ওরা চেনা পথে বসে থাকে হেঁটে যায়
দীপেন্দু চৌধুরী
মাস দুয়েক আগে হবে সম্ভবত। থিয়েটার রোড দিয়ে হাঁটছি, ময়দান হয়ে প্রেসক্লাব
যাব। অরবিন্দ ভবনের উল্টোদিকের ফুটপাথ ধরে হাঁটছি। হঠাৎ শুনতে পেলাম, কেউ একজন
বলছে, ‘আমাকে কিছু খাওয়াবেন’? স্পষ্ট বাংলায়। সুস্পষ্ট এবং দৃঢ় উচ্চারণে। মুখ
ঘুরিয়ে দেখলাম হ্যা আমাকেই বলল। ছ’ফুট লম্বা একজন মানুষ। একমুখ কুচকুচে কালো দাড়ি,
কোঁকড়ানো চুল। টিকালো নাক। চওড়া কপাল। একটা ছেড়াঁ, ময়লা তেল চিট চিটে প্যান্ট পরে আছে। গায়ে কোনও জামা না থাকার জন্য কালো ময়লা লোমে ঢাকা বুক দেখা যাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখে খুব আস্তে আবার আমাকে বলল,
‘আমাকে কিছু খাওয়াবেন’? আমি আবার ভালো করে লোকটাকে দেখলাম। গ্রীক দেবতাদের মতো মুখের
অবয়ব। আমি শিউরে উঠলাম। লোকটাকে আমার খুব চেনা মনে হল। কয়েক মিনিট থমকে দাঁড়ালাম।
শেষ পর্যন্ত মুখ ঘুড়িয়ে নাগরিক কলকাতার শহরে নিজেকে ভিড়িয়ে দিলাম। এই সংস্কৃতি
আমিও রপ্ত করতে শিখেছি। ক্লাবে গিয়ে একটু ছ্যাবলামো করে বাড়ি চলে যাব।
সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত একটা অপরাধবোধ আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আমি সচেতন
নাগরিক হিসেবে গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে ভিক্ষে দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। একটা সময়
কম বয়সী ভিখিরি ছেলেদের আমরা প্রস্তাব দিতাম, কোনও একজনের কাছে কাজের। কারও বাড়িতে
অথবা কারও দোকানে। আজ পর্যন্ত এমন একজনকেও পাইনি যে রাজি হয়েছে। কিন্তু এতো মানবিক
আবেদন। আবার আমারমতো একজন হাভাতে ব্যক্তির কাছে লোকটি খেতে চাইছে। একবার ভেবেছিলাম
লোকটা কি আমার পূর্ব পরিচিত কেউ? আমার পুরনো
বন্ধু? আত্মীয়? থিয়েটার রোডের অভিজাত নাগরিক ফুটপাথে সেদিন কত শত লোক আসা
যাওয়া করছিল। না লোকটা কারও কাছে আবেদন করেনি। অন্তত সেই সময়টাই। মাত্র দু’বার
মৃদুস্বরে আমাকেই বলেছিল, ‘আমাকে কিছু খাওয়াবেন?’ সত্যি সত্যি বলছি বিশ্বাস করুন
এক চোখ দিয়ে শুনিনি। দু’কান দিয়ে শুনেছি। আমি খাওয়ায়নি। কটাকা খরচ করতে হত? পঁচিশ
থেকে তিরিশ টাকা! পাপে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু অপরাধ? আজও একটা অপরাধবোধ কাজ
করছে। পিতৃপক্ষের শেষ সময়ে আমি হেরে গিয়ে ফিরে এলাম!
পরে বুঝেছি কলকাতা শহরে ঘুরে বেড়ানো একজন শিক্ষিত ‘পাগল’ হয়ত। এরকম কতজনকে আগেও দেখেছি পরেও আবার দেখলাম। মাত্র এক সপ্তাহ আগে বৃষ্টিস্নাত অমলিন সন্ধ্যায় শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে
হাঁটছি। প্রাচী সিনেমা হলের কিছুটা আগে। লোরেটো স্কুলের ফুটপাথে একটা খালি চৌকিতে
আরও একজন সেদিন বসেছিল। আগেরদিন যে লোকটাঁকে দেখেছিলাম ঠিক সেই রকম। একই আদল, মুখে
নিরাপরাধ হাসি। চকচকে সাদা দাঁত। দাঁতে কোনও ময়লা নেই। চওড়া গোলাপি ঠোট। শিল্পীর
তুলিতে আঁকা মনে হচ্ছে। এক গাল কুচ কুচে কালো লম্বা দাড়ি। কোঁকড়ানো পাটে রঙ করা
চুলেরমতো কালো চুল। চ্যাটচেটে আঠারমতো চুলগুলো আলুথালু। মানুষটা একটা খালি চৌকিতে
বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছে। মাথার উপর ময়লা পলিথিন ছাউনি থেকে টুপ টুপ করে
ধুলোমাখা জল পড়ছে। পাশের দোকানটায় রুটি তৈরি হচ্ছে। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে সদ্য পুজোর
বোনাস পাওয়া মানুষেরা রুটি সবজি খাচ্ছে। আকাশের ভাসা মেঘ সরে গিয়ে ছোট ছোট তারাদের
আকাশে জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। এমন সময় বছর পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের এক যুবক ‘পাগল’ পাগল
দেখতে লোকটাকে বলল, ‘ভিখু রোটি খা লে না? ঠিক হ্যায়? ভিখু যিতনা রোটি-সবজি খানা
হ্যায় খা লে— না। ঠিক হ্যায়?’
ভিখু উত্তর না দিয়ে শুধু মাথা দোলাতে দোলাতে হাসল। আমি দূর থেকে লোকটাকে
দেখলাম। আগের দিনের সেই মানুষটা নয়ত? এঁদেরমতো কাউকে আবারও দেখব নিশ্চয়। কিন্তু ওই লোকটা, হ্যা সেদিনের সেই
লোকটা আমার কাছে কেন খেতে চাইল? মাথার উপর থেকে শুধু হুতোমের গলা শুনতে পেলাম।
হুতোম বলছে, ‘লেখাপড়া করে যে ‘পাগল’ হয়ে ফুটপাথে ঘোরে সে! কে বলেছে তোকে ভাবতে?
বেশি ভাবলে পাগল বলবে!’ আমি মনে মনে বললাম হা দুর্গা, হা অসুর, ভাবতেতো
দেশ-বিদেশের সব মহাপুরুষরা বলেছেন। হুতোম বৃষ্টিতে ভেজা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে আলো
আঁধারি জ্যোৎস্নায় ফিচেল হাসি হেসে চলে গেল। আমি আবার ভাবছি। কতদিন যে স্নান করেনি
মানুষটা, ভালো জামা পড়েনি। কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্যের ‘বেকারের চিঠি’ কবিতায় আছে, ‘’এতদিন
চাকরি খুঁজেছি। পাইনি।/ এবার ভাবছি আমরাই আপনাদের চাকরি দেবো।/ আমরা যারা বেকার আধাবেকার ভবঘুরে/
বাউন্ডুলে ভিখিরি—/ যাদের জমি নেই কিন্তু জমিতে খাটে—/ বাড়ি বানায় কিন্তু বাড়ি নেই—/.............../
যারা কোনদিন একটা ভালো জামা পরেনি, / সরবত খায় নি, বেড়াতে গিয়ে পর্বতমালার স্তব্ধ
নিরাসক্তি ও মহত্তবকে/ স্পর্শ করেনি.........।‘’ মানুষটা কি ওই দলের? তবে ‘পাগল’
অবশ্যই। পাগলেরা জানতাম চিৎকার করে। উত্তর বিশ্বায়ন যুগে ‘সত্য উত্তর’ সময়ের
পাগলরা কি কম কথা বলে? উত্তর ভবিষ্যতে খুঁজব।
Comments
Post a Comment