সোনভদ্র কংগ্রেসের কাছে ‘নান্দীমুখ’ আলো




 দীপেন্দু চৌধুরী
হা হা মাঠ পান্ডু শুয়ে মৃৎবৎসা নারীর মতন,
ত্বকে তার দ্রোণকাঁটা মাঝে মাঝে গো-ক্ষুরের দাগ
চক্রাকারে ঘুরে গেছে। তার কাছে দুঃখীর প্রার্থিত
সাবেক দুধেল শস্য বাষ্প হয়ে অশ্রুর প্রথায়
উবে যায় ফি-বছর অভিঞ্জতা, আঁকিবুকি কেটে।
(জমিসংক্রান্ত চতুর্দশপদী, অমিতাভ দাশগুপ্ত)
ঘোড়া কেনা বেচা শেষে সহিস ঘরে ফিরে গেছে। উন্নয়নশীল ভারতে একটি অঙ্গ রাজ্যের ক্ষমতার সিংহাসন আবারও দখল করা হয়ে গেছে। নির্বাচন, আদালত, দলাদলি, দলবদলু অবশেষে কর্নাটকের আস্থাভোটে হেরে গিয়েছে জেডিএস-কংগ্রেস জোট। সত্যমেব জয়তে, সত্যমেব বিজেপি। আমি দুর্যোধন, জাতি শ্রেষ্ঠ। জয় হোক সংসদীয় গণতন্ত্রের। কংগ্রেস বলছে, কর্নাটক নাটক শেষ হলে কংগ্রেস স্বমহিমায় ফিরবে। দলে সঙ্কটকালের শুরু,  কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধি সপ্তদশ লোকসভা ভোটে বিজেপির কাছে গোহারান হারের পর পদত্যাগ করে দিয়ে বসে আছেন। বেমক্কা তিনি পদত্যাগ করে ‘গোঁ’ ধরে বসে আছেন। তিনি ‘সভাপতি পদ’ উজ্জ্বল করতেও পারবেন না। কলঙ্কিত করার দায়িত্বও নিজের কাছে রাখবেন না। অতএব? কাঁধে বাঁশ রেখে পিছনে থাকা নেতারদল গত শতাব্দীর নব্বই দশকের ভ্রুকটি দেখছেন। সনিয়া গাঁধি যে দিন দলের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, সেদিন থেকেই কংগ্রেস নামক দলটি ঘুরে দাঁড়ায়। প্রগতিশীল আধুনিক রাজনীতি-সংস্কৃতির আলোয়।   
রাহুল গাঁধি সভাপতি থাকায় অভিযোগ উঠছে, গাঁধি-নেহরু পরিবার কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করে আসছে গত এক শতাব্দী ধরে। রাহুল গাঁধি এক হেঁচকা টানে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন, একুশ শতাব্দীর গণতন্ত্র অন্য কথা বলে। কংগ্রেস দলের শীর্ষ নেতৃত্ব  নতুন সভাপতি ঠিক করুক। গত বেশ কিছু দিন কংগ্রেসের প্রবীণ এবং নবীন নেতৃত্বের মধ্যে দ্বন্দ আমরা দেখতে পাচ্ছি। টান টান উত্তেজনায় নাবিক বিহীন জাতীয় কংগ্রেস নামক এক জাহাজ বয়ে চলেছে। নৌকায় পাল আছে, হাল আছে মাঝি নেই। তবুও শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস নামক এক দল কালের নিয়মেই মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে। ঠিক এই সময় ঘটে গেল উত্তরপ্রদেশের সোনভদ্রে কৃষকদের উপর গুলি চালনার ঘটনা।
সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে সারা দেশ জেনে গেছে সোনভদ্রে ঘটনার পরে কংগ্রেস দল নতুন এক নেতা পেয়েছে। সেই নেতা তথা নেত্রীর নাম প্রিয়ঙ্কা গাঁধি বঢরাআমরা বলতে পারি সোনভদ্র কংগ্রেসের কাছে ‘নান্দীমুখ’ আলো। অন্ধকার জমির আল ধরে হ্যারিকেন হাতে হেঁটে আসছে সোনভদ্রের গোন্ড আদিবাসী সমাজের চাষি পরিবারের সদস্যরা। হিস হিস শব্দে ‘কালসাপ’ দেখেও তাঁদের ভয় নেই। ভারতে জমি আন্দোলনে ‘সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম, সোনভদ্র অপর নাম। নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রিয়ঙ্কা গাঁধি বঢরা ভারতে বন্ধ্যা রাজনীতিতে এদিন যেন ধূ ধূ জমিতে রোদের প্লাবন নেমে এসেছে। আমাদের মন বলছে, কিছুদিনের মধ্যে ঘনবর্ষার প্লাবনে ঢেউ উঠবে সারা দেশের রাজনীতিতে।    
সোনভদ্রের ঘটনার সালতামামি ঘেঁটে পাওয়া যাচ্ছে, বছরে বিঘা প্রতি ৫০০ টাকা ভাড়া হিসেবে জমির মালিকের হাতে কড়াই গোন্ডায় গুণে দিতে হত। সোনভদ্রের গোন্ড আদিবাসী পরিবারগুলিকে। ৫০০ টাকার বিনিময়ে জমি চাষ করতে লাঙল নিয়ে ক্ষেতে নামার ছাড়পত্র মিলত তাঁদের। মৌখিক চুক্তি করা থাকত এই জমি কখনও বিক্রি করা চলবে না। ১৯৫৫ সাল থেকে এই নিয়ম মেনেই আদিবাসীরা জমি ভাড়ায় নিয়ে চাষ করছিলেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম চাষ করলেও উত্তরপ্রদেশ সরকারের কাছ থেকে জমির অধিকার বা পাট্টা পাওয়া যায়নি। ‘মাই-বাপ’ বলে প্রশাসনের আধিকারিকদের কাছে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থেকেও লাভ হল না। জমি মাফিয়ার গুলিতে প্রাণ গেল ১০ জন আদিবাসী কৃষক পরিবারের সদস্যের। একটি তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ৯০ বিঘা জমিতে সোনভদ্রের আদিবাসীরা ১৯৫৫ সাল থেকে চাষ করে আসছেন। জমি আমার মা, জমি আমার ঘর। ৯০ বিঘে জমিতেই ভিটেমাটি গোন্ড আদিবাসীদের। ‘আদর্শ সমবায় সোসাইটি’-এর জমি ১৯৫৫ সালে বিক্রি করা হয়। ১৯৬৬ সালে সোসাইটির মেয়াদ ফুরনোর পরে জমির কোনও মালিকানা না থাকার সুযোগে এক জেলা শাসক সমস্ত জমি নিজের নামে করে নিয়েছিলেন। দু’বছর আগে ২০১৭ সালে ৯০ বিঘা জমি সেই স্বশাসক তথা জেলা শাসক গ্রামপ্রধান যঞ্জদত্তকে বিক্রি করে দেন। সংবাদে প্রকাশ, সিপিএমের যে প্রতিনিধি দল সোনভদ্রে গিয়েছিল সেই দলের নেতা হীরালাল যাদবের অভিযোগ, ‘’যোগী সরকারের প্রত্যক্ষ মদতেই আদিবাসীদের জমি হাতবদল হয়।‘’  সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েনের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল সোনভদ্রের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেও পুলিশ অনুমতি দেয়নি।
সোনভদ্রে আদিবাসী কৃষকদের উপর গুলি চালনার পরে একুশ শতাব্দীর প্রথম দশকের কথা অনেকে বলছেন। পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘরপোড়া গরুদের কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে ২০০৬ সালে উড়িষ্যার কলিঙ্গ নগর এবং ২০০৭ –এ অন্ধ্র প্রদেশের খাম্মামের (মুড়িগোন্ডা) ঘটনা। ২০০৮ সালে মহারাষ্ট্রের রায়গড়ে ‘সেজ প্রকল্প’-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। উত্তরপ্রদেশে যমুনা এক্সপ্রেস হাইওয়ে প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলন হয়েছিল। তখনও পুলিশ গুলি চালায়। ২০১০ সালে আলিগড় অঞ্চলে এবং ২০১১ সালে নয়ডার কাছে ভট্ট পারাশুলে পুলিশ গুলি চালায়। সবগুলিতেই নেমে এসেছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। গত দু’দশকে উন্নয়ন বনাম কৃষক প্রতিরোধ নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জমি অধিগ্রহণের নামে সরকারের দমন পীড়নের ঘটনা সব জায়গাতেই একই রকম।  
আমার নিজের মনে পড়ছে ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে ১৪ মার্চ পুলিশের গুলি চালানোর কয়েক মাস পরের ঘটনা। কলকাতার তারাতলায় একটি কারখানার সিটু ইউনিয়নের ডাকে আমি সাংবাদিক হিসেবে একটি খবর করতে যাই। আমি তখন একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলে চাকরি করি। সেদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিপিএমের ডায়মণ্ড হারবারের তৎকালীন সাংসদ শমীক লাহিড়ি এবং সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি। শমীকবাবুর সহযোগিতায় সীতারাম ইয়েচুরির একটি এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা হয়। সেদিন প্রথম সীতারাম ইয়েচুরি বলেছিলেন, শতাব্দী প্রাচীন ‘জমি আইন’-এ সংশোধনী আনতে হবে। সেদিন থেকেই বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এলো ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন।
২০০৭ সালের শেষ দিকে ইউপিএ সরকার সংসদে প্রস্তাব করল, প্রতিরক্ষা এবং পরিকাঠামো নির্মাণে অধিগ্রহণ জারি থাকলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোম্পানীকে ৭০ শতাংশ জমি কিনে নিতে হবে। বাকী ৩০ শতাংশ সরকার অধিগ্রহণ করে দেবে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের গ্রমোন্নয়নমন্ত্রকমন্ত্রী জয়রাম রমেশ নতুন এক আইনের প্রস্তাব আনেন- এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বেসরকারি উদ্যোগপতিদের শিল্পকে জনস্বার্থের প্রয়োজনে অন্তর্ভুক্ত করা। এই প্রস্তাবে চার নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে, বিশেষত পঞ্চম ও ষষ্ঠ তপশীল ভুক্ত এলাকায়, অধিগ্রহণ যথাসম্ভব স্থগিত রাখার সুপারিশ করেছে। সোনভদ্রের ঘটনা একই অভিঞ্জতা আমাদের সামনে এনে দিল। সমাজকর্মীদের বক্তব্য, পরের পর প্রজন্ম ওই জমিতে বাস করেন, চাষ করেন কিন্তু জমির পাট্টা পান না। ইউপিএ সরকার জঙ্গলের জমিতে আদিবাসীদের অধিকার সুনিশ্চিত করতে অরণ্যের অধিকার আইন এনেছিল। সেই আইনে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বনবাসীদের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। একুশ শতাব্দীর উন্নত গণতন্ত্রের ভারতে।
সেই দেশের একটি অঙ্গ রাজ্য উত্তরপ্রদেশ। কংগ্রেসের আঁতুড় ঘর নামে এক সময় পরিচিত ছিল। বিএসপি-এসপি হয়ে বর্তমানে বিজেপির আঁতুড় ঘর উত্তরপ্রদেশ। মাত্র ২৬ ঘণ্টায় পোড় খাওয়া নেতা যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে ঝড় তুলে দিয়েছেন কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা। ২০ জুলাই প্রিয়াঙ্কার বারাণসীতে যাওয়ার পর থেকে বিজেপিতে কাঁপুনি ধরে গেছে। সোনভদ্রে গুলিতে ১০ জন দলিত আদিবাসীর মৃত্যুর পরে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ যাননি। প্রিয়ঙ্কার সফরের পরে তিনি যেতে বাধ্য হলেন। এবং নিহতদের পরিবার পিছু সাড়ে ১৮ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে ঘোষণা করেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। কংগ্রেস আগেই ১০ লক্ষ টাকা করে নিহতদের পরিবার পিছু দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতিতেও মানুষের ক্ষোভ কমেনি। মুখ্যমন্ত্রীর সামনে নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছে স্বজনহারা দলিত আদিবাসীরা। সেই জন্যই সম্ভবত বিজেপির কর্নাটক পুনঃদখলের পরে প্রিয়ঙ্কা টুইট করেছেন, ‘’বিজেপি একদিন বুঝবে, দুনিয়ার সব কিছু কেনা যায় না। সব মিথ্যে কথাই এক দিন সামনে আসে।‘’       

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?