‘অজগর ক্ষুদিত হলে আরসুলা খায়না’





দীপেন্দু চৌধুরী 
আমি যখন কলকাতা থেকে শহরতলির রেল স্টেশন হয়ে বাড়ি ফিরি তখন ট্রেনের জানলা থেকে দেখি বালিগঞ্জ স্টেশনের ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে একটি ১০-১১ বছরের মেয়ে ‘মাদারিকা’ খেল দেখাচ্ছে। আমি কোনদিন প্ল্যাটফর্মে বসে পুরো খেলা দেখি। আবার যাদবপুর, অথবা সোনারপুর স্টেশনকেও মেয়েটি বেছে নেয় খেলা দেখাবার জন্য। আগে ওদের বাবা-মা-য়েরা ধর্মতলায় খেলা দেখাত। মনুমেন্ট অর্থাৎ অধুনা শহীদ মিনারের তলায় আগে মাদারিকা খেল দেখা যেত। আমার নিজের জীবনওতো আজও বেদুইনদের মতোই। তাই ‘বোম্বে টু গোয়া’ না হোক। ‘শিয়ালদহ টু বারুইপুর’ সপ্তাহে পাঁচদিন মানুষের কলরবে মিশে থাকি। অবঞ্জা, অবহেলা, অপমান, মিথ্যে অপবাদের আড়ালে নিত্য যাত্রীদের উৎসাহ দেখি। এক একটি পরিবার, এক একজন ব্যক্তির জীবন সংগ্রাম, হকারদের লড়াই সব কিছু একাকার হয়ে যায় ‘পাখি সব করে রব/ রাত্রি পোহাইল’-এর অবকাশে।    
খুব অল্প সময়ের জন্য ‘মাদারিকা খেল’-এর এই খেলা মেয়েটি তার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে দেখায় ভাইয়ের বয়স সাত আট বছর। ১ নম্বর বা ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মের সঙ্কীর্ণ একটু জায়গা বেছে নিয়ে ছোট ছোট দুটো বাঁশের লাঠি দু’প্রান্তে আড়াআড়ি জুড়ে পাটের শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা। দু’দিকের বাঁশের সঙ্গে দড়ি বাঁধা। সেই দড়ি ধরে ভাই- বোন মাদারিকা খেল দেখায়। প্ল্যাটফর্মের মেঝেয় চলে শারীরিক কসরতের খেলা। ভাই-বোনের দু’জনের গায়ের পোশাক অত্যন্ত মলিন। গায়ের জামা দেহের ঘামে ভিজে, ধুলোয় লেপ্টে আছে। নাকের পোটা হাতের তালুতে মোছার জন্য মেয়েটির গালে মোটা ধুলোর আবরণ। ভাইয়ের অবস্থা আরও করুণ। স্টেশনের মেঝেয় একটা অ্যালোমিনিয়ামের ধুলো মাখা থালা। তাতে কিছু খুচরো এক দু’টাকা থাকে। মাঝে মাঝে পাঁচ-দশ টাকার নোটও দেখতে পাওয়া যায়। পেট ভরে খাবার না পাওয়ার জন্য ভাইটা মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ওরা দু’জনে খেলা দেখাচ্ছে। আচ্ছা ওরা কি জানে বিহারের শিশু মৃত্যুর খবর? সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে, মুজফফরপুর এবং আশপাশের এলাকায় ‘অ্যাকিউট এনসেফালাইটিস সিন্ড্রোম (এইএস)-এর কারণে গত একমাসে অন্তত দেড়শো শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বিহারে শিশু মৃত্যুমিছিল গত কয়েক বছরের। আজ পর্যন্ত শিশু সাহিত্য বা দলিত সাহিত্যে কি এই বিবরণ উঠে এসেছে?
দলিত সাহিত্য কি? দলিত কাদের বলব? আজকের সহিষ্ণু ইন্ডিয়ায়? অসহিষ্ণু ভারতে? ‘হুতোম প্যাঁচার নকশায়’-য় কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখছেন, ‘’পাঠক কতকগুলি আনাড়িতে রটান, হুতোমের নকশা অতি কদর্য বই, কেবল পরনিন্দা পরচর্চা খেঁউড় ও পচালে পোরা ও সুদ্ধ গায়ের জ্বালা নিবারণার্থ কতিপয় ভদ্রলোককে গাল দেওয়া হয়েচে। এটি বস্তবিক ঐ মহাপুরুষদের ভ্রম; একবার ক্যান, শতেক বার মুক্ত কন্ঠে বলবো— ভ্রম। হুতোমের তা উদ্দ্যেশ্য নয়, তা অভিসন্ধি নয়, হুতোম ততদূর নীচ নন যে, দাদ তোলা কি গাল দেবার জন্য কলম ধরেন। জগদীশ্বরের প্রসাদে যে কলমে হুতোমের নকশা প্রসব ক্রেচে, সেই কলম ভারতবর্ষের প্রধান ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রের উৎকৃষ্ট ইতিহাসের ও বিচিত্র চিত্তোৎকর্ষবিধায়ক মুমুক্ষু সংসারী, বিরাগী ও রাজার অনন্য-অবলম্বন-স্বরূপ গ্রন্থের অনুবাদক; সুতরাং এটা আপনি বিলক্ষণ জানবেন যে, অজগর ক্ষুধিত হলে আরসুলা খায় না ও গায়ে পিঁপড়ে কামড়ালে ডঙ্ক ধরে না। হুতোম বর্ণিত বদমাইশ ও বাজে দলের সঙ্গে গ্রন্থকারেরও সেই সম্পর্ক।‘’ (পৃষ্ঠা- ৫)
একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি অজগর ক্ষুধিত হলে কি খায়? অজগর ক্ষুধিত হলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে কৃষক শ্রমিকের ঘামে ভেজা উৎপাদনের উদ্বৃত্ত মূল্য যেমন খেত। ব্রিটিশ উত্তর ভারতেও দলিতের ঘামে ভেজা শ্রমের উদ্বৃত্ত খেয়েছে অজগরের দল। সত্য উত্তর বা ‘পোস্ট ট্রুথ’ সময়ের বিষধর ফনী আরও কৌশলী পথ খুঁজে নিতে চাইছে। ভারতে দলিত রাজনীতি মাত্র কয়েক দশক আগের ঘটনা। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এই আন্দোলনের শুরুটা হয়েছে বলা যায়। মহারাষ্ট্রে ‘দলিত প্যান্থার’ নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠার পর থেকেই ভারতে রাজনীতির পরিভাষায় দলিত শব্দটি আমরা পেয়েছি এমনটা বলা যায়। দলিত কে বা কারা? বহু আলোচিত যাদের এক কথায় বলা যায় সমাজের নিম্ন বর্গের শ্রেণি চেতনায় উদাসীন কিন্তু নিজদের স্বতন্ত্রতা সম্পর্কে সচেতন জঙ্গী অংশের নাম দলিত। ১৯৮১ সালের জনগননায় ভারতের মোট জনসংখ্যা ৭৫ কোটির মধ্যে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ মানে যে সব মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী বলে চিহ্নিত হয়েছিল, দলিতরা হল তাঁদেরই একান্তভাবে গোষ্ঠী সচেতন, সংঘবদ্ধ একটি অংশ। বর্তমান ভারতে ১৩০ কোটি মানুষের বসবাস। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০-৬০ কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করেন। ধর্ম বর্ণ বর্গ ভেদাভেদে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে এই দলিত শ্রেণীর মানুষ আছেন।
ভারতে সাহিত্য সমালোচনায় ‘রাজনৈতিক উপন্যাস’ শব্দবন্ধটি খুব সাম্প্রতিককালের। প্রাবন্ধিক শিশিরকুমার দাশ একটি নিবন্ধে লিখছেন, ‘’ঊনিশ শ’ চব্বিশ সালে স্পিয়ার সাহেব যখন ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় রাজনৈতিক উপন্যাসের বিকাশ নিয়ে বই লিখেছিলেন (অনেকেই ঐ বইটিকে ‘রাজনৈতিক উপন্যাস’- বিষয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য রচনা বলে মনে করেন) তখন পশ্চিমী জগতেও ‘রাজনৈতিক উপন্যাস’- এই শ্রেণীবিভাগ অনেকেরই মনঃপুত হয়নি। আর আমাদের দেশে তখনও রাজনৈতিক উপন্যাসকে একটি স্বতন্ত্র শ্রেণীর উপন্যাস হিসেবে মেনে নেওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ ছিল না।.........।’’ ব্রিটিশ ভারতে অথবা প্রাক স্বাধীনতা পর্বে রাজনৈতিক উপন্যাস আমাদের দেশে কতগুলি লেখা হয়েছিল? এই উপন্যাস উনবিংশ শতাব্দীতে লেখা শুরু হয়েছিল এমন দাবি করাটা মনে হয় খুব কিছু অবান্তর হবে না। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যেয়ের ‘আনন্দমঠ’।    স্বাধীনতার পরে আমাদের দেশে বিভিন্ন ভাষায় এক ধরণের উপন্যাস আমরা পেয়েছি। যে সাহিত্যের বিষয় সমকালীন সরকারের কাজের ধারা, কৌশল, সরকারি দল এবং বিরোধী দলের সামাজিক অবস্থান, সেইসব দলের নেতাদের চরিত্রের ব্যাখ্যা আমরা পেয়েছি। হিন্দি সাহিত্যে প্রেমচন্দ্ এবং কিষাণ চন্দের নাম উল্লেখ করা যায়। এবং উর্দু সাহিত্যে সাদাত হাসান মান্টো-র লেখায় নীম্নবর্ণের মানুষের আখ্যান উঠে এসেছিল। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর ভারতে দলিত সাহিত্যের সঙ্গে  আমরা কতটা পরিচিত হতে পেরেছি বা পারছি?
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বস্তার সলিডারিটি নেটওয়ার্ক (কলকাতা)-এর উদ্যোগে ২য় কলকাতা জনতার সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করা হয়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের লেখক, কবি, চলচ্চিত্র পরিচালকরা এসেছিলেন। পাকিস্তান থেকে আফজল আহমেদ সইদ এবং তনভীর আঞ্জুম আমন্ত্রিত থাকলেও দু’জনেই আস্তে পারেননি।  কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী হামলার কারণে তাদের ভিসা দেওয়া হয়নি। এমনটাই অভিযোগ ছিল উদ্যোক্তাদের। দিল্লি থেকে এসেছিলেন লেখক শাহ আলম খান। তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের প্রত্যেকের কাছে উপাখ্যান আছে। আমরা পার্ট অব সিস্টেম। আমাদের জাতীয়তাবাদ বিরোধী বলা হোক তবু আমরা লিখে যাব।’ উমা চক্রবর্তী লেখক বা সাহিত্যিক নন। তিনি পাঁচজন লেখিকার পাঁচটা গল্প থেকে সিনেমা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মীনাক্ষী সেনের জেলের মধ্যে জেল। উমা বলছিলেন, ‘আমি লেখক বা সাহিত্যিক নই। আমি সিনেমা করি। লেখক সমাজকর্মী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আমরা একই মঞ্চ থেকে করতে পারি। তিন তালাক সমস্যা নয়। বড় সমস্যা দারিদ্র, অবিচার ঘৃণা, অবহেলা। এই সভ্যতার বড় অভিশাপ।’
অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে এসেছিলেন লেখিকা ভারালক্ষ্মী। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র নিজের স্বার্থেই অনেক গল্প তৈরি করে। রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের আদর্শের লড়াই। আমি নিজে ‘বিপ্লবী লেখক সংঘ’-এর সঙ্গে যুক্ত। ভারাভারা রাও ভালো কবি এবং সমাজ কর্মী। দু’টো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভারতে বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। এক ‘মাওবাদী’ নামে সাধারণ মানুষকে তথা দলিতকে হত্যা করা হচ্ছে। এবং মুসলিমদেরও সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আদিবাসী এবং দলিতরাও আজ আক্রান্ত। দন্ডাকারণ্যকে কেন্দ্র করে ধারাবাহিক সাহিত্য আমরা পড়েছি। বর্তমানে নতুন উপাখ্যান লেখার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে।‘’
কলকাতার ২য় সাহিত্য উৎসবের শুরুতেই যে কথা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন সাংবাদিক, লেখক এবং সমাজকর্মী নীলাঞ্জন দত্ত। তিনি বলেন, ‘ এটা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ‘বোল কে লব আজাদ হ্যায় তেরে’।’ ফৈয়জ আহমেদ ফৈয়জ-এর একটি লাইন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘ভারতে যে পরিস্থিতির মধ্যে আমরা বাস করছি সেখান থেকে দলিত সমাজের সাহিত্যের আরও প্রসার এবং প্রচারের প্রয়োজন আছে। বর্তমান সাহিত্যের ধারা স্থিতাবস্থার ধারা। এই ধারাকে দলিত সাহিত্য ভাঙতে চায়।’
এই বছরের ফেব্রুয়ারির শীতের দুপুর-সন্ধ্যায় বস্তার সলিডারিটি নেটওয়ার্ক কলকাতা চ্যাপ্টারের উদ্যোগে  দু’দিনের অনুষ্ঠানে নীলাঞ্জন দত্ত সহ অন্যান্য বক্তারা উনবিংশ শতাব্দীর হুতোমের বলা কথা ‘অজগর ক্ষুধিত হলে আরসুলা খায় না ও গায়ে পিঁপড়ে কামড়ালে ডঙ্ক ধরে না’ আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে গেছেন। সভ্যতা পিছনের দিকে হাঁটতে চাইছে? না আমারা ‘দলিত ভাষা’ চিনে শিল্প সাহিত্যে তুলে আনার নতুন সভ্যতার দায়িত্ব অস্বীকার করছি? প্রতিদিন রক্তিম সন্ধ্যয়, রক্তাক্ত সন্ধ্যায় দলিতের চিৎকৃত মেঘাচ্ছন্ন সামাজিকতায় আমাদের দায়বদ্ধতা কি বাড়ছে, না কমছে? নাগরিক আঙিনার অন্ধকারে আচ্ছন্ন মানুষের জন্য মানুষের কথা বলার খোঁজ নিতে হবে আমাদের। পাথর চাপা কান্নার খোঁজ, ঘামের খোঁজ, ভাতের খোঁজ, মানবতার খোঁজ। পাগল মেহের আলির কন্ঠে বারে বারে বলতে হবে, সব তফাৎ যাও, সব তফাৎ যাও। রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’ উপন্যাসে আমাদের যে কথা মনে করিয়ে দিয়ে গেছেন।                        
                 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?