প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মিলনের সেতু অনুবাদ সাহিত্য
দীপেন্দু চৌধুরী
আলোচনাসভায় যখন প্রথম শুনলাম চমকে উঠেছিলাম।
আদিবাসী সমাজে, বিশেষত সাঁওতালী সমাজের
সন্তানের জন্মের পরে তাঁর বাবা অথবা পরিবারের অভিভাবক সদ্যজাত সন্তানের
নাভি নিজেদের বাড়িতে মাটি খুঁড়ে গর্তে ফেলে, মাটি চাপা দিয়ে রাখে। বংশ পরম্পরায় এই
নিয়ম চলে আসছে ভারতের সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে। সাংস্কৃতিকভাবে আদিম বিশ্বাস
থেকে এই প্রথা চলে আসছে। লোকসংস্কৃতি বললেও বলা যায় আবার ‘লোকাচার’ বললে কি
অযৌক্তিক শোনাবে? আদিবাসী সমাজের সাঁওতাল
সম্প্রদায়ের মানুষ আদিম বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে নিজেদের সভ্যতা
এবং মাটির টানে। সম্প্রতি একটি আলোচনাসভায় এই তথ্যের উল্লেখ করলেন সাঁওতালি ভাষার
কবি, সাঁওতালি ভাষা থেকে বাংলা এবং বাংলা থেকে সাঁওতালী ভাষার সুপরিচিত অনুবাদক
সুবোধ হাঁসদা। তিনি এদিন উল্লেখ করেন কিছুদিন আগে একটি সাঁওতাল দম্পতি পরিবার
আমেরিকায় গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁদের একটি পুত্রসন্তান হয়। আমেরিকায় ছুটি কাটিয়ে
ফেরার সময় শিশুটির নাভিকুন্ড সঙ্গে করে নিয়ে এসে নিজেদের গ্রামের বাড়িতে মাটি চাপা
দিয়ে রেখে দেয় তাঁরা। পারিবারিক কৃষ্টিকে মনে রেখে।
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। আদিবাসী
সমাজের এই চিরায়ত বিশ্বাস কি নিজেদের পরগণাকে চিহ্নিত করে রাখা? কারণ আমি নিজেও
জানি এবং দেখেছি, অশিক্ষার কারণে একটা সময় সাঁওতাল, কোল, ভিলদের নিজেদের চাষের
জমি, আবাদী জমি, বসতবাটী জমি ছেড়ে দিতে হয়েছে। ছোট নাগপুরের অধ্যুষিত অবিভক্ত
বিহার, ওড়িশা এবং আমাদের বাংলার বিভিন্ন জেলায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষেরা
নিজদের বসত বাড়ি থেকে উৎখাত হওয়ার ঘটনা, প্রত্যক্ষ অভিঞ্জতায় আমি দেখেছি। স্থানীয়
রাজা, নবাবের প্রতিনিধি, তালুকদার, জমিদারের হুকুমে। অথবা বিজাতীয় মোড়লের অসহনীয়
অত্যাচারে ভিটে ছাড়া হতে হয়েছে এই সম্প্রদায়ের মানুষদের। ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে তাঁর ‘সাঁওতাল
গণসংগ্রামের ইতিহাস’ বইয়ে লিখছেন, ‘’আশ্চর্য লাগে যে, ‘সভ্য’ ইংরাজ শাসনেও এরকম
জঘন্য নিয়ম এ অঞ্চলে চালু ছিল এবং ব্রিটিশ আইনের ব্যবস্থা থেকে মহাজন এ ধরণের কাজে
পুলিস ও আইনের সক্রিয় সমর্থন লাভ করত। এই নিষ্ঠুর উৎপীড়ন থেকে রক্ষা পাবার কোন
উপায় ছিল না। তাই এক ইংরাজ লেখক এ সমস্ত হতভাগ্য সাঁওতালদের সম্বন্ধে লিখে গেছেন,
‘এরা জানে না যে এদের দাসত্ব বে-আইনি এবং যদি তারা
জানেও, তা হলেও এদের অনেকেই তা থেকে মুক্তি চাইবে না। এরা জানে যে, যতদিন তারা
গোলাম থাকবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের মালিকদের স্বার্থেই তাদের বাঁচিয়ে রাখা হবে।
এদের জাগতিক উচ্চাকাঙ্খার এই ছিল চরমসীমা।’
হিন্দু জমিদাররাও সাঁওতাল গ্রামগুলি মহাজনদের কাছে
ইজারা দিয়েছিল, ফলে সাঁওতালদের মধ্যে অসন্তোষের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। শ্রীখন্ডের
(তিন পাহাড়ের কাছে) সহকারী কমিশনার মিস্টার টেলর ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের ১৬ই ফেব্রুয়ারী
ডেপুটি কমিশনার মিঃ থম্পসনকে জানিয়েছিলেন মহেশপুর ও পাকুড়ের রাজারা সাঁওতাল
গ্রামগুলি মহাজনদের কাছে ইজারা দেওয়ায় সাঁওতালরা ঐ রাজাদের উপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে
উঠেছে।‘’ (পৃষ্ঠা- ৪৬/৪৭)
বাংলা ভাষায় লেখা একজন সাঁওতাল লেখকের উধৃতি টেনে
আনলাম প্রাসঙ্গিক বিষয় সেটাই দাবি করছে। কারণ কবি এবং খ্যাতনামা অনুবাদক সুবোধ
হাঁসদা ৩০ সেপ্টেম্বর যে আলোচনাসভায় এই বক্তব্য রাখেন সেদিন ছিল আন্তর্জাতিক
অনুবাদ দিবসের একটি অনুষ্ঠান। আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস প্রতি বছর ৩০ সেপ্টেম্বর
সমস্ত বিশ্বে পালন করা হয়। অনুবাদের পেশাকে আরও জনপ্রিয় করতেই এই উদ্যোগ।
পরিবর্তিত বিশ্বে সাংস্কৃতিক হেরিটেজ এবং পারস্পরিক বোঝাপড়াকে আরও দৃঢ় করতে এই দিনটিকে
বর্তমানে বেশি করে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশ্ব শান্তি এবং নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিতে
রাষ্ট্রসংঘ বিশ্বের প্রতিটি দেশের বিভিন্ন ভাষার উন্নয়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে
দেয়। আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবসে এই বছরের মূল ভাবনা ছিল ‘’Translation and
Indigenous Languages.’’
‘ইন্টারন্যাশন্যাল ফেডারেশন অব ট্রান্সলেটর’ (FIT)-এর
উদ্যোগে সারা বিশ্বে এই দিনটি সাড়ম্বরে পালন করা হয়। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য যে সব
লেখকরা অনুবাদ করেন তাঁদের সম্মান জানাতেই আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস পালন করা হয়। যারা
মৌখিকভাবে ভাষান্তরের কাজ করেন, আমরা যাদের ইংরেজিতে ‘ইন্টারপ্রেটার’ বলি
তাঁদেরকেও এইদিনে সম্মানিত করা হয়। মূল বাইবেল গ্রন্থের অনুবাদক সন্ত জেরমিকে
স্মরণ করে ১৯৫৩ সাল থেকে ‘ফিট’ (FIT) এই দিনটি পালন করে আসছে। ১৯৯১ সালে ‘ফিট’
আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের অনুবাদকদের একমঞ্চে আনার জন্য সব ধরণের উদ্যোগ নেওয়ার
পরিকল্পনার কাজ শুরু করে।
কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থা
সাহিত্য অকাদেমী, কলকাতা আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবসে (৩০ সেপ্টেম্বর) আয়োজন করে
‘অনুবাদ ও আদিবাসী ভাষাসমূহ’ বিষয়ক একটি আলোচনাসভার। স্বাগত ভাষণে সংস্থার পূর্বাঞ্চলীয় দফতরের আঞ্চলিক
সচিব দেবেন্দ্র কুমার দেবেশ বলেন, ‘’আমাদের কাজই হচ্ছে অনুবাদ করা। সাহিত্য
অকাদেমীর এই কাজ বহু ভাষায় হয়। আমরা চেষ্টা করি আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদের কাজ বেশি
করে করতে। যে কোনও ভাষার কাজ এবং আদিবাসী ভাষার কাজ কখনও যেমন সহজ মনে হয়, কিছু
ক্ষেত্রে সত্যি সত্যিই কঠিন মনে হয়। আমি নিজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলী’ হিন্দিতে অনুবাদ
করার সময় উপলব্ধি করেছি।‘’
বিতস্তা ঘোষাল নিজের সম্পাদনায় বাংলা ভাষায় একটি
‘অনুবাদ পত্রিকা’ প্রকাশ করেন। বিভিন্ন বিষয়ে ২০টি বই আছে বিতস্তার। রবীন্দ্রনাথ
থেকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘’অনুবাদ সাহিত্য প্রথম প্রকাশ হয় রোমান ভাষায়। মোলিক
লেখার সঙ্গে অনুবাদেও কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। চতুর্দশ শতাব্দীতে ইউরোপে
অনেক অনুবাদ হয়েছে। আমাদের দেশে আমরা রামায়ন, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য, বেদ, ভাগবতগীতা
ইত্যাদি বই অনুবাদ সাহিত্যেই বেশি পড়েছি। ভারতীয় ভাষায় বেশি অনুবাদ হয়েছে সংস্কৃতি
ভাষা থেকে। মধ্যযুগে আরবি, ফার্সি ভাষার প্রচলন ছিল। উনবিংশ শতাব্দীতে পণ্ডিত
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অনুবাদ সাহিত্যকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ
বলেছিলেন, ‘অনুবাদ মূল ভাষায় লেখার মতো হয় না। যদি না অনুবাদক ওই ভাষা শিখে না
থাকেন।’ আদিবাসী ভাষা নিয়ে আমাদের দেশে কাজ কম হচ্ছে। অনুবাদকদের সঙ্গে কথা বলেছি,
তাঁরা বলছেন, এই ভাষায় কাজ করলে প্রকাশক পাওয়া যায় না। চাকরিও পাওয়া যায় না।‘’
সুবোধ হাঁসদা বলেন, ‘’ভারতবর্ষের জনসমষ্টির ৮%
সাঁওতাল। অতীত অভিঞ্জতা আমাদের ভালো নয়। শুধুমাত্র সাঁওতাল ভাষা নয়, ভারতের
অন্যান্য আদিবাসী ভাষার সাহিত্যের অনুবাদও বইবাজারে কম পাওয়া যায়। সাওতালী সমাজের
সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সংস্কার, মূল্যবোধ এমনই যে জন্ম এবং মৃত্যুর পরেও সামাজিক বন্ধন
অটুট থাকে।‘’ পণ্ডিত রঘুনাথ মূর্মুর কবিতা অনুবাদ করে বাংলায় সুবোধ হাঁসদা আরও
বলেন, ‘’জাতীয় সংহতির স্বার্থে অনুবাদ সাহিত্যের প্রসার এবং প্রচারের প্রয়োজন
আছে।‘’
সাহিত্য অকাদেমী পুরষ্কারপ্রাপ্ত অনুবাদক তিনি।
ইতিমধ্যে ১৭টি অনুবাদ সাহিত্যের বই প্রকাশ হয়েছে প্রবীণ ননীগোপাল শুরের। তিনি
বলেন, ‘’এই বিশ্বকে উন্নত করতে শান্তির জন্য বিশ্বে যে সব অনুবাদক লেখার কাজ করেন,
তাঁদের এক মঞ্চে আনার উদ্দ্যেশ্যে এই দিনের উদযাপন। অনুবাদক বন্ধুদের স্বীকৃতি
দিতে আমরা আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবস পালন করে থাকি। ভারতের অনুবাদকদের জন্য কাজ
করছে সাহিত্য অকাদেমী এবং ন্যাশন্যাল বুকট্রাস্ট। ‘একলব্য’-এর মতো সমাজে যারা
অবহেলিত আমরা তাঁদের স্মরণ করছি। অবহেলিত সাহিত্যকে আমাদের মূলধারায় তুলে আনতে
হবে।‘’
আন্তর্জাতিক অনুবাদ দিবসে আমাদের মনে পড়ছে একাধিক
বিদেশী সাহিত্যিক, কবি, অনুবাদক লেখকের নাম। একটি নাম উল্লেখ করছি। জাপানের
জাতীয়তাবাদী শিল্পকলা-সমালোচক, বুদ্ধিজীবী ওকাকুরা কাকুজোর কথা। রবীন্দ্রনাথ এবং ওকাকুরার
যৌথ চেষ্টায় বিংশ শতকের প্রথমদিকে নতুন করে শুরু হয়েছিল ভারত-জাপান সাংস্কৃতিক এবং
শিক্ষামূলক বিনিময়ের। ২০১২ সালে ওকাকুরা যখন দ্বিতীয়বার কলকাতায় এলেন সেই সময় তাঁর
সঙ্গে পরিচয় হয় সদ্য স্বামীহারা এক বাঙালি কবির সঙ্গে। তিনি হলেন প্রিয়ম্বদা দেবী
(১৮৭১-১৯৩৫)। বাঙালি এই মহিলা কবির সঙ্গে পরিচয়ের কিছুদিনের মধ্যে বস্টনে চলে যান
ওকাকুরা। ভারত ছাড়ার আগে মুম্বাই থেকে প্রিয়ম্বদাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে
তিনি লেখেন, ‘আপনার কবিতা পড়েছি গভীর আনন্দের সঙ্গে...। আক্ষেপ হচ্ছে বাংলা পড়তে
পারি না বলে, কেননা মূল বাংলায় কবিতাগুলি নিশ্চয় আরও সুন্দর। আপনার সহৃদয়তা
ভারতবর্ষের সঙ্গে আমার যোগাযোগের আরও একটি কারণ.........।‘’
Comments
Post a Comment