবং শিশু সাহিত্যের খোঁজে
দীপেন্দু চৌধুরী
সাহিত্য বলি অথবা সমাজের চলচ্চিত্র বা চালচিত্র। আজ থেকে ২৫০০ বছর আগে মানুষ
তালপাতার পুঁথিতে হাতে লিখে রেখে গেছে। তৎকালীন সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতার ইতিহাস
এবং সামাজিক লোকাচারের কথা। সাহিত্যের মানের কথা মাথায় রেখেই সে সময় থেকে বিংশ
শতাব্দীর শেষ দশক পর্যন্ত লেখকরা লিখেছেন, প্রকাশক বই প্রকাশ করেছেন, গ্রন্থাগারিক
পাঠাগারে বই সংগ্রহ করেছেন। সভ্যতার প্রথম যুগে অধিকাংশ মানুষ ছিল শিকারি এবং
পশুপালক। এর পরে এল কৃষি আরও পরে আসে শিল্প-বাণিজ্য। সৃষ্টি হয় বুদ্ধি দিয়ে কাজের
পরিবেশ। গুরুত্ব বাড়ে ‘বুদ্ধি নির্ভর’ কাজের। কায়িক শ্রমের তুলনায় বুদ্ধির কাজ বা
মাথা খাটিয়ে কাজ করাটা হয়ে ওঠে জটিল থেকে জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে যেমন
রামায়ন, মহাভারতের কথা আমরা জানি, পাশাপাশি ইউরোপ, আমেরিকায় তেমনি বাইবেল, মধ্য
প্রাচ্যে কোরানের প্রসঙ্গ এসে যায় বা আরও প্রাচীন সাহিত্য পুঁথি ইত্যাদির প্রসঙ্গ
এসে যায়। এই সব ধর্মগ্রন্থ এবং বিঞ্জান, চিকিৎসা বিঞ্জান, ইতিহাস, সাহিত্য বিভিন্ন
বইয়ের জন্য প্রয়োজন হয়ে পরে গ্রন্থাগারের। যেমন বাগদাদের কথা বলা যায়। বাগদাদ
একসময় ছিল ইসলামিক রাজধানী। এই শহরে বিখ্যাত লাইব্রেরিও ছিল।
সম্প্রতি গ্রন্থাগারিকদের নিয়ে একটি কর্মশালার
যৌথভাবে আয়োজন করে পেঙ্গুইন র্যান্ডাম হাউস, ইন্ডিয়া এবং অক্সফোরডঃ স্টোরি টেলর
বুক স্টোর। কলকাতার ভিআইপি বাজারে স্টোরি টেলর বুক স্টোরে ‘দ্য পেঙ্গুইন লাইব্রেয়িয়ান
মিট’ শিরোনামে এই সভা হয়। সারা ভারতের চারজন শিশু সাহিত্যিক এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
রূপা পাই, সনিয়া মেহতা, দীপক দালাল এবং বিনীতা সেন। গ্রন্থাগারিক কর্মশালার
আলোচনায় মূলত উঠে আসে, বর্তমান সময়ের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলির পাঠাগেরর
পরিকাঠামো এবং ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠাগার ব্যাবহারে গ্রন্থাগারিকের ভূমিকা।
প্যানেলিস্টদের বক্তব্য, গ্রন্থাগারিকদের কাজ এখন কঠিন
হয়ে গেছে। কারণ গ্রন্থাগারের চরিত্র বদলে গেছে। গ্রন্থাগারিকের কাজ অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। দীপক দালাল বলেন, ‘’শিশুদের সাহায্য করতে হবে। তাঁদের খুশি করতে
হবে। যে বই সে ভালো বাসে সেই বই তাকে দিতে হবে। শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার
দায়িত্ব গ্রন্থাগারিক, শিক্ষক এবং আমাদের।‘’
সনিয়া মেহতা বলেন, ‘’বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল
মিলিয়ে আমাদের গ্রন্থাগার গড়ে তুলতে হবে। ছোট একটা ঘরে নয়। বড় হলঘরে পাঠাগার গড়ে
তুলতে হবে। গ্রন্থাগারিকের কাজ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।‘’
শিশু সাহিত্যিক বিনীতা সেন বলেন, ‘’গত দু’বছর আমি
প্রশাসকদের কাছে প্রশ্ন করছি, পাঠাগারের জন্য কি কাজ হচ্ছে? পাঠাগারের গৃহসজ্জা
পরিবর্তনের কথা বলেছি। আমিও বলছি বড় পাঠগৃহ প্রয়োজন। গ্রন্থাগারিকদের এই কাজ করতে
হবে। শিশুদের আনন্দে থাকতে দিন।‘’ জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক রূপা পাই বলেন, ‘’১২০০
বছর আগের পাঠাগার এবং গ্রন্থাগারিকদের নিয়ে আমি গবেষণা করছি। ২৫০০ হাজার আগের
গ্রীস এবং ভারত চিকিৎসা শাস্ত্রে বিশেষ কাজ করেছিল। ভারতে সুশ্রুত ক্যাটারাইটের
ওপরে কাজ করেছিলেন। চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর অনেক কাজ আছে। গ্রীক সভ্যতায় তখন অনেক পুঁথি
লেখা হয়েছিল। হারুনাল রশিদ অনুবাদ করেছেন গ্রীক থেকে আরবিক ভাষায়। ইউরোপে লাটিন
ভাষায় সেই সময় অনুবাদের কাজ হত। লাইব্রেরি না থাকলে আমরা এসব তথ্য পেতাম না। তাই
আজকের শিশুকে বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে ভালো লাইব্রেরি।‘’
অক্সফোরডঃ স্টোরি টেলর বুকস্টোর-র কর্ণধার ময়ূরা
মিশ্র বলেন, ‘’এই অনুষ্ঠান আমরা দ্বিতীয় বছরে করছি। প্রতি বছর করার ইচ্ছে আছে,
স্কুল এবং কলেজে নতুন পাঠাগার গড়ে তুলতে এই আলোচনা আরও বৃহত্তর মঞ্চে নিয়ে যেতে
হবে।‘’
আলোচ্য লেখার সূত্র ধরেই আমরা উল্লেখ করছি বর্তমান
ভারত তথা বাংলা শিশু সাহিত্যের সীমাবদ্ধতার কথাও। বিঞ্জান এবং প্রযুক্তির হাত ধরেই
উন্নত বিশ্ব আমাদের ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ নামক একটা বৃহত্তর মঞ্চের সিংহদুয়ারের ফটক
খুলে দিয়েছে। আলোচনা হচ্ছে এটা সমস্যা না নতুন মাধ্যম? শিশুরা কি করবে? এই বিষয়কে
সামনে রেখে সাহিত্য অকাদেমি কলকাতার আঞ্চলিক অফিস আয়োজন করেছিল ‘বাল সাহিতি’
অনুষ্ঠানের। ১৪ নভেম্বর ‘শিশু সাহিত্য এবং নতুন মিডিয়া’ শীর্ষক আলোচনাসভায় বক্তব্য
রাখেন কবি সুবোধ সরকার, শিশু সাহিত্যিক অমরেন্দ্র চক্রবর্তী, রঞ্জিতা বিশ্বাস, রাজেশ
জৈন এবং দেব সাহিত্য কূটিরের কর্ণধার রূপা মজুমদার। সাহিত্য অকাদেমির বিদায়ী
আঞ্চলিক সচিব ডঃ দেবেন্দ্র কুমার দেবেশ। প্রত্যেক বক্তাই শিশু সাহিত্যের দুর্বলতার দিকটা তুলে ধরেন। বর্তমানের শিশুদের মান অনুযায়ী
শিশু সাহিত্য কি লেখা হচ্ছে? সংবাদ মাধ্যম এবং সাহিত্য পত্রিকাগুলি আগেরমতো শিশু
সাহিত্যের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট নয়। এই অনুযোগ করে প্রত্যেকেই সুকুমার রায়,
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায় এবং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়েরমতো খ্যাতনামা লেখকদের প্রসঙ্গ তুলে
ধরেন। শুকতারার সম্পাদক রূপা মজুমদার বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া’-কে আমরা অস্বীকার
করতে পারি না। ‘ই-বুক’-কে আমাদের মেনে নিতে হবে। আমাদের প্রকাশনা থেকে ‘ফেসবুক’-এ
প্রকাশিত ছোটগল্পের সংগ্রহ প্রকাশ করা হচ্ছে।‘’
Comments
Post a Comment