শুন্য পরিসরে নতুন পথের খোঁজে দুই দল
দীপেন্দু চৌধুরী
সত্যিইতো গণতন্ত্রে উত্তরাধিকার বলে কিছু হয় না।
আলোচনা হয়, বিতর্ক হয়, কূটচালে কূটনৈতিক বিতর্ক হয়। ভারতের ক্ষেত্রে এই বিষয়ে আরও
সুবিধা হয় যখন ‘নেহরু-গাঁধি’ পরিবারকে আক্রমণ করা হয়। উদাহারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে
কয়েক দশক ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে এই পরিবারের সদস্যরা বসেছেন এবং দেশ
শাসন করেছেন। রাজনৈতিক বিশেষঞ্জদের অভিমত ইন্দিরা গাঁধি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন
জহরলালের কন্যা বলে নয়। না কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির অধিকাংশ ভোটেও নয়।
সেসময় ভোট গণনাই হয়নি। কামরাজ আড়ালে দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে বলেন,
কনসেনসাস ইন্দিরার পক্ষে। একই ঘটনা রাজীব গাঁধির ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি। ইন্দিরা
গাঁধি দু’বছর কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে অভিঞ্জতা অর্জন
করেছিলেন। রাজীবের তেমন অভিঞ্জতা ছিল না। মন্ত্রীসভার কোনও অভিঞ্জতা ছাড়াই তিনি
সরাসরি প্রধানমন্ত্রী। তবে বিচক্ষণতায় তিনি কারও চেয়ে কম ছিলেন না। শক্ত হাতেই
দেশের হাল ধরেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও রাজীব প্রশংসা পেয়েছিলেন তাঁর দক্ষতার
কারণে।
ভারতে ‘কংগ্রেস হাইকমান্ড’ নামক শব্দবন্ধের ব্যবহার
সংবাদ মাধ্যমে প্রায় নেই বললেই চলে। সংবাদ মাধ্যম কি ভুলে গেল? কংগ্রেস নামক একটি
শতাব্দী প্রাচীন জাতীয় দলের কেন্দ্রীয় কমিটি আছে। হাইকমান্ডও আছে। সাময়িকভাবে কংগ্রেস গোষ্ঠী দ্বন্দে ছন্নছাড়া।
বিদীর্ণ, দিশাহীন, পরস্পরের প্রতি এক অঘোষিত অসামরিক যুদ্ধে নেমেছে মনে হচ্ছে।
দেশের যে রাজ্যের দিকে তাকানো যাচ্ছে কংগ্রেস দলের আভ্যন্তরীণ সংঘাত নজরে আসছে।
বিজেপি নামক দলের এক বা দু’জন দোর্দণ্ড প্রতাপ নেতার ‘হিন্দু, হিন্দি,
হিন্দুস্থান’ হুঙ্কারে কংগ্রেস সহ সমস্ত বিরোধী দল চক্রব্যুহ থেকে বেরনোর রাস্তা
খুঁজে চলেছে। রাস্তা খুঁজে না পেলে অনেক নেতাই বিজেপির অর্থ এবং রণকৌশলের কাছে
একরকম আত্মসমর্পণ করে বসছে।
ইতিহাস থেকে আমরা পাচ্ছি, তিনশো বছরের কিছু বেশি
হবে, ত্রিশ বছরের যুদ্ধের পর জার্মানদের মধ্যে এই মর্মে একটা বোঝাপড়া হয়ে যায় যে
রাজা প্রটেস্টান্ট হলে প্রজারাও হবে প্রটেস্টান্ট আর রাজা ক্যাথলিক হলে প্রজারাও
হবে ক্যাথলিক। অর্থাৎ রাজধর্মই প্রজাধর্ম। যাদের বিবেকের আপত্তি আছে তারা রাজ্য
ছেড়ে চলে যেতে পারে। একুশ শতাব্দীর জার্মান উন্নয়ন এবং উন্নত গণতন্ত্রের কথা বলে
ধর্মকে অবলম্বন করেই। বর্তমান ভারতের কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পাচ্ছি কি? সত্যকে আড়াল
করবে কোন দল? কংগ্রেস, সিপিএম? অথবা আমাদের রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস?
আমাদের দেশে একটা সময় প্রচলিত লব্জ ছিল ‘সে রামও
নেই, সে অযোধ্যাও নেই’। কিন্তু বর্তমান ভারতে কি আমরা সে কথা আর বলতে পারব? যতই
ভারতে বেকার বৃদ্ধির কথা বলি, মুল্যবৃদ্ধির কথা বলি, বড় বড় নামী দামি কোম্পনীর
শ্রমিক কর্মচারী ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদের সর্পিল ট্রেডইউনিয়ন আন্দোলন হোক। তবু বলতে
হবেই ভারতে রামরাজ্য গড়ে তোলার পথে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন ‘মোদী-শাহ’-র যুগলবন্দী।
হনুমানের ভূমিকায় সেতু বন্ধনের কাজটা করছেন যোগী আদিত্যনাথ। চলতি বছরের লোকসভা
ভোটে দ্বিতীয় দফায় তিনশোর বেশি আসন নিয়ে লোকসভায় মন্রীসভা গঠন করেছে বিজেপি। বিজেপির
দুই শীর্ষ নেতা ‘মোদী-শাহ’-র নেতৃত্বে বিজেপি সহ সঙ্ঘ পরিবারকে আরও বেশি
আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। রাজতন্ত্রের যুগে ধর্মের সঙ্গে একটা পারস্পরিক সম্পর্ক
বজায় রাখত রাজারা। ধর্ম রক্ষা করবে রাজতন্ত্রকে রাজতন্ত্র রক্ষা করবে ধর্মকে।
কিন্তু ভারত নামক ধর্মনিরপেক্ষ একটি বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশে এই জিগির কতদিন? ভারতে
প্রধান বিরোধী দল বিভ্রান্ত ধরে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরাসরি ‘নেহরু-গাঁধি’
পরিবারকে ধারাবাহিক আক্রমণ শানিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কয়েক
মাসের মধ্যে সংসদে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘’বাকী সব বিষয়ে আমার ঞ্জান
সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি নিয়ে সন্দেহ না করাই
ভাল।‘’
রাজনীতি এবং কূটনীতিতে সাময়িক কৌশল যেমন
‘ছারপোকা’-র সঙ্গে তুলনা করা যায় আবার দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক কর্মসূচী বিষাক্ত সাপের
ছোবল বলতে হবে। ভারতে ৩৭০ এবং এনআরসি নিয়ে বিরোধীরা সাপ-লুডুর খেলায় চক্কর কাটছে।
ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা, গণপিটুনির মতো বিষয়গুলি নিয়ে মাস কয়েক আগে সৌমিত্র
চট্টোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, রামচন্দ্র গুহ-সহ ৪৯ জন বিশিষ্ট জন প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদীকে খোলা চিঠি লিখেছিলেন। এঁদের বিরুদ্ধে বিহারের সদর থানায় শান্তিভঙ্গ-সহ বিভিন্ন অভিযোগে এফআইআর করা হয়। গাঁধি-নেহরু
পরিবারের সদস্য তথা কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গাঁধি প্রতিবাদে সোচ্চার হন।
তিনি বলেন, ‘’দেশে কী চলছে তা সকলেই জানেন। এর মধ্যে কোনও গোপনীয়তা নেই। এমনকি,
গোটা বিশ্বও তা জেনে গিয়েছে। আমরা ক্রমশ স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগোচ্ছি।‘’ কংগ্রেস দল
যখনই সমস্যায় পড়েছে আলোচ্য পরিবারের কোনও নতুন সদস্য সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
নব্বই দশকের পরবর্তী অভিঞ্জতা আমাদের মনে আছে। এবং ২০০৪ সালে ইউপিএ গঠন। ইউপিএর
চেয়ারপার্সনের দায়িত্বে সনিয়া গাঁধি দশ বছর সরকার চালিয়েছেন। কংগ্রেসের প্রবীণ
কয়েকজন সদস্য সে সময় অন্তর্ঘাত করতে চেষ্টা করেছিলেন। সনিয়া গাঁধির প্রবল ব্যক্তিত্বের
জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। চলতি বছরে লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পর কংগ্রেস সভাপতির পদ
থেকে রাহুল গাঁধি ইস্তফা দিয়েছেন। অস্থায়ী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সনিয়া
গাঁধি।
সনিয়া গাঁধি অসুস্থ শরীর নিয়ে কংগ্রেসের হাল ধরার
পরে শতাব্দী প্রাচীন দলটার ‘অন্তরদ্বন্দ’, দলীয় আভ্যন্তরীণ কলহ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে।
দু’ই রাজ্যের ভোট মিটলে কংগ্রেস ‘নবীন-প্রবীন’ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আস্তে পারবে।
এমন আশা করাটা নিশ্চয় বাতুলতা হবে না? রাহুল গাঁধির আবার সভাপতির দায়িত্বে ফেরাটা
সময়ের অপেক্ষা। হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্রে বিধানসভার ভোট মিটলে কংগ্রেসের ফল যাই হোক,
রাহুল গাঁধি পুনরায় সভাপতি পদে পুনর্বহাল হতে বাধ্য। দলীয় কর্মীদের দাবী মেনে। এবং
কংগ্রেসে রাহুল ব্রিগেডও নতুন করে অক্সিজেন পাবে। লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনের আগেই
কংগ্রেস নামক দলটিকে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা নিতে দেখা যাবে। যার প্রস্তুতি
আমরা আমাদের রাজ্যে কংগ্রেসের আন্দোলন দেখে টের পাচ্ছি। ১৯-২০ অক্টোবর প্রদেশ
কংগ্রেস অফিসে হয়ে গেল দু’দিনের কর্মশালা। এবং ১৯ অক্টোবর এনআরসি চালুর প্রতিবাদে
পথে নেমে প্রতিবাদ জানায় প্রদেশ কংগ্রেসের সংখ্যালঘু সেল। বিধায়ক তথা সংখ্যালঘু
সেলের চেয়ারম্যান মিল্টন রশিদের নেতৃত্বে ধিক্কার মিছিল হয়। বাংলায় কংগ্রেস শুন্য
পরিসরে নিজেদের উপস্থিতি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের নেতৃত্বে প্রমাণ
করতে চাইছে। রাজ্যে এই আন্দোলনে যুব নেতৃত্বের ভূমিকাকে ছোট করে দেখলে চলবে না।
ইন্দিরা, রাজীব এবং সনিয়া গাঁধির উত্তরসূরী হিসেবে
রাহুলের উপর কনসেনসাস থাকবে। দলীয় সূত্র বলছে, লোকসভা ভোটের পরেই হারের দায়িত্ব
নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন রাহুল গাঁধি। এবং সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন
তিনি। এই ঘটনা কংগ্রেস দলে ব্যতক্রমী উদাহারন। কংগ্রেস এমনই একটি দল নেহরু-গাঁধি
পরিবারের সদস্যদের নেতৃত্ব ছাড়া চলতে পারে না। বৃহৎ শিল্পপুঁজির মালিক গোষ্ঠী এবং
বানিয়া গোষ্ঠীর এক্ষেত্রে সুবিধাও হয়। বৃহৎ ভূস্বামীরাও কংগ্রেস নেতৃত্বকে চেনে।
তাছাড়াও আছে অতীত অভিঞ্জতা। স্থিতিশীল এবং ধর্মনিরপেক্ষ সরকার।
অতীত অভিঞ্জতা মনে রেখেই সিপিএমের নেতৃত্বে বামেরা
গণ-মঞ্চ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শুন্য পরিসরে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে
রাখতে কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ মঞ্চ গড়ে তুলতেও আপত্তি নেই সিপিএমের কেন্দ্রীয়
নেতৃত্বের। কংগ্রেসের আহ্বানে ইতিমধ্যে বিধান ভবনে গিয়ে মিটিং করে এসেছেন সিপিএম
দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র এবং বর্ষীয়ান নেতা বিমান বসু। ভারতের কমিউনিস্ট
পার্টি গড়ে ওঠার শতবর্ষ পূর্তির সূচনা অনুষ্ঠানে ১৭ অক্টোবর সিপিএমের সাধারণ
সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, ‘মোদী-অমিত’ শাহদের জমানায় গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ
যে সব শক্তি ও ব্যক্তি একমত হবেন, তাঁদের নিয়ে মঞ্চ গড়ে তুলতে চাই আমরা। গণ-মঞ্চই
এখন প্রতিরোধের পথ।‘’ সিপিএমের নেতাদের বক্তব্য ২০১৮ সালের পার্টি কংগ্রেসে বাংলার
নেতাদের পক্ষে সওয়াল করে কংগ্রেসের পক্ষে সমঝোতার রাস্তা খুলেছিলেন ইয়েচুরি।
আমাদের রাজ্যে কংগ্রেস-সিপিএম (বামেদের) নতুন মঞ্চ
গড়ে তোলার প্রয়াসকে সাধুবাদ জানিয়েও বামফ্রন্ট নেতৃত্বের কেউ কেউ বলছেন, ২০০৪
সালের ১৮ সেপ্টেম্বর একটি মঞ্চ গড়ে তোলা হয়েছিল। কংগ্রেস, পিডিএস, ইউসিপিআই-র
সম্মিলিত তিনটি দলের মঞ্চ। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষ দলের সমন্বয় কমিটি’ (coordination
Committee of Secular Parties)। সেদিনই তিন দলের নেতৃত্বে বিধান ভবনে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে সিসিএসপি
গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়। সিপিএম কি এই ধরণের কোনও কমিটি
প্রদেশ কংগ্রেসের সঙ্গে গড়ে তোলার দায়িত্ব নেবে? ২০২১ সালে বিজেপিকে আটকাতে সিপিএম-কংগ্রেসকে
ভাবার কথা তাঁরা মনে করিয়ে দিতে চাইছেন।
Comments
Post a Comment