সুন্দরী গাছের সামাজিকতায় ওরা থাকে

দীপেন্দু চৌধুরী 

সালটা সঠিকভাবে মনে পড়ছে না। খুব সম্ভবত ২০০৩ সাল হবে। আমি তখন সাংবাদিক হিসেবে ‘জি নিউজ’-এর বাংলা শাখা ‘আলফা বাংলা’ নিউজ চ্যানেলের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার দায়িত্বে। অফিস থেকে আমাকে জানানো হল, সুন্দরবনে বাঘশুমারি(বাঘগণনার)-র কাজ হচ্ছে, খবর করতে যেতে হবে। বনদপ্তর এবং সুন্দরবন উন্নয়ন দপ্তরের যৌথ উদ্যোগে ‘সুন্দরবন’-এর বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করতে আমরা দেখেছি। আজ থেকে ১৬ বছর আগে সুন্দরবনের তখনও এতটা উন্নয়ন হয়নি। সমতলের সঙ্গে ১০২ টি দ্বীপের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। ক্যানিং থেকে বাসন্তি যেতে হলে মাতলা নদী হেঁটে পার হয়ে ও পাড়ে গিয়ে ভ্যান রিক্সা করে বাসন্তী রোডে গিয়ে বাস ধরতে হত। আমরা সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে খবর করতে যেতাম বাস, অটো, ভ্যান রিক্সা নৌকা, ভুটভুটি  এবং মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে। এতটাই প্রত্যন্ত ছিল সেই সময়ের সুন্দরবন অঞ্চল।
তৎকালীন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সদর ছিল আলিপুর। আলিপুর থেকে বাসে করে সরকারি উদ্যোগে  আমাদের বাসন্তী নিয়ে যাওয়া হয় ২০০৩ সালের বাঘ গণনার দিন বাসন্তী থেকে আমরা লঞ্চে করে গোসাবার দু’তিনটে অঞ্চলে যাই। জুতো খুলে রেখে, লঞ্চ থেকে নেমে প্যান্ট গুটিয়ে পলিমাখা কাদায় নেমে হেঁটে হেঁটে বনআধিকারিক, বনকর্মীদের সঙ্গে আমরা এগিয়ে যাই। বনকর্মীরা বাঘের পায়ের ছাপ (পাগ মার্ক) সংগ্রহ করে। বিষ্ঠাও সংগ্রহ করে। আমাদের ক্যামেরায় আমরা এইসব মুহূর্তের ছবি ক্যামেরাবন্দী করে ফেলি। বর্তমান সময়ের মতো বাঘশুমারির জন্য প্রযুক্তির এত উন্নতি হয়নি। সেদিনের সাংবাদিকদের দলে ‘আজতক’ টিভির তৎকালীন সাংবাদিক রিকা রায় এবং এনডিটিভির মনিদীপা ব্যানার্জী ছিলেন বাঘ গোনার পদ্ধতি নিয়ে এখনও অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। ১৫-১৬ বছর আগের পদ্ধতির সঙ্গে যদিও এখনকার বাঘগণনা পদ্ধতির পার্থক্য অনেকটাই ভিন্ন।
এবারের বাঘ গণনা দু’টো ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমভাগে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তথ্য সংগ্রহে। ৪০, ০০০ ফিল্ডকর্মী নামানো হয়েছিলো তথ্য সংগ্রহের কাজে। ভারতের ১৮ টি রাজ্যে (যে সব রাজ্যে বাঘ রয়েছ) এই ফিল্ডকর্মীরা কাজ করেন। ফিল্ডকর্মীরা বাঘের উপস্থিতি আছে এমন তথ্য, বাঘের জীবনপ্রণালী, বাঘ শিকারির সহযোগীদের দেওয়া তথ্য এবং ল্যান্ডস্কেপের উপর নির্ভর করে তথ্য সংগ্রহ করে বনদফতরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বনদফতর থেকে কেন্দ্রীয় গবেষণালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।
দ্বিতীয়ভাগে ছিল যত বেশি সংখ্যায় ক্যামেরা-ফাঁদ পাতা, বাঘ সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং বাঘ বসবাস করে সেইসব অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী এলাকায় জীববিঞ্জানীদের মাধ্যমে ক্যামেরা-ফাঁদ পাতার কাজ করা হয়। ২০১৮ সালের সমীক্ষায় ১৫,০০০ ক্যামেরা বসিয়ে ১৮ টি রাজ্যে ফাঁদ পাতা হয়েছিল। ২০০৬ সালে নতুন পদ্ধতিতে প্রথমবার ৯,০০০ ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছিল। সমস্ত সংগৃহীত তথ্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেহারুদুনের ভারতীয় বন্যপ্রান সংস্থায় (Wild Life Institute of India)বাঘ গণনা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি (এনটিসিএ) এবং বাঘ-বিশেষঞ্জদের অনেকের অভিমত, এই বছরের শুমারিতে সর্বাধিক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। সম্প্রতি কলকাতা আমেরিকান সেন্টারে ২৯ জুলাই বাঘ দিবসের দিনে একটি অনুষ্ঠানে বাঘ-বিশেষঞ্জ বিশ্বজিৎ রায় চৌধুরী বলছিলেন। সুন্দরবনের নরম মাটিতে বাঘের পায়ের ছাপ বদলে যায়। তা ছাড়া পায়ের ছাপ সর্বদা নির্ভুল ভাবে লক্ষ করা সম্ভব হয় না। তাই বর্তমানে বাঘের যাতায়াতের পথে ক্যামেরা লাগানো হচ্ছে। প্রতিটি বাঘের ডোরাকাটা দাগ আলাদা হয়। বাঘের এই দাগের বৈচিত্রের ছবি দেখে আলাদা আলাদাভাবে বাঘ শনাক্ত করা সম্ভব। পাশাপাশি মধ্য ভারতে, মহারাষ্ট্রের শক্ত মাটিতে বাঘের পায়ের ছাপ অক্ষত থাকায় সেটা আরও বেশি কাজে লাগে।                
২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাঘ শুমারির রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন। সেই রিপোর্টে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। ২০১৪ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছিল দেশে মোট বাঘের সংখ্যা ছিল ২২২৬টি। এবারের অল ইন্ডিয়া টাইগার এস্টিমেশন রিপোর্টে ৩৩% বাঘ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। সেই অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৯৬৭। প্রতি চার বছর অন্তর আধুনিক পদ্ধতিতে বাঘশুমারি হচ্ছে। এবারের বাঘশুমারি ছিল চতুর্থ সংস্করণ। আগের সংস্করণগুলি ছিল ২০০৬, ২০১০ এবং ২০১৪ সালে। ২০১৪ সালে সুন্দরবনে ৭৬টি বাঘ ছিল। এবছরের বাঘশুমারির রিপোর্টে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮৮। ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বাঘের সংখ্যার হিসেবটা একবার দেখে নেওয়া যাক। দেশের মধ্যে সব থেকে বেশি বাঘ আছে মধ্যপ্রদেশে। এই রাজ্যে বাঘ আছে ৫২৬টি। তাঁর পরে নাম আছে কর্নাটকের। এবারের শুমারিতে কর্নাটকে বাঘের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৫২৪ টি। আসামে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। রিপোর্ট বলছে ২০১৪ সালের তুলনায় ২৩টি বাঘ বেড়ে হয়েছে ১৯০টি বাঘ। অরুণাচলে ২৯টি বাঘের সন্ধান পাওয়া গেছে। ছত্তিসগঢ়ে ৪৬ থেকে কমে হয়েছে ১৯। ছত্তিসগঢ়ে বাঘের সংখ্যা কেন কমে গেল সেই বিষয়ে তদন্ত করছে ন্যাশন্যাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি (এনটিসিএ) বা জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কতৃপক্ষ। কারণ ছত্তিসঢ়ে সশস্ত্র বামপন্থীদের সঙ্গে বাঘেদের ঘর সংসার করতে হয়। বাঘ গোনার পদ্ধতি নিয়েও এদেশে বিতর্ক রয়েছে।    
বাঘ বিশেষঞ্জরা দাবি করছেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার (striped big cats) বা সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ভারতে বাড়ছে। যদিও সুন্দরবনের দাগ কাটা বাঘ দেশের অন্যান্য বাঘের সঙ্গে একই অঞ্চলে অর্থাৎ একই বনাঞ্চলে যৌথভাবে ঘর সংসার করে থাকে। সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ অঞ্চল ১৮৩৩ বর্গ কিলোমিটার। জনবসতি ৮.১ মিলিয়ন। বন দফতরের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে ১৮৮৩-৮৪ সাল থেকে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার সুন্দরবনে বসবাসের অঞ্চল হিসেবে বেছে নিয়েছে। ওই বছরে বাঘের আক্রমণে ১৬৮ জন মানুষের মৃত্যু হয়। গত চল্লিশ বছরের হিসেব বলছে প্রতিবছর ১৫জন মানুষের মৃত্যু হয়। যদিও রাজ্য বনদফতরের একটি সূত্র বলছে ১৯১৫-১৬ সালে সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে ৬০ জন মানুষের মৃত্যু হয়। সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মানুষের মৃত্যুর মূল কারণ মাছ ধরতে যাওয়া, মধু সংগ্রহ করতে যাওয়া এবং কাঠ কাঠতে যাওয়া। জীবীকার প্রয়োজনে সুন্দরবনের সব সম্প্রদায়ের মানুষ ‘বনবিবিকে’ পুজো দিয়ে গভীর জঙ্গলে যায়। ২৯ জুলাই বাঘ দিবসের দিনেই পিরখালি ১ জঙ্গলের সড়কখালি খালের কাছ থেকে অর্জুন মণ্ডল নামে একজন মৎজীবীকে বাঘে তুলে নিয়ে গেছে। সুন্দরবনে বছরে ১০ মাস মাছ ধরতে যায় মৎসজীবীরা। মধু সংগ্রহ করে বছরে দু’মাস। ২০০০ সাল থেকে কাঠ কাটা বন্ধ করে দিয়েছে বনদফতর।
সুন্দরবনের বাঘের বৈশিষ্ট হচ্ছে সুন্দরী গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে শিকার ধরা। রাজ্য বনদফতরের এক আধিকারিক বলছিলেন, ভারতের সুন্দরবনের ‘সুন্দরী গাছ’ বাংলাদেশের সুন্দরবন ভূখণ্ডের তুলনায় ছোট হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের  সুন্দরবনের আয়তন ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। এই ভূমণ্ডলের ৪০ শতাংশ ভারতে। রাজ্য বনদফতরের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বাদাবন কমছে এমনটা বলা যাবে না। তবে ধ্বসের কারণে অসংরক্ষিত অঞ্চলে বাদাবন কমছে। দূষণও অন্যতম কারণ। ২৯ জুলাই আমেরিকান সেন্টারের অনুষ্ঠানে সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের যুগ্ম অধিকর্তা ডঃ এস কুলন্দডিভেল বলছিলেন, যন্ত্রচালিত ভুটভুটিতে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। পরিবেশের উপর চাপ বাড়ছে। সুন্দরবনের নদীগুলিতে লবণাক্তের পরিমাণ বাড়ছে। তাতে ম্যানগ্রোভ অরণ্য এবং বাঘ-কুমীরের জীবন বিপদের মুখে পড়ছে। ওইদিন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্য বনপাল প্রদীপ ব্যাস বিষয়টি উল্লেখ করেন। তাঁর প্রস্তাব, সুন্দরবনের উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকা সরকারের সবক’টি সংস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সহ আরও যে সব বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে তাঁদের এক ছাদের নীচে এনে কাজ করতে হবে। গ্রামবাসীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসার প্রস্তাবও তিনি দিয়েছেন। সুন্দরী গাছের সামাজিকতা ওদের ফিরিয়ে দেওয়াটাই আমাদের দায়িত্ব। বন্যরা বনে সুন্দর।                                                                                                        
 


Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?