দূষণপ্রবণ ভারত নতুন করে ভাবছে ভাবাচ্ছে




দীপেন্দু চৌধুরী 
শহর কলকাতার দূষণ নিয়ে আম আদমি কতটা সচেতন? হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ফেসবুক আত্মীয়, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি। বলতে চাইছি, ওইসব সামাজিক মাধ্যম যারা ব্যাবহার করেন তাঁদের মধ্যে একটা গোষ্ঠীগত আত্মীয়তা হয়েছে বললে কি বাতুলতা হবে? বড্ড গরম পড়ছে, অথবা আগে এতো বৃষ্টি হতনা। এখন বর্ষার সময় বৃষ্টি হয় না। বৃষ্টি হয়, বৃষ্টি হয় দুর্গাপুজোর সময়। অর্থাৎ শরৎ ঋতুতে। বেশির ভাগের মুখে এই ধরণের সংলাপ শুনতে আমরা অভ্যস্ত। কেউ কেউ বলেন বটে এটা ‘গ্লোবাল ওয়ারমিং’-র জন্য হচ্ছে। ওই পর্যন্ত।  কলকাতার বায়ুদূষণ এবং বায়ুদূষণের কারণ নিয়ে নাগরিক কলকাতা খুব বেশি মাথা ঘামাতে চায় না। ‘ খাও-জিয়ো-পিয়ো’ গতিশীল নাগরিক কলকাতা নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। ব্যতিক্রম ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার কলকাতা’-র  (Friday’s for Future Kolkata) তরুণ কর্মীরা। এবং এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন কলেজের পরিবেশ সচেতন ছাত্র-ছাত্রীরা।
কুয়াশাচ্ছন্ন দিল্লীর দিল্লিকে নিয়ে পরিবেশবিদ, সরকারি কেরানি, তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার আধিকারিকদের চিন্তা করতে দেখা যায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশককে ‘পরিবেশ রেনেসাঁ’ (Global Environment Renaissance) হিসেবে ভাবতে হবে। ‘বিশ্ব পরিবেশ নবজাগরণ’-ও বলা যেতে পারে। আমাদের চিন্তা আরও বাড়িয়েছে মার্চ মাসে প্রকাশিত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার রিপোর্ট। গ্রিনপিস নামে ওই সংস্থাটির রিপোর্টে দেখাচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত রাজধানী দিল্লি। এই তালিকায় ভারতের চিন্তা আরও বাড়িয়েছে গুরুগ্রাম।
বিশ্বের বায়ুসূচকের মানদণ্ডে ২০১৮ সালে সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় প্রথমস্থানে রয়েছে গুরুগ্রাম। এশিয়ায় পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ বাদ দিলে পাঁচটি শহরই ভারতের। গ্রিনপিস সংস্থার রিপোর্ট বলছে, ভারতের সবথেকে দূষিত শহর পাঁচটি হচ্ছে গুরুগ্রাম, গাজিয়াবাদ, ফরিদাবাদ, নয়ডা এবং ভিওয়ান্ডি। ২০১৮ সালের সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে সারা বিশ্বের ২০টি দূষিত শহরের মধ্যে ১৮টিই ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের। তালিকায় একাদশ স্থানে রয়েছে দিল্লি। দিল্লিতে ভাসমান ধূলিকণা (পিএম ১০) এবং অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা (পিএম ২.৫) প্রতি ঘনমিটারে ১১৩.৫ মাইক্রোগ্রাম। দূষণ থেকেই উৎপত্তি উষ্ণায়নের। আবোলতাবোল অচেনা এক প্রকৃতির সম্মুখে আমাদের গিয়ে পড়তে হচ্ছে। জুলাই মাসে রাষ্ট্রপুঞ্জ আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও)-এর ‘উষ্ণতর গ্রহে কাজ করা’ নামে একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে ২.২ শতাংশ শ্রমঘণ্টা খোয়াবে বিশ্ব। গরমে ক্লান্ত হয়ে কাজ করতে না পারা অথবা কাজের গতি মন্থর হয়ে পড়ার জন্যই এমনটা ঘটবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ওই সংগঠনটির রিপোর্ট আরও বলছে, ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি সবচেয়ে চিন্তার বিষয়।
চলতি বছরের ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’ চলাকালীন একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখিত রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে দূশণ-তালিকায় ১৭৭ নম্বরে ঠাঁই পেয়েছিল ভারত। ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার ২০১৯’ রিপোর্ট থেকে জানতে পারা যাচ্ছে, বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর ভারতে প্রাণহানি ঘটছে ১২ লক্ষ মানুষের।    
কলকাতা পরিবেশ নিয়ে আমরা কতটা সচেতন?  ‘ইন্টারগর্ভমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (আইপিসিসি) ভবিষ্যৎবাণী করেছে, কলকাতা সব থেকে বিপন্ন শহর হতে চলেছে ঢাকা এবং দিল্লি শহরকে ছাপিয়ে। ২০৭০ সালে কলকাতা শহরটা বিশ্ব মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে পারে যদি আমরা এখন থেকে সতর্ক না হই। কলকাতায় দূষণের মূল কারণগুলি হল কয়লার থেকে উৎপন্ন গ্যাস, জ্বালানি তেল এবং জৈব গ্যাস। কলকাতা শহরেও অতিসূক্ষ্ম ধূলিকণা পিএম ২.৫। এই বছরের ৪ জুন পরিবেশ দিবসের দিন কলকাতা আমেরিকান সেন্টারের একটি অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের বিঞ্জানী ডঃ রিতা সাহা একান্ত সাক্ষাৎকারে জানান,
‘’দিল্লিতে শব্দবাজি নিয়ন্ত্রণ করা শুরু হয়েছে। ‘বায়োক্রাকারস’ আগামী বছর থেকে শুরু করা হবে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যৌথ উদ্যোগ নিচ্ছে। কলকাতার রাস্তায় উনুন জ্বালানো বন্ধ করা যায় কি করে? এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও দূষণ নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করবে। বিদ্যুৎ ব্যবহারে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। ২০২৪ সালে ভারতের সমস্ত প্রথমসারির শহরে ‘ক্লিন কার’ চালানোর নীতি কার্যকর করা হবে ‘স্বচ্ছ ভারত মিশন’- প্রকল্পে। জলবায়ু পরিবর্তনের ন্যাশন্যাল অ্যাকশ্যান প্ল্যান প্রকল্পে এই কাজগুলি হবে।‘’
কলকাতা শহরের বায়ু দূষণের আরও একটি কারণ প্ল্যাস্টিক বর্জ্য পোড়ানো। কলকাতার ধাপা অঞ্চলের অবস্থান কলকাতা পুরসভার ৫৭ এবং ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়ে। পুরনো ধাপার এলাকা ছিল ১২.১৪ হেক্টর এলাকা জুড়ে। কলকাতা পুরসভার একমাত্র বর্জ্য ফেলার এই দ্বিতীয় এলাকাটির আয়তন ২৩ হেক্টর জমিতে। ১৯৮৭ সালে প্রথম ‘ওয়েস্ট ডাম্পটি’ বন্ধ করে বর্তমানে কলকাতা পুরসভার সব থেকে বড় জঞ্জাল ফেলার জায়গাটি শুরু করা হয়। দ্বিতীয় ধাপায় প্রতিদিন ৪৫০ টন জঞ্জাল ফেলা হয়। পরিবেশবিদদের দাবি কলকাতায় ধাপার জঞ্জাল (বেশিটাই প্লাস্টিক বর্জ্য বা জৈব) পোড়ানোর কারণে বায়ু দূষণ বেশি মাত্রায় হয়।
কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রে খবর, প্রতিদিন গড়ে ৪২৬ টন, মাসে আনুমানিক ১২, ৭৮০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য ধাপায় ফেলা হয়। ধাপার মাঠের অবস্থা অগ্নিগর্ভ। গত তিন দশকের সঞ্চিত জৈব আবর্জনার পচন থেকে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে। ওই গ্যাস দাহ্য প্রকৃতির। কয়েক দশকের সঞ্চিত গ্যাস থেকে যে কোনও সময় অগ্নিকান্ড ঘটে যেতে পারে। এই সমস্যা যেমন আমাদের তিলোত্তমা শহর কলকাতার পাশাপাশি আমাদের দেশের অন্যান্য শহরেও জঞ্জালের জন্য নাগরিকরা বিপন্ন। এখনই সতর্ক না হলে আগামী দিনে আমাদের বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে হয়ত        
দিল্লীর পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রমেন্ট’ (সিএসই) রিপোর্ট বলছে দেশে ১৯৫১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোটরযান নথিভুক্তি ৭০০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ছয় দশকে, অর্থাৎ ২০০৮ সাল পর্যন্ত যানবাহনের সংখ্যা ছিল ১০ কোটি ৫৩ লক্ষ। পরের আট বছরে, আরও সারে আট কোটি মোটরযান নথিভুক্ত হয়েছে। এটাকে কি বলা হবে যান বিস্ফোরণ?  
ভারত সরকারের বন-পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রকের রিপোর্ট থেকে আমরা জানতে পারছি, বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে দেশের ৭৩টি শহরে ২৪ ঘণ্টা বাতাসের গুণমান পরীক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছে ১৩৭টি ‘মনিটরিং স্টেশন’। উপযুক্ত পদক্ষেপ করায় দিল্লিতে বায়ুদূষণের মাত্রা ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে অনেকটাই কমেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ মন্ত্রকের রিপোর্টের সঙ্গে পরিবেশবিদরা একমত হতে পারছেন না। তাঁদের বক্তব্য কাগজে কলমে বলে লাভ নেই। কাজ করে দেখাতে হবে।
গাঁন্ধিজীর দেড়শো-তম জন্মবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বন্ধ করার জন্য ২০২২ সালকে লক্ষমাত্রা হিসাবে ঘোষণা করেছেন। প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার স্বচ্ছ ভারত মিশন প্রকল্পের বাজেটের ৮০ শতাংশ টাকা খরচই করতে পারেনি। ২০১৮-২০১৯ আর্থিক বছরের যে বাজেট পরিবেশ মন্ত্রকের ছিল সেই বাজেটের মাত্র ২০ শতাংশ খরচ হয়েছে। এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের বিঞ্জানী ডঃ রিতা সাহার কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বিষয়টার সঙ্গে একমত হয়ে বললেন, ‘মন্ত্রকের আধিকারিকদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম সীমাবদ্ধতা থেকে যায়। বাজেট পাশ হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থ অনুমোদন হতে সময় লাগে। এই কারণে আমরা বাজেটের সব অর্থ কাজে লাগাতে পারি না।’ কলকাতা সহ সারা ভারতের নারিকদের সচেতন হওয়ার সময় হয়েছে। এবং দায়িত্ব নেওয়ার কথাও আমাদের প্রত্যেক নাগরিকদের ভাবতে হবে। রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘’বিশ্বের পরিবেশ নিয়ে আমরা অনেকেই ভাবছি। এটা ঠিক তবে বিশ্বের যা পরিস্থিতি, তাতে পড়ুয়াদের সচেতনতা বাড়াতে পরিবেশবিদ্যা আবশ্যিক হওয়া প্রয়োজন। বাংলার স্কুল এবং কলেজের পাঠ্যক্রমে পরিবেশবিদ্যা বাধ্যতামূলক হয়েছে আগেই।‘’                      
 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?