বহতা সময়ে আমার দেশ ‘জন্মভূমি আজ’
দীপেন্দু চৌধুরী
ঋতুমতী নগরীর অলিন্দে আমরা যারা বাস করি তাঁরা উৎসবের সামাজিকতায় সত্য খুঁজতে ভুলে যাই। চিনতে জানতে
ভুলে যাই। স্মৃতি আমাদের ফিরে যেতে বলে। আমরা নাগরিক মূল্যবোধে জীবনের গান শুনি।
প্রশ্ন ওঠে, থেকে যায় প্রশ্ন কতটা প্রাণ দিয়ে শুনি জীবনের গান? উল্টো দিকটাও আবার
আছে, আজও ফুটপাথের এক কবি, শ্রমিক, কৃষক, রাস্তার এক উলঙ্গ শিশুর কবিকে আমরা
খুঁজতে থাকি, খুঁজতেই থাকব। কারণ এই কবির দল হারিয়ে যায় না। তাঁরা আমাদের মধ্যেই বেঁচে থাকেন, সমাজ সভ্যতাকে বাঁচিয়ে
রাখার জন্য। কয়েক যুগ এগিয়ে রাখার জন্য। এই কবিদের অন্যতম অগ্রজ কবি বীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, ‘যে আগুন এখন নিবু-নিবু/ তাকে যেভাবেই হোক জ্বালিয়ে রাখতে
হবে।/ সেটাই হবে এখন তোদের সবচেয়ে বড়ো কাজ-/ তোরা, যারা একদিন/ স্বপ্ন দেখেছিলি সত্যিকারের স্বাধীনতার/ যেখানে
মানুষ মানুষের জন্য বেঁচে থাকে।’
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রথমে যুদ্ধ, মহামারী,
পরাধীনতা, আত্মসমর্পণ দেখেছেন তিনি। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দেশ স্বাধীন
হওয়ার পরেও স্বাধীন দেশে মানুষের অনাহার, উদ্বাস্তু মানুষের পরিবার বিচ্ছিন্ন
হওয়ার যন্ত্রণা দেখেছেন, ভিটে মাটি হারানোর করুণ আর্তনাদ শুনেছেন তিনি। মানুষের
মনের রক্তক্ষরণ, দহন উপলব্ধী করেছেন। ফিরেছেন লাল ঝান্ডার আশ্রয়ে, কিন্তু সেখানেও
তিনি মনের মুক্তি, চেতনার মুক্তি পাননি, প্রশ্ন তুলেছেন বারে বারে। লিখেছেন, ‘রাজা
আসে রাজা যায়’ শিরোনামে কবিতা। ‘রাজা আসে যায়/ রাজা বদলায়/ নীল জামা গায়/ লাল জামা
গায়/ এই রাজা আসে/ ওই রাজা যায়/ জামা কাপড়ের রঙ বদলায়........./ দিন বদলায় না!
গোটা পৃথিবীকে গিলে খেতে চায় সে-ই যে ন্যাংটো ছেলেটা/ কুকুরের সাথে ভাত নিয়ে তার
লড়াই চলছে, চলবে।/ পেটের ভিতর কবে যে আগুন জ্বলেছে এখনও জ্বলবে!’
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রাস্তায় ছিলেন,
অবিনাশী মুষ্টিবদ্ধ হাত, গণতান্ত্রিক চেতনার দীর্ঘ, দীর্ঘতম বিরাট এক মিছিলের
মাঝখানে হাঁটতে হাঁটতে অভিভাবকের মতো বলতেন ‘আমি আছি নিভন্ত চুল্লিতে আগুন
জ্বালাবার জন্য’। মিছিলের সামনে পেছনে মাঝখানে হাঁটতে হাঁটতে সারিবদ্ধ শব্দের মালা
গেঁথে গেঁথে, লালফুল, সাদাফুল, শব্দফুলের
মালা সাজিয়ে আমাদের আবেগ তাড়িত করেছেন। আমাদের ভাবিয়েছেন তিনি। বারে বারে নিজেকে
প্রশ্ন করে করে খান খান করেছেন। টুকরো
টুকরো করে ছিঁড়েছেন। আমাদের মনের হাজার হাজার প্রশ্নকে জাগিয়ে দিতে চেয়েছেন
মানুষের কবিতার আহ্বানে। ক্ষমা করেননি চেনা বাস্তবকে। তাই তিনি লিখেছেন, ‘তিনি যখন
বসেন সিংহাসনে/ তখন তাঁর মুখের মুখোষ লাল/ থেকে নীল, নীল থেকে হলুদ-কালো/
ডোরাকাটা... আমাদেরই পোড়া কপাল, / লালকে ভেবেছিলাম শুধুই লাল।’
কবি আরও লিখছেন ‘আজ তোমরা রাজত্ব পেয়েছো / আর তিন
রাত্তির না ফুরুতেই/ তোমাদের মুখের চেহারা গেছে বদলে-/ যা ছিল একদিন সূর্যের কাছে
প্রার্থনা/ এখন তা গা ছমছম ভূতের ভয়!’ বহতা সময়ে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অনেক কবির
সঙ্গে যাপন শুরু করেছিলেন, অনেকটা পথ তাঁদের সঙ্গে হেঁটে এসে হেঁটে এসে দেখলেন তার
সহযাত্রী কবিদের অনেকেই থেমে গেলেন, হাঁটতে চাইলেন না। পিছিয়ে পড়লেন বহতা সময়ের
মানদণ্ডে। থামেন নি তিনি মানুষের কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পিছিয়ে পড়তে রাজি
ছিলেন না কবি। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের তরুণ এবং তরুণতর কবিদের মশাল হাতে সংগ্রামের
অনুরাগে পথ দেখাতে চেয়েছেন। পথ চেনাতে চেয়েছেন নতুন ভাষার নতুন আঙ্গিকের। যশ,
প্রতিষ্ঠা অথবা শুধু টিকে থাকার লোভে প্রতিষ্ঠিত বামপন্থীদের একটা অংশ যখন সমঝোতার
পথে পা এগিয়ে দেয়। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন নিজের কবিতাকে ধারাল বর্শার ফলারমতো আক্রমণে নিয়ে আসেন। সমাজকে, ভোগবাদী
দুনিয়াকে টুকরো টুকরো করেন। পৃথিবী টাল মাটাল হয়ে ওঠে।
কবি হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন করার জন্য আমার থেকে
অনেক অনেক যোগ্যতম ব্যক্তি আছেন। কিন্তু যেটা বলতেই হয়, সেটা হচ্ছে অর্থ,
প্রতিষ্ঠা এসবের কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। আর সেই কারণে সমকালীন অনেকের কাছ
থেকেই দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। নিজের দায়িত্ব এবং কর্তবের কথা ভেবে
নতুন প্রজন্মের জন্য দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। সেইসব তরুণ কবিদের কাছে টেনে নিয়েছিলেন
নতুন ভাষায় কবিতা আন্দোলন গড়ে তুলতে।
এই রকম এক সেতু বন্ধনের মঞ্চে সম্প্রতি সাক্ষী
থাকার সুযোগ হয়েছে আমার। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যয়ের শততম জন্মদিনে ২ সেপ্টেম্বর
রোটারিসদনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ‘বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শতবর্ষ উদযাপন
কমিটি’। এই অনুষ্ঠানের বক্তারা আমাদের
মনে করিয়ে দিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যয়ের কবিতা অনুভবের জন্য পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব
আমাদের। এদিন ‘কবিতা তুমি কেমন আছ?’ শিরোনামে একটি কবিতা সংকলন প্রকাশ করেন কবি শঙ্খ
ঘোষ। এই সংকলনে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরষ্কার পেয়েছেন যেসব কবিরা, তাঁদের কবিতা
সংগৃহীত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে নিবেদন করে ‘কালপুরুষ’ নামে একটি কবিতা সংকলন
সম্পাদনা করেছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সেই সংকলনটিও এদিন পুনঃপ্রকাশ করা হয়।
লেনিনকে নিবেদন করেও একটি কবিতা সংকলন করেছিলেন ‘জন্মভূমি আজ’-এর কবি। বীরেন্দ্র
চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত সেই বইটিও এদিন পুনঃপ্রকাশ হল। অনুষ্ঠানে এসেছিলেন কবি
সব্যসাচী দেব এবং কবি শঙ্খ ঘোষ।
কবি লিখে গেছেন ‘ছত্রিশ হাজার লাইন না লিখে যদি
আমি মাটিকে জানতাম’। স্মারক বক্তৃতায় অধ্যাপক জহর সেন মজুমদার বলছিলেন, ‘বীরেনদা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে যান নি তাঁর কবিতাও রাস্তা ধরে হেঁটেছে।
আমরা দেখেছি পাড়ার বাচ্চা ছেলেদের রাস্তা থেকে ধরে বাড়িতে এনে স্নান করিয়ে দিতেন
তিনি।’
জহর সেন মজুমদার আরও বলছিলেন, স্বৈরতন্ত্রের
আধিপত্যের বিরুদ্ধে তিনি কবিতা লিখে গেছেন। ঘরের মা কখন যেন সর্বজনীন ‘মা’-এ পরিণত
হয়েছিল তাঁর কবিতায়। এই কবির কবিতার ধর্মই ছিল উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারি করা, সেই জন্য
তাঁর কবিতা দেশ পাল্টানোর কবিতা হয়ে উঠেছে। ধ্বনির মধ্যে বাঁকাচোরা প্রতিধ্বনি হয়ে
ওঠে তাঁর কবিতা, কবিতার লাইন থেকে। ‘চাঁদ এসে তাঁর কপালে চুমু খায়’। যতদিন মাটি থাকবে ধবনি থাকবে, তাঁর কবিতা কথা বলবে নতুন ব্যঞ্জনায়।
১৯৮০ সালে ‘নান্দীমুখ’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘’......... শুধু জীবনানন্দ কেন, অনেকের কাছেই
আমার কবিতা নানা দিক থেকে ঋণী। সমর সেন বা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো স্বাভাবিক
কাব্যকুশলতা আমার ছিল না! কবিতা রচনার আদিপর্বে তাই অনেক প্রবীণ কবিকে অনুসরণ বা
অনুকরণ করে আমাকে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করতে হয়েছে। জীবনানন্দ এবং বিষ্ণু দে, বিশেষ
করে এই দুই অগ্রজ কবির কাছে আমি কবিতার ভাষা শিখেছি, যে কবিতা এখন আমি লিখে
থাকি।‘’
কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯২০ সালের ২
সেপ্টেম্বর ঢাকা-বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৫ সালের ১১ জুলাই কবি কলকাতায় মারা
যান। কবির মৃত্যুর পরে একটি মাসিক পত্রিকার অগস্ট ১৯৮৫ সালের সংখ্যায় স্মৃতিচারণে ‘অনুষটুপ’
পত্রিকার সম্পাদক অনিল আচার্য লিখেছিলেন, ‘’বিকেলের সূর্যের মত আপনি যেন সাদা
দিগন্তে দীঘল শরীর ছড়িয়ে শায়িত। বোজা চোখ কিন্তু পাশের মানুষের হাতে প্রিয় হাত।
কিছুক্ষণ বাদে আপনি চোখ মেললেন, চোখে পড়ল চোখ, কাছে ডাকলেন, গলার স্বরে সেই উক্ত
আগ্রহ— কাগজ বাইরইচ্ছে? আমার চোখে জল ছুটে এসেছিল, সিক্ত হয়েছিল চোখের কোণ। আপনি
পাশের কাউকে সযত্নে কাগজটি দিয়ে বললেন— বাড়ীতে গিয়া পড়ুম। তৎক্ষণাৎ আপনার কন্ঠে
যেন সদম্ভ ঘোষণা শুনলাম— আমি অত সহজে মরুম না, আমি বীরেন্দ্র চট্টোপাধায়।‘’
আমরাও আজ আবার উচ্চারণ করি, বারে বারে উচ্চারণ
করি, ‘’যে মানুষ গান গাইতে জানে না/ যখন প্রলয় আসে, সে বোকা ও অন্ধ হয়ে যায়।/ তুমি
মাটির দিকে তাকাও, মাটি প্রতীক্ষা করছে; / তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে
চায়।।‘
Comments
Post a Comment