সমাজ বদলতো সংবাদপত্রই করবে




দীপেন্দু চৌধুরী
কিছুদিন আগে পর্যন্ত সংবাদপত্রের বা গণমাধ্যমের ইতিহাস নিয়ে যারা চর্চা করেছেন তাঁদের দাবী ছিল, সারা বিশ্বে মোট যে ১৯২ টি দেশ আছে তার মধ্যে ১১৭টি হল গণতান্ত্রিক দেশ। উল্লেখিত ১১৭ টি দেশের মধ্যে আবার মাত্র ৬০টি দেশে স্বাধীন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সংবাদ পত্রগুলি স্বাধীন চরিত্র ধরে রাখলেও প্রকাশিত সংবাদ পত্রের গঠন এবং চরিত্র একরকম নয়। এই প্রসঙ্গে বলা যায় দেশে দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও তারতম্য আছে। এতদসত্বেও এরমটা দাবী করা যায় যে, তারা স্বাধীন সংবাদপত্রের ভূমিকা পালন করে চলেছে। গণতন্ত্রের চরিত্র অনুযায়ী একেক দেশে একেক রকম সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পেয়ে থাকেআমরা বলতেই পারি সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে চেহারা সেটা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের গণতন্ত্রের চেহারার উপরে। এবং বলতেই হবে ২৩৭ বছর ধরে টানা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মঞ্চের খোঁজে যে অনুসন্ধান, সেটা আজও সমানভাবেই সচেষ্ট রয়েছে। একটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমস্ত সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা হয় ধারাবাহিক বৌদ্ধিক বিতর্ক এবং আলোচনার মাধ্যমে। কোনও একজন ব্যক্তি অথবা কিছু তালেবর গোষ্ঠীর গৃহীত সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি আর নেই। সামন্ততান্ত্রিক ধ্যান ধারণার উর্ধে উঠে এক উন্নত গণতন্ত্রের প্রয়াসকেই গণমাধ্যমে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এবং দেওয়া হচ্ছে।  
এই বিষয়ে সম্প্রতি সমাজ, সাহিত্য এবং গণ মাধ্যম বিষয়ক কয়েকটি আলোচনাসভা হয়ে গেল কলকাতায় অনুষ্ঠিত ১নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বরের বইমেলায়। ‘মোহরকুঞ্জ’-র বাংলাদেশ বই মেলায়। এই বছরের বইমেলায় ৮০ টি স্টল ছিল৬ নভেম্বর মোহরকুঞ্জ-র মঞ্চে আলোচনাসভার বিষয় ছিল ‘সমাজ বদলে গণমাধ্যমের ভূমিকা’। হেমন্তের শেষ বিকেলে সন্ধ্যারাগের বেহাগের সুরে বিদগ্ধ আলোচকরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং ভূমিকা প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন। আয়োজক দেশ যেহেতু বাংলাদেশ তাই ‘মুক্তিযুদ্ধ’, বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান, ভারতবর্ষ এবং কাব্যিক কলকাতা তথা প্রতিবাদী কলকাতার প্রসঙ্গ উঠে আসবেই। এলোও সমান ভাবেই। প্রত্যেক বক্তার হ্রদয় ওথলে উঠে এলো আবেগ-উচ্ছ্বাস স্মৃতি নির্ভর আবেগ এবং বর্তমান সময়ের অভিঞ্জতা। অনুষ্ঠানের এদিনের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সুভাষ সিংহ রায়। তিনি বলেন, ‘সংবাদপত্রে যারা সাহসী মানুষ হতে পারে তারা দুনিয়া বদলে দিতে পারে। আমি আজকের দিনে সংবাদ এবং সংস্কৃতির উদার গণতন্ত্রের শহর কলকাতায় দাঁড়িয়ে মনে করতে পারছি, কাঙাল হরিনাথের নাম। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের প্রথম স্বাধীনচেতা ব্যক্তিত্ব। নির্ভীক, ধর্মনিরপেক্ষ সাংবাদিকতার প্রথম পথিকৃৎ তিনি। তার চিন্তা এবং সাহস আমাদের পথ চিনিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে সাহসী সংবাদ মাধ্য গড়ে তুলতে আমরা আরও বলিষ্ঠ হয়েছি।’
পরের বক্তা ছিলেন কলকাতা প্রেস ক্লাবের সভাপতি, স্বনামধন্য সাংবাদিক স্নেহাশিস সুর। তিনি বলেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের একজন মানুষ। আমি মুক্তিযুদ্ধ চেতনার একজন মানুষ। সামনের বছর বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের শতবার্ষিকী উদযাপনের বছর। তিনি কলকাতায় বহুদিন ছিলেন। বাঙালি জাতিসত্তার প্রাণ পুরুষ মুজিবর রহমান। সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে ভারত বাংলাদেশের সেতু গড়ে তুলতে সব রকমের সাহায্য করার। কারণ সংবাদপত্র ভারতীয় উপমহাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
প্রবীণ সাংবাদিক দিলীপ চক্রবর্তী। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে যার প্রত্যক্ষ অভিঞ্জতা রয়েছে। খোকন চৌধুরী ছদ্মনামে দিলীপবাবু সমস্ত রকমের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় খবর পাঠাতেন। ১৯৭০-৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধক্ষেত্রের সেইসব অভিঞ্জতা তাঁর লেখা বইয়ে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘আমি একটি বইয়ে সারা পৃথিবীর ১০০ জন সাংবাদিকের কথা লিখেছি। যারা বিভিন্ন দেশে যুদ্ধের সময় সংবাদ করতে গিয়ে আর বাড়ি ফিরতে পারেননি। বাংলাদেশেরও ১৩ জন সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। তাঁদের নামে বাংলাদেশ সরকার ডাক টিকিট প্রকাশ করেছে। আমাদের দেশের দু’জন সাংবাদিক দীপক এবং সুরজিৎ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে খবর করতে গিয়ে মারা গেছেন। আমি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি।’
দিলীপবাবু প্রায় চল্লিশ বছর ‘সপ্তাহ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক। তার ব্যাখ্যা, জনমত সৃষ্টি করছে যারা, তারা শাসকের পক্ষে কথা না বললে তাঁদের উপর আক্রমণ নেমে আসে। ইউরোপের বিভিন্ন ঘটনার কথা উল্লেখ করেন তিনি। ভারতের উদাহারণ টেনে তিনি বলেন, ‘১৯০৮ সালে একটি পত্রিকার ৮ জন সম্পাদককে জেলে পুরেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকরা। পত্রিকাটি লখনউ থেকে প্রকাশ হত। ১৯০৮ সালে প্রেস আইন তৈরির পরে অবিভক্ত বাংলায় ৬০টি পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয়। তবু সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন কলমের অধিকার কোনও শাসক কেড়ে নিতে পারেনি।’
দিলীপবাবুর সঙ্গে একমত হয়ে বলতে হবে যে বর্তমান ভারতে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সংবাদ বছরে ৭০ জন সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে খবর হয়েছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে খবর পাওয়া যায়নি। পরে জানা গিয়েছে। বাংলাদেশ বইমেলার এদিনের বিশেষ অতিথি ছিলেন, ‘দৈনিক সংবাদ’-র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জনাব খন্দকার মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘আজকের আলোচনার বিষয়ে বিতর্কের কিছু নেই। আমার মনে হয় রাষ্ট্র পরিবর্তনেও গণমাধ্যমের একটি বিরাট ভূমিকা আছে। যার উজ্জ্বল উদাহারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্র। বাংলাদেশের হিংসার বিরুদ্ধে, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণমাধ্যম অসাধারণ কাজ করছে। বাংলাদেশের মানুষ এবং সংবাদ মাধ্যমের মৌলিক জায়গাটা আছে আমাদের চেতনায়। এই চেতনার ভিত্তি ‘গণমাধ্যম এবং বাংলাদেশের মানুষ’। বইমেলার মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, বই যে মাধ্যম সেই মাধ্যমকে কোনও মাধ্যম আজ পর্যন্ত অতিক্রম করতে পারেনি। বর্তমান সময়ে উন্নত ‘সামাজিক মাধ্যম’ এসেছে কিন্তু সেই ‘সোশ্যাল মিডিয়াও’ বইকে অতিক্রম করতে পারেনি।’
কলকাতার বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসের প্রথম সচিব (প্রেস) ডঃ মোফাকখারুল ইকবাল সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় খান সেনারা অনেক পত্রিকা অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছিল। পুড়িয়ে দিয়েছিল। তবুও আমাদের বলতে হবে সমাজ বদলতো সংবাদপত্র করবেই। প্রায় ৬১ টা পত্রিকা তখন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশ হত। কলকাতার দু’জন সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আস্তে পারেননি। জীবন দিয়ে প্রমান করেছেন ‘নির্ভীক সাংবাদিক’ বেয়নেটকে ভয় পায় না। তাই আমি আবার বলব গণমাধ্যমের কর্মীরা তাঁদের ভাষায়, কলমে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রশাসনের দায়িত্বের কথা। সমাজ বদলে এইসব কলমচিদের কথা আমরা মনে রাখব।’
১ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বইমেলায় বহু বিশিষ্ট বক্তা বক্তব্য রেখেছেন। ওপার বাংলা থেকে ছিলেন, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক এবং কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মন্ত্রী এবং কলকাতা উপ-দূতাবাস প্রধান জনাব বি এম জামাল হোসেন,  বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক ডঃ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, কলকাতা উপ-দূতাবসের কাউন্সেলর জনাব শেখ শফিউল ইমাম, বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসের উপ রাষ্ট্রদূত জনাব তৌফিক হাসান, দিল্লিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত জনাব ডঃ সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী, বাংলাদেশ ঞ্জান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি জনাব ফরিদ আহমেদ এবং বাংলাদেশ সংস্কৃতি মন্ত্রকের যুগ্মসচিব জনাব সায়মা ইউনিসএই বাংলা থেকে ছিলেন কবি সুবোধ সরকার, কবি এবং দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব পঙ্কজ সাহা , কবি বীথি চট্টোপাধ্যায়, বাচিকশিল্পি জগন্নাথ বসু এবং উর্মিমালা বসু, সাংবাদিক দেবাশিস ভট্টাচার্য, পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড, কলকাতার সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় প্রমূখ।
সংবাদ এবং সংবাদপত্রের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক হিকির গেজেটের সময় থেকেই আছে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিভিন্নভাবে। সেই সব ব্যাখ্যা থেকে জানা যায় বিস্তারিত তথ্য। নিউ ইয়র্ক টাইমস সানডে ম্যাগাজিনের প্রাক্তন সম্পাদক এস নেস্টার মার্কলের কথায়, একজন রিপোর্টার একটি ঘটনার মাত্র ৫০ শতাংশ সংগ্রহ করতে পারেন। এবং সংবাদ লেখার সময় তিনি মাত্র ১২ শতাংশ তথ্যকে ব্যবহার করেন। তবু দৃঢ়চিত্তে আমাদের বলতে হবে ‘সমাজ বদলে গণমাধ্যমের ভূমিকা’-র দায়িত্ব নবীন প্রবীণ সংবাদ মাধ্যমের সব স্তরের কর্মীদের নিতে হবে।                                        

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?