ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্তে ব্রিটেন অটল থাকলে ‘আত্মহত্যার’ সামিল হবে



 দীপেন্দু চৌধুরী
দিনটা ছিল ২ জুলাই, ২০১৯স্থান ফ্রান্সের স্ত্রাসবুর্গ শহর। এই শহরেই ইউরোপীয় পার্লামেন্টের উদ্বোধনী অধিবেশন অনুষ্ঠানে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনার সঙ্গে সম্প্রতি আমাদের পরিচয় হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের সৌজন্যে। সেদিন ওই অনুষ্ঠানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সঙ্গীত ‘অ্যান্থেম অব ইউরোপ’ বাজানোর সময় ব্রিটেনের ব্রেক্সিট পার্টির ২৯জন সদস্য পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন। এই আচরণের জন্য তাঁদের ভৎর্সিত হতে হয়। ব্রেক্সিট পার্টির ২৯জন সদস্যকে ভৎর্সনা করে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট আন্তোনিয়ো তাইয়ানি বলেছেন, ‘’আপনারা ইইউ ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে হতেই পারেন। কিন্তু ইইউকে এ ভাবে অপমান করতে পারেন না।‘’
ব্রিটেন সহ সারা বিশ্বে ‘ব্রেক্সিট’ আজও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০১৬ সালে কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য লর্ড মাইকেল অ্যাশক্রফট (Lord Michel Ashcraft) ১২, ৩৬৯ জন ব্রিটিশ নাগরিকের মধ্যে একটি সমীক্ষা করেন। এইসব নাগরিকদের ৬৯ শতাংশ মনে করে ইউকে-এর পরিবেশ রক্ষার জন্য ব্রেক্সিটের প্রয়োজন আছে। ওই সব নাগরিকদের অভিমত ইইউ-এর সদস্য হওয়ার কারণে ‘’গ্রীন মুভমেন্ট’’ ব্রিটেনে দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং দূষণের পরিমাণ বাড়ছে। আর একটি সমীক্ষা থেকে যে তথ্য পাওয়া যায়, প্রতি তিনজন ব্রিটিশ নাগরিক মনে করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা উচিৎ। ব্রিটেনের অর্ধেক নাগরিকের অভিমত ২৯ মার্চের আগে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে যে বোঝাপড়া ছিল সেই অবস্থান বজায় থাকুকব্রিটেনে-র সাধারণ মানুষের অবস্থান, শাসকদল যে সিদ্ধান্ত নেবে তাঁরা সেই সিদ্ধান্তে সহমত পোষণ করবে। সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, ব্রিটেন এই জটিল সমস্যা থেকে বেরিয়ে আস্তে আরও একবার ‘ব্রেক্সিট ইস্যু’-তে নির্বাচনে যেতে পারে।
ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য থাকবে কি থাকবে না এই সিদ্ধান্তের জন্য আমাদের আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। তার আগে কলকাতায় একটি বিতর্ক সভায় রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অব কালচার-এর সচিব স্বামী সুপর্ণানন্দের একটি মন্তব্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যথেষ্ট আলোড়ন ফেলেছে। তিনি বলেন, ‘ব্রিটেন ব্রেক্সিট সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে তা সেই দেশের পক্ষে আত্মহত্যার সামিল হবে।’ ব্রেক্সিট বিষয়ক একটি আলোচনা সভায় এই মন্তব্য করেন স্বামী সুপর্ণানন্দ। সেদিনের আলোচনায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে আসলে তার প্রভাব ভারতেও পড়বে এই দাবি করেন রাষ্ট্রদূত ভাস্বতী মুখার্জী। আলোচনাসভার সুরটা প্রথমেই বেঁধে দিয়েছিলেন, স্বামী সুপর্ণানন্দ। তাঁর সুরে সুর মিলিয়ে রাষ্ট্রদূত ভাস্বতী মুখার্জী কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করেন। এর মধ্যে অন্যতম ব্রেক্সিটের পরে ইইউ এবং ব্রিটেনের সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতে কি প্রভাব পড়তে পারে।
ইইউ হচ্ছে ভারতের কাছে সব থেকে অন্যতম বড় ব্যবসায়ীক পার্টনার। ভারতের পণ্য সামগ্রী ব্যবসার ১৩% ইইউ-এর সঙ্গে হয়। ইইউ-এর মোট বাণিজ্যের ২.৩% ভারতের সঙ্গে, এবং ইইউ হচ্ছে ভারতের কাছে বিশ্বের ৯ নম্বর বৃহৎ সহযোগী ব্যবসায়ীক গোষ্ঠী বছরে ৯১ বিলিয়ন ইউরো ব্যবসা হয়ে থাকে ইইউ এবং ভারতের মধ্যে সেখানে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের (ইউকে) ব্যবসার পরিমাণ ১৯.৪ ইউরো। ইউরোস্টাটের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, পরিষেবা বিষয়ক ব্যবসা বিনিময় (Indian Service exports) ক্ষেত্রেও এগিয়ে রয়েছে ভারত এবং ইইউ গোষ্ঠীর ব্যবসায়ীক সম্পর্ক। ভারত থেকে ইইউ-তে পরিষেবা ক্ষেত্রে রফতানির পরিমাণ ২০১৮ সালে ছিল ১৬.৬ বিলিয়ন ইউরো। সেখানে আমদানির পরিমাণ ছিল ১৭.১ বিলিয়ন ইউরো। এই সেক্টরে গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে ইইউ গোষ্ঠীভুক্ত দেশ জার্মান, নেদারল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামের ভারতে বিনিয়োগের পরে। এবং ইউকে-র বিনিয়োগ এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। পরিষেবা ক্ষেত্রে ভারতে বিদেশী বিনিয়োগে (এফডিআই) ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভূমিকা যথেষ্ট সদার্থক।
ভারত ২০১৫ সালে আনুমানিক ৩.৬৪ বিলিয়ন অতিরিক্ত ইউএস ডলার ব্যবসা করে ইউকে-র সঙ্গে। ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরে ইউকে-র সঙ্গে ভারতের রফতানির পরিমাণ বেড়ে হয় ১৩.৬%। একই বছরে ইউকে থেকে আমদানির পরিমাণ বেড়ে হয় ৩১.২%। পাউন্ডের সঙ্গে তুলনা করলে ভারতের বাণিজ্যিক ভারসাম্য ৪.৮৩ ইউএস ডলারে এসে দাঁড়ায়িছে। সঠিকভাবেই ভারতের সঙ্গে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে পাউন্ডের হার নিম্নগামী হতে থাকে টাকার সঙ্গে পাউন্ডের বিনিময় হার নিম্নগামী হওয়া এবং ব্রেক্সিটের কারণে ব্রিটেনের জিডিপি ২০১৭ সালে ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই হিসেব জিডিপি এবং মানব উন্নয়ন সূচক ধরে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ১৯.৪ বিলিয়ন ইউরো ভারতের সঙ্গে ইউকে-র ব্যাবসায়ীক অংশীদারিত্ব রয়েছে। তবুও ইউকের ৪০০ ভারতীয় সংস্থার প্রতিনিধি (যারা ব্রিটেনের নাগরিক) আতঙ্ক থেকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। ব্রেক্সিটের পরে যুক্তরাষ্ট্রে (ইউকে) তাঁরা কতটা নিরাপদ সেই আশঙ্কা থেকে। ব্রেক্সিটের কারণে অনুমান করা যায় যুক্তরাষ্ট্রে(ইউকে) ৮০০ ভারতীয় সংস্থা সমস্যায় পড়তে পারে। এই সব সংস্থা প্রতি বছর ১,১০,০০০ চাকরির সংস্থান করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রতে (ইউকে)।
পর্যটন এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে এই কর্মসংস্থান ভারত থেকে ইউকেতে হয়। এইসব সংস্থাও ব্রেক্সিটের কারণে আতঙ্কিত। ভাস্বতী মুখার্জী দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উধৃতি উল্লেখ করেছেন। একটি হচ্ছে ‘বাজোরিয়া’ শিল্প গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান শিশির বাজোরিয়া বলেছেন, ‘ভারতের ৮০০ মিলিয়ন তরুণ যুবকের চাকরির প্রয়োজন। আমরা ইউকের সঙ্গে ব্যবসা করি। ব্রেক্সিট হলেও আমরা ইউকের সঙ্গে ব্যবসা করব, ব্রেক্সিট না হলে ও আমরা ব্যবসা করব। পাশাপাশি আমরা ইইউ-এর সঙ্গেও ব্যবসা করব। ব্রেক্সিট হলে ব্যবসা চলবে, না হলেও আমরা যেমন ব্যবসা করে থাকি তেমনি করব। শিশির বাজোরিয়া একথা বলেন ২০১৬ সালে। দ্বিতীয়টি ২০১৯ সালে ‘দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় পঙ্কজ মিশ্র ‘’The malign incompetence of the British ruling class’’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। সেই নিবন্ধে তিনি বলেছেন, যদি ব্রেক্সিট শেষ পর্যন্ত হয় তাহলে আয়ারল্যান্ডে রক্তবন্যা হতে পারে এবং স্কটল্যান্ডে এর প্রভাব ব্যপকভাবে পড়বে। সাধারণ ব্রিটিশ নাগরিক বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে পারে, তাঁরা অশান্তি ডেকে আনতে পারে। সাধারণ ব্রিটিশ নাগরিক ব্রেক্সিট ডিল সমর্থন করছে না। পঙ্কজ মিশ্র লিখছেন, ‘’More ugly historical ironies may yet way lay Britain on its treacherous road to Brexit.’’ এই বিতর্ক সভায় নিজদের যুক্তি সাজিয়েই এসেছিলেন কলকাতার ব্রিটিশ দূতাবসের উপ রাষ্ট্রদূত  ব্রুস বাকনেল (Bruce Bucknell)তিনি স্বীকার করেন,  ভারতের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা বাণিজ্য খুব ভাল আমিও বলব না। ভারতে নির্বাচন থাকার জন্য ব্যবসা বাণিজ্য ভালো না হওয়ার একটা কারণ হতে পারে। আমদের সরকার আর্থিকভাবে দুর্বল নয়। বেতন, পেনশন সহ সব রকমের সরকারি সাহায্য দিতে সক্ষম। কূটনৈতিক বিষয়ে কোনও মন্তব্য আমি করতে আগ্রহী নই। সব থেকে বেশি ছাত্র-ছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য ভারত থেকেই ইউকেতে পড়তে যাচ্ছে। গত আর্থিক বছরে অন্যান্য আর্থিক বছরের তুলনায় ১০০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী বেশি পড়তে গেছে আমাদের দেশে। শিশির বাজোরিয়া এবং পঙ্কজ মিশ্রের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ইউকের উপ রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য, উন্নত গণতন্ত্রে মন্তব্য করার স্বাধীনতা সকলের আছে। আমি ব্রেক্সিটকে সমর্থন করেই বলছি, ব্রেক্সিট হলে আমরা নতুন অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারব। স্টার্টআপ, ফাইনান্সিয়াল হাব, পরিষেবা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্রিটেন উন্নতি করবে। ব্রেক্সিট হলে ভারতের সঙ্গে আরও ভালো ব্যবসা হবে। ব্রুস বাকনেল (Bruce Bucknell) বলেন, ‘’Speed of negotiation of agreement of the Brexit means peaceful change, peaceful Europe. পরে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বাকনেল জানান, কমনওয়েলথ গোষ্ঠীকে আরও শক্তিশালী করাটা ব্রিটিশদের কাছে অন্যতম স্বপ্ন। একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ‘দুনিয়া কাঁপানো একদিন’ কি সত্যিই বিশ্বে নতুন ভারসাম্যের সংযোজন করতে চাইছে। শেষ কথা সময় বলবে।                                                            

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?