পদাতিক কবি এবং শব্দ ফকিরের ঝোলা
দীপেন্দু চৌধুরী
সময় যখন হারিয়ে যাচ্ছে, জীবন থমকে আছে, নতুন শতাব্দীর গতিশিল চলমান কলকাতার
ফুটপাথ আলিঙ্গন করতে চায়। ‘আমার বাংলা’ একুশ শতাব্দীর সবুজ
পাতার প্রচ্ছদে নতুন নতুন ভাষায় ফিরে ফিরে আসে। নীল-সাদা, সাদা-নীল সভ্যতার নতুন
নতুন প্রচ্ছদের আঁকিবুঁকিতে। ঋতুর বৈচিত্রের খোঁজে কেউ আকাশের দিকে চেয়ে বলে,
‘যেখানে আকাশ চিকন শাখায় চেরা/ চলো না উধাও কালেরে সেখানে ডাকি;/ হা-হতোস্মি সড়কে
বেঁধেছি ডেরা,/ মরীচিকা চায় বালুচারী আত্মা কি?’ (পদাতিক, সুভাষ মুখোপাধ্যায়)। ১৯৪০ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’। যত সময় গেছে সুভাষ কবি প্রাক্তন না
হয়ে আধুনিক হয়েছেন। কারণ তিনি ড্রয়িংরুমে বসে মানুষের কথা বলতে চেয়েছেন বা লিখে
গেছেন এমনটা কেউ কি মেনে নিতে পারে? দাবি করতে পারে?
২০১৯ সালটা শুরুই হয়েছিল কবি
সুভাষ মুখোপাধ্যায় জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের শপথ বাক্যে। ‘সালেমনের মা’-য়ের খোঁজে। বছরের
শুরুতে ‘সপ্তাহ’ (সুভাষ মুখোপাধ্যায় একটা সময় সম্পাদক ছিলেন) পত্রিকা এবং দে’জ
প্রকাশনীর যৌথ উদ্যোগে ‘ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট’ সভাঘরের অনুষ্ঠান দিয়ে। যার কথা
আজকের নাগরিক কলকাতা বারে বারে উচ্চারণ করছে, যার শব্দনদীতে স্বমহিমায় বর্তমান কবি
এবং বর্তমান সময়ের উজ্জ্বল অতি উজ্জ্বল বিদ্বজ্জনেরা ডুবসাঁতার দিতে চাইছেন,
প্রশ্ন উঠছে সেই বাবরি চুলের ‘পদাতিক’ কবির জীবদ্দশায় তাঁরা কোথায় ছিলেন?
প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে অধ্যাপক পবিত্র সরকারের আত্মসমালোচনায়। তিনি বলেন, ‘’সুভাষদাকে
নিয়ে যারা বিরুপ সমালোচনা করেছেন তাঁদের বলতেই হয় যে সুভাষের কবি স্বত্বা নিয়ে
তাঁদের সমালোচনা করার অধিকার নেই।‘’
আমরা মনে করতে পারি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। তিনি বলে গেছেন, কবি সুভাষ
মুখোপাধ্যায়র মধ্যে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত কবি স্বত্বা। তিনি ছিলেন স্বভাব কবি। সম্ভবত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও যেটা বিশ্বাস করতেন। তাই হয়ত তিনি কবি সুভাষকে বলেছিলেন,
‘আমি তোমারমতো কবিতা লিখতে পারব না।’
কবি সুভাষ মুখোপাধযায় গানের ডালি হাতে পরমহৃদ, একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু গায়ক
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পথ চলতে চলতে কয়েকজন ফকিরের ঝোলা খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই
ঝোলা থেকে শব্দের জাদু হয়ে বাংলা কবিতার জন্ম হতে থাকে সুভাষের কলমে। মানবিক কলমে। ধারালো কল্লোলিত কলমের অনুভবী
আঁচড়ে। সুভাষ লেখেন পার্টির টান নারীর টানের থেকেও বেশি। সেই পার্টি একদিন সুভাষকে
ব্রাত্য করে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তবু তাঁর ফকিরের ঝোলা শুন্য হয় না। সুভাষের সেই
কবিতা আজও আমাদের তাঁর সঙ্গে যাপন করতে আহ্বান জানায়। আমরা শিহরণ অনুভব করি,
সুভাষের ফকিরের ঝোলার স্বাভাবিক শব্দ চয়নের চৌকাঠ অতিক্রম করতে করতে।
সম্প্রতি সাহিত্য অকাদেমী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত কবি সুভাষ
মুখোপাধ্যায় জন্ম শতবার্ষিকী আলোচনা সভায় উঠে এলো পদাতিক কবির প্রাসঙ্গিকতা। ১৮
এবং ১৯ সেপ্টেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাদম্বিনী সভাগৃহে দু’দিনের তথ্যসমৃদ্ধ
এই আলোচনা হল। হারিয়ে যাওয়া পদাতিক কবি সুভাষ শুধুমাত্র নন। আলোচনায় উঠে এলো ‘শব্দ
ফকিরের ঝোলা’-র প্রসঙ্গ। আলোচনার সুরটা প্রথম দিনেই বেঁধে দিয়েছিলেন সাহিত্য
অকাদেমির সহ-সভাপতি মাধব কৌশিক। তিনি বলেন, ‘’কলকাতায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় নিয়ে যতটা
আলোচনা হয় সারা ভারতে সেই উচ্চতায় আলোচনা হয়নি। মাত্র দুটো বই (কাব্য গ্রন্থ)
হিন্দিতে অনুবাদ হয়েছে। ১৯৯১ সালে ঞ্জানপীঠ পুরষ্কার পাওয়ার পরে একটা এবং সাহিত্য
অকাদেমি পুরষ্কার পাওয়ার পরে দ্বিতীয় বই। সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরমতো কবির কবিতা সারা
ভারতে অনুবাদ করে প্রকাশের প্রয়োজন আছে। আলোচ্য কবির সব কবিতা একটা বইয়ে এনে
প্রকাশ করতে পারলে তবেই পূর্ণাঙ্গ মুল্যায়ন হবে।‘’
মাধব কৌশিক এদিন কবিরের দোহা উল্লেখ করে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার
চিরন্তন উপস্থিতির কথা বলেন। ‘চাহে যিতনি দূর যাও’ শিরোনামে হিন্দি কবিতার সংকলন
প্রকাশ করে সাহিত্য অকাদেমি এবং ‘অগ্নিপথ’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে ঞ্জানপীঠ
সংস্থা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার উল্লেখিত দু’টি বইয়ের কবিতার হিন্দি অনুবাদ করেন রঞ্জিত সাহা। নবভারত টাইমস
সহ বিভিন্ন হিন্দি জার্নালেও তাঁর কবিতার হিন্দি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
প্রথমদিন স্বাগত ভাষণে সাহিত্য অকাদেমির সচিব কে শ্রীনিবাস রাও বলেন,
‘’পদাতিক কবি, মানবিক এবং রাজনৈতিক সচেতন কবি ছিলেন তিনি। সংগ্রামী মানুষের জন্য
কবিতা লিখে গেছেন কবি সুভাষ মুখোপাধযায়।‘’ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে বক্তব্য রাখেন
বিশিষ্ট ওড়িয়া কবি এবং সাহিত্য অকাদেমির ফেলো জয়ন্ত মহাপাত্র। তিনি বলেন, ‘’কবি
সুভাষ মুখোপাধযায় আমার কাছে প্রথম কবি যিনি আমাকে অন্ধকার থেকে আলোয় আসার কথা
বলেছিলেন। আমি আনন্দ, ভালোবাসার কথা শুনেছি তাঁর কবিতায়।‘’ পরের বক্তা ছিলেন
বিশিষ্ট বিদ্বজ্জন স্বপন চক্রবর্তী। অধ্যাপক চক্রবর্তী কলকাতার ন্যাশন্যাল
লাইব্রেরির ডাইরেক্টর জেনারেলের দায়িত্ব সামলেছেন কয়েক বছর। পরে তিনি প্রেসিডেন্সি
বিশ্ববিদ্যালয়ের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ডিসটিংগুইশট মানবিকী বিদ্যার চেয়ার
পদে ছিলেন। চলতি বছরের ৩১ জুলাই অধ্যাপক স্বপন চক্রবর্তী কর্মজীবন থেকে অবসর
নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘’পশ্চিম তথা ইউরোপের কবিদের সঙ্গে একসঙ্গে কবি সুভাষ
মুখোপাধ্যায়ের নাম উচ্চারণ করতে হবে। পশ্চিমের আধুনিকতার সঙ্গে তুলনামূলকভাবে তাঁর
কবিতা আমরা যদি আলোচনা করি তাহলেও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নাম প্রথম সারিতেই
থাকবে।‘’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সোনালী চক্রবর্তী ব্যানার্জী বলেন, ‘’বিংশ
শতাব্দীর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব কবি সুভাষ মুখোপাধযায়। বুদ্ধদেব বসু সঠিকভাবেই
বলেছেন তিনি সবুজ ঘাসের কবি। হ্যা অবশ্যই আজও বলতে হবে ‘কমরেড আজ, নবযুগ আনবে না?
‘নিরপেক্ষ থেকে আজ চিত্তে নেই সুখ’। তিনি মানুষের কবি। তিনি যেমন বামপন্থী কবি
ছিলেন, পাশাপাশি সমাজকর্মীও ছিলেন।‘’ সাহিত্য অকাদেমির বাংলা উপদেশক পর্ষদের
আহবায়ক কবি সুবোধ সরকার বলেন, ‘’কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিনন্দন জানাতে হয় সুভাষ
মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবার্ষিকী পালন করার জন্য। পাবলো নেরুদার সঙ্গে সুভাষ
মুখোপাধ্যায় যেমন আমাদের পরিচয় করিয়েছেন, পাশাপাশি নেরুদা স্প্যানিশ ভাষায় কবি
সুভাষ তথা কলকাতাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। কবি সুভাষ ছিলেন কমিউনিস্ট ফুটপাথের কবি।
নাজিম হিকমতের কবিতা ‘জেল খানার চিঠি’ আমি কলেজে পড়ার সময় পড়েছিলাম। এই দুই কবির
সঙ্গে সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন
সংসদীয় বামপন্থীদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা বেশি। মানুষের পাশ থেকে সরে যাচ্ছেন তাঁরা।
তাই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ রিনিউ করেননি।‘’
প্রথমদিনের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘ভারতীয় ভাষা সমূহে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের
উপস্থিতি। আলোচক ছিলেন প্রয়াগ শুক্ল (হিন্দি), মণিপুরী ভাষার কবি দিলীপ মায়েংবাম,
পঞ্জাবী কবি বনিতা এবং দিল্লীর হিন্দি ভাষার কবি এইচ এস শিবপ্রকাশ। দ্বিতীয় ভাগের
অনুষ্ঠান ছিল ‘তাঁর কাব্যঃ প্রান্তিকের ভাষা’। আলোচক ছিলেন অশেষ গুপ্ত, দিলীপ
বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অধ্যাপক চিন্ময় গুহ। এই প্রসঙ্গে চিন্ময় গুহ বলেন, ‘’এখন আমরা
কোন ব্যবস্থায় বাস করছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে লেখা, ‘বাতাসকে ধুয়ে দাও,
প্রত্যেকটা পাথরকে ধুইয়ে দাও। রক্তের বৃষ্টিতে এখন আমরা অন্ধ হয়ে গেছি.........।
মানুষের পরিভাষার সন্ধানে সুভাষ মুখোপাধ্যায় হাঁটছেন। কবিতার নতুন যুগের মূর্তি কারা?
অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ, সুধীন দত্ত। এঁদের ছাপিয়ে
তিনি প্রথম সারিতে এলেন। পুঁজি এবং শ্রমের লড়াইয়ের কথা তাঁর কবিতায় পাচ্ছি।
প্রান্তিক মানুষের কথা বলছেন সুভাষ। কালো মেয়ের কবিতা লিখছেন। আফ্রিকা।‘’
দ্বিতীয় দিন(১৯ সেপ্টেম্বর)-র ছিল কবি সম্মেলন। সাতজন কবি কবিতা পড়েন। পরের
বিষয় ছিল ‘তাঁর কথা সাহিত্য এবং অন্যান্য গদ্যে আত্মকথার সুর’। একজন শ্রোতা প্রশ্ন
করেছিল, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঠিক মূল্যায়ন করতে একশো বছর লেগে গেল? অধ্যাপক
পবিত্র সরকার আত্মসমালোচনার সুরে বলেন, ‘’সুভাষের সততা, শ্রেষ্ঠত্ব শেষদিন পর্যন্ত
ছিল। রাজনৈতিক পরিসরটা থাক। সুভাষদাকে নিয়ে যারা বিরুপ সমালোচনা করেছেন তাঁদের এটা
বলতেই হয় যে, সুভাষের কবি স্বত্বা নিয়ে তাঁদের সমালোচনা করার অধিকার নেই। তিনি কবি
হিসাবে যে উচ্চতায় ছিলেন, সেই উচ্চতাকেও কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। সুভাষদা যেমন
নিজের অনুভব কবিতা এবং গদ্যে লিখেছেন, আবার ফকিরের কথাও লিখে গেছেন। আক্রমণ
শানিয়েছেন শব্দে-বাক্যে। সেটা তাঁর সাহিত্য সহিষ্ণু অধিকার। এই অধিকার যারা
অস্বীকার করেন আমি তাঁদের সঙ্গে নেই।‘’
যে কোনও পরিক্রমার একটা সুচনা থাকে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও
সেটার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তাঁর কবিতা, গদ্য নিয়ে যারা বিদগ্ধ আলোচনা করেছেন তাঁরা
বলছেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা এবং গদ্যের মধ্যে তাঁর চিন্তাধারার এক
উল্লেখযোগ্য বিবর্তন দেখতে পাওয়া যায়। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন যেসব কমরেড। যারা নিজেদের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ নিয়ে নিম্নবিত্তের
কথা ভাবেন। শ্রমিকের মিছিলে হেঁটে এসে হারিয়ে যান ঝা চকচকে মল সভ্যতায়, না তাঁদের
সঙ্গে গলা মেলাতে বলেননি ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক/ আজ বসন্ত’-র কবি। তবু আজ আবার
উচ্চারণ করি, ‘’কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?/কুয়াশাকঠিন বাসর যে সম্মুখে।/লাল উল্কিতে পরস্পরকে চেনা—/ দলে
টানো হতবুদ্ধি ত্রিশঙ্কুকে,/ কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?’’
Porlam..valo laglo..Tobe sob j bujhlam..amontao Noy..
ReplyDelete