কলকাতার ‘হেরিটেজ’ রক্ষায় নীরব এবং সরব ভাষার রেখাচিত্র




দীপেন্দু চৌধুরী
কলকাতা লন্ডন হয়েছে কি হয়নি এই বিতর্ক চলতেই থাকবে। ২০১১ সালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, কলকাতা একদিন লন্ডন হবে। তারপরে আটটা বছর কেটে গেছে। কলকাতা শহর বাহ্যিকভাবে সুন্দর হয়েছে। হারিয়েছে অতীতের স্থাপত্য, ঐতিহ্য। কলকাতা পুরসভা সূত্রে খবর, কলকাতার ‘হেরিটেজ’ রক্ষার ক্ষেত্রে কলকাতা পুরসভা লন্ডনকে অনুসরণ করতে চায়। যার প্রাথমিক কাজ হচ্ছে, কলকাতা পুরসভার বর্তমান হেরিটেজ তালিকা বাতিল করে নতুন ভাবে তৈরি করা। লন্ডন শহরের ‘হেরিটেজ’ যেভাবে তৈরি করা হয়েছে সেই গাইডলাইন মেনে কলকাতায় এই তালিকা তৈরি করতে চাইছেন পুরকর্তারা। ২০০৯ সালে কলকাতা পুরসভা ১২০০ স্থান এবং ভবনকে চিহ্নিত করে হেরিটেজ তালিকা প্রকাশ করেছিল। এই তালিকায় ‘গ্রেড ওয়ান’, ‘গ্রেড টুএ’ এবং ‘গ্রেড টুবি’ পর্যায়ভুক্ত করেই হেরিটেজ কমিটি নিজেদের দায়িত্ব পালন করে। এবং পেন্ডিং তালিকায় ৩১০টি ভবনকে রাখা হয়েছে। কলকাতা পুরসভার ওয়েব সাইটে হেরিটেজ তালিকা দেখতে চাইলে পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায় না। এক লাইনে ভবনটির উল্লেখ থাকে মাত্র। যেটা থেকে হেরিটেজ ভবন সম্পর্কে উৎসাহী ছাত্র-ছাত্রী, গবেষকরা কিছুই জানতে পারেন না।  নতুন মেয়র ফিরহাদ হাকিম পুরসভার দায়িত্ব নিয়েই কলকাতার হেরিটেজ নথিভুক্ত স্থান এবং বাড়িগুলিকে আরও বিস্তারিভাবে কিভাবে চিহ্নিত করা যায়, সেই নির্দেশ দেন। ব্রিটেনে হেরিটেজ ভবনগুলির জন্য ভিন্ন ভিন্ন কোড রয়েছে। এই কোড টাইপ করে ওয়েব সার্চ করলে হেরিটেজ নথিভুক্ত একটি স্থান বা ভবনের  বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। সেই ব্যবস্থা কলকাতায় চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরসভা কতৃপক্ষ। কলকাতার গবেষকদের হেরিটেজ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য এখন পাওয়া যায়, কলকাতা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভবনের তৈরি ‘টাইমস্কেপ কলকাতা’ নামের একটি অ্যাপে।   
কলকাতার ইতিহাস, হেরিটেজ ভবন, স্থান প্রভৃতি বিষয়কে তুলে ধরতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল অব কালচারাল টেক্সট অ্যান্ড রেকর্ডস, ব্রিটিশ লাইব্রেরি এবং লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে কলকাতার হেরিটেজ নিয়ে একটি চিত্র প্রদর্শনী চলছে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভবনের ‘প্রিন্স হল’-এ। পুরো জুলাই মাস ধরে এই প্রদর্শনী চলবে। ‘ক্যালকাটা কোলাজেসঃ ইন্টারন্যাশন্যাল উইথ দ্য সিটি থ্রু কালেক্টিভ ইনেশিয়েটিভস’ শিরোনামে এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। ‘সাস্টেনেবল হেরিটেজ অ্যান্ড পলিসি ইন কলকাতা’ প্রদর্শনীটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগ বলে জানালেন, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভবনের কিউরেটর জয়ন্ত সেনগুপ্ত।
তিনটি ভাগে বিভক্ত এই প্রদর্শনীটিতে ২২টি প্যানেল রয়েছে। প্রদর্শনীর প্রথম বিভাগ সাজানো হয়েছে, কলকাতার ঔপনিবেশিক স্থাপত্য এবং ইতিহাসের বিবরণ দিয়ে। প্রথম বিভাগের একটি বড় অংশ এসেছে লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরির সহযোগিতায়। ঔপনিবেশিক যুগের সময় থেকেই কলকাতা ধারাবাহিকভাবে আশ্রয় দিয়েছে বাংলার গ্রাম এবং ভিন প্রদেশের মানুষদের। এই প্রদর্শনীর দ্বিতীয় বিভাগটি সাজানো হয়েছে ‘বিবিধের মাঝে মিলনের ঐক্য’ সংস্কৃতির আধারে। প্যানেলে রাখা হয়েছে কলকাতার সব বিখ্যাত মেস বাড়ি। এই সব মেস বাড়িতে এক সময় থাকতেন বিখ্যত খ্যাতনামা ব্যক্তিরা। যেমন উল্লেখ করা যায়, বিখ্যাত লেখক শিবরাম চক্রবর্তীর নাম। তিনি মুক্তারাম বাবু স্ট্রীটের মেসবাড়িতে মুক্ত আরামে সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। কবি জীবনানন্দ দাশও বেশ কয়েক বছর মেস বাড়িতে থেকেছেন। বাংলায় মেসবাড়ি নিয়ে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ নামে একটি ছবিও হয়েছিল। যে ছবির নায়ক নায়িকার চরিত্রে ছিলেন উত্তমকুমার এবং সুচিত্রা সেন। এই প্যানেলেই আরও রয়েছে জিউ সম্প্রদায়ের ইতিহাস এবং স্কটিশ সমাধিক্ষেত্রের তথ্য।
প্রদর্শনীর তৃতীয়ভাগ সাজানো হয়েছে, উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার একজন সফল ব্যবসায়ী এবং সমাজসেবী মতিলাল শীলের প্রাসঙ্গিক তথ্য। তৎকালীন নবাবী আমলের বাংলায় লেখা সম্পত্তির ‘দানপত্র’ (উইল)। তৎকালীন আদালতের ‘মুহুরি’-র হাতে লেখা খসড়া, ঐতিহাসিক এই দলিল যেমন পাওয়া যায়, পাশাপাশি মতিলাল শীল কলকাতা সম্পর্কে কতটা চিন্তা করতেন সেই তথ্যও উঠে আসে।
প্রদর্শনীর উদ্বোধনে এসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী বলেন, গত চার পাঁচ বছর ধরে ‘কলকাতার হেরিটেজ’ নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছেযাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি আছে। পরিকাঠামো আছে। টেকনোলজি আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্নরকমভাবে সাহায্য করতে পারে।‘’
তিনি আরও বলেন, ‘’আমি বর্তমান কলকাতা শহর নিয়ে খুব কিছু আগ্রহী নই। বর্তমান শহর নিয়ে আমার ততটা আবেগও নেই। পূর্ব কলকাতার জলাভূমি প্রায় হারিয়েই গেল। উনবিংশ শতাব্দীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে আমার আগ্রহ আছে। কলকাতার ‘ইন্টেলিজেনসিয়া’ আজও বিশেষ গুরুত্ব দাবি করে। হেরিটেজও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কলকাতার স্থাপত্য একটা সময় গর্ব করার মতো ছিল। ঔপনিবেশিক আমলের কলকাতা শহরের স্থাপত্য শৈলী আজও আমাদের অহংকার। কলকাতার অতীতের সঙ্গে বর্তমান শহরের একটি লিঙ্ক অত্যন্ত জরুরী।‘’
হেরিটেজ গবেষক অধাপক অভিজিৎ গুপ্ত বলেন, ‘’কলকাতার হেরিটেজ চিহ্নিত স্থান, বাড়িগুলিকে ভালো করে জানতে রাজ্যের পর্যটন দপ্তর কিছু পরিকল্পনা নিয়েছে। বাড়িগুলির সামনেটা সুন্দর করে সাজিয়ে সেই স্থান বা বাড়ির সময়কাল, ইতিহাস, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি ‘অডিও-ভিস্যুয়াল’-এর মাধ্যমে দেখানোর পরিকল্পনা করেছে রাজ্য সরকার।‘’
                        

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?