উদ্বৃত্ত জমিতে চটকল মালিকরা সহায়ক শিল্প করলে রাজ্যের আপত্তি নেই





দীপেন্দু চৌধুরী
ভারতে সপ্তদশ নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনের আগে বিরোধিদের তোলা প্রধান ইস্যু ছিল বেকারত্ব। নোট বাতিলের পরে দেশে বেকারির হার বেড়ে হয়েছে ৬.১ শতাংশ। যে হার গত ৪৫ বছরে সবথেকে বেশি। ন্যাশন্যাল স্যাম্পল সার্ভে অফিসের প্রকাশিত রিপোর্ট থেকেই এই তথ্য উঠে এসেছে। ভোটের আগে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার এই তথ্য প্রকাশ করেনি। ভোট মিটতেই কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যানমন্ত্রক বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। চাকরি না পাওয়া বেকারদের সংখ্যা গ্রামীণ অঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলে অধিক। আমরা এর আগে একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেছি যে গ্রামে বেকারত্বের হার ৫.৩ শতাংশ তুলনায় শহরে এই হার ৭.৮ শতাংশ। গত কয়েক দশকের পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখে বাজারে যে চাকরি নেই এই সত্য রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারও মেনে নিয়েছিল। বামফ্রন্ট আমল থেকেই আমাদের রাজ্যের বন্ধ কারখানার বিতর্কিত জমিতে নতুন শিল্প গড়ে তোলা যায় কিনা এই নিয়ে অনেক অনেক আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মত উঠে এসেছে।  
সম্প্রতি লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন ২৫ এপ্রিল দুর্গাপুরে একটি জনসভায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, বন্ধ রাষ্ট্রায়ত্ব কারখানা রাজ্য সরকারের হাতে কেন্দ্রীয় সরকার আইনিভাবে তুলে দিলে রাজ্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবে। আমরা শ্রমিকদের সঙ্গে আছি। মুখ্যমন্ত্রীর এই বার্তা নিয়ে আমরা শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তার আগে সিটু নেতা অনাদি সাহুর সঙ্গে কথা বলি। এবং আইএনটিইউসি নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলি রাজ্যের শিল্প ব্যবস্থা নিয়ে। সিটুর বক্তব্য, নতুন শিল্প গড়ে উঠলে আমাদের আপত্তি থাকবে কেন? বামফ্রন্ট সরকার সিঙ্গুরে নতুন শিল্পই গড়তে চেয়েছিল, কিন্তু তৎকালীন বিরোধী দলের শিল্পবিরোধী আন্দোলনের জেরে টাটারা পাততাড়ি গুটিয়ে গুজরাটের সানন্দে চলে গেল। তার খেসারত আজও বাংলাকে দিতে হচ্ছে। প্রশ্ন করেছিলাম, বাংলায় যে সব চালু শিল্পে শ্রমিকরা কাজ করছেন তাঁরা বর্তমানে সুরক্ষিত? সিটু এবং আইএনটিইউসি সূত্রে খবর, সব থেকে খারাপ অবস্থা চটকল শ্রমিকদের।
গত কয়েক দশকের ধারাবাহিকতা একইরকমভাবে চলছে জুট ইন্ডাস্ট্রীতেবর্তমানে পরিস্থিত আরও খারাপ। অনাদি সাহু জানালেন, নির্বাচনের আগে ১৬ মার্চ চটকল শিল্পে ধর্মঘট হয়েছে। মজুরি বৃদ্ধি, প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রাপ্য টাকার দাবি, ‘গ্র্যাচুইটি’-র বকেয়া টাকার দাবি, শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা সহ একাধিক দাবিতে চটকল শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। জুট শিল্পকে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব শিল্প বলতে রাজি নয়। তাদের ব্যাখ্যা, জুট মিলের জমি সরকারি জমি। এইসব জমিতে জুট শিল্পের বাইরে ‘রিয়েল এস্টেট’ বা ‘প্রোমোটিং’ ব্যবসা শুরু করতে চাইছে কয়েকজন সুযোগ সন্ধানী মালিক গোষ্ঠী। চট শিল্পের মালিকরা শিল্পপতি নন। ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠে এইসব জুট মিল। এই সব মিলের মালিকরা মূলত ‘মিডলম্যান’ হিসেবে কাজ করত। এরা ট্রেডিংয়ের ব্যবসা করত। ব্রিটিশ মালিকদের কাছ থেকে এই মিডলম্যান ‘ট্রেডার্স’-রা জুট মিল ইজারা অথবা ঠিকেতে নিয়ে ব্যবসা করত। সময়ের কালচক্রে এঁদের মতো মধ্যস্বত্বভোগীরদল জুট শিল্পের মালিকানা পেয়ে গেল। শিল্পপতিরা বিনিয়োগ করে ব্যবসা করে। চার-পাচ বছর পর লাভের টাকা ঘরে তোলে। কিন্তু চট শিল্পের মালিকরা ১০০টাকা বিনিয়োগ করে ১০০টাকা একই মরশুমে লাভ করতে চায়। ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের মতে এই কারণে পেনশন পান না বেশিরভাগ শ্রমিক। শ্রমিকদের জমানো টাকা ব্যাবসায় বিনিয়োগ করেন জুট শিল্পের মালিকরা। সেই কারণেই মার্চ মাসে বেতন এবং ডিএ বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিক ইউনিয়নগুলি ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। সূত্রের খবর, স্থায়ী  শ্রমিকদের বেতন বেড়েছে মাত্র দু’টাকা। নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি মজুরি বৃদ্ধির চুক্তি হয়েছে। সিটু এই চুক্তিতে সই করেনি। ট্রেড ইউনিয়নগুলির আরও অভিযোগ ৮০% অস্থায়ী শ্রমিক কাজ করেন এই শিল্পে। ‘বদলি’ শ্রমিক হিসেবে রেজিস্টার পুল আছে। কিন্তু ২৮০ দিনের বেশি কাজ করলেও তাঁকে স্থায়ী শ্রমিক হিসেবে নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। বছরের পর বছর অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবেই কাজ করে যেতে হয় অনাহারে থাকা ভগ্নস্বাস্থ্যের এই সব ‘ঠিকা’ শ্রমিকদের। লোকসভা ভোটের আগে ধর্মঘটের সময় বস্ত্রমন্ত্রক জানায়, বস্তা তৈরি করার জন্য একজন শ্রমিকের মাথাপিছু মজুরি দৈনিক পাঁচশো বিয়াল্লিশ টাকা ধরা হয়। কেন্দ্রের নির্দেশ মেনে একটি চটকলে বস্তা তৈরি করলে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বরাত চুক্তি’ অনুযায়ী একজন শ্রমিক পিছু পাঁচশো বিয়াল্লিশ টাকা দেওয়া হয়। রাজ্যের ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের অভিযোগ, রাজ্যের কোনও চটকলে পাঁচশো টাকার বেশি মজুরি দেওয়া হয় না। ভোটের পরে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে শ্রমিকরা আরও বড় আন্দোলনে যেতে চাইছে। একটি সূত্রের খবর, রাজ্যের চুয়াল্লিশটি চটকলে শ্রমিকদের বকেয়া প্রভিডেন্ট ফান্ডের পরিমাণ ২২৭ কোটি টাকার বেশি। যদিও রাজ্যে আটান্নটি চালু চটকল রয়েছে। ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বে শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে প্রভিডেন্ট ফান্ড বাবদ বকেয়া পাওনা টাকা থেকে আদায় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ৮ কোটি টাকা। অবসর বাবদ প্রাপ্য ‘গ্র্যাচুইটি’-র টাকার পরিমাণ হবে হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের অভিযোগ, কয়েক হাজার শ্রমিক গ্র্যাচুইটি না পেয়ে মারা গিয়েছেন। টাকার অভাবে সময়মতো চিকিৎসা করাতে না পারার কারণে। সুষম খাদ্যের অভাবে অনেকের ক্ষেত্রে অকাল বার্ধক্য নেমে এসেছে। সূত্রের খবর, এই শিল্পে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ৪১,০০০। অস্থায়ী শ্রমিক এবং অন্যান্য বিভাগে কর্মরত কর্মী সংখ্যা ধরলে এই শিল্পে বর্তমানে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা দেড় লক্ষেরও বেশি।   
 চট শিল্পের অবস্থা আগেরমতো রয়েছে এমনটা বলা যাবে না। চটের বস্তা ব্যবহার নিয়ে মালিকদের অভিযোগ ধোপে টিকছে না। ২৩ মে ভোটের ফল প্রকাশের আগে কেন্দ্রীয় খাদ্য ও বস্ত্রমন্ত্রক একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে জানায়, কেন্দ্র চলতি মরশুমে (জুন-নভেম্বর) কমপক্ষে ১৭.৮১ লক্ষ বেল চটের বস্তা কিনবে ( ১ বেলের অর্থ ৫০০ বস্তা)। গত বছর এটা ছিল ১৬.৫০ লক্ষ বেল। এই বৈঠকে উপস্থিত ছিল চট শিল্পের সঙ্গে যুক্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, চটকল মালিকদের সংগঠনের প্রতিনিধি এবং রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি। চট শিল্প মহল সূত্রে খবর, চাহিদা মেটাতে চটকলগুলিকে ৯০ কোটি বস্তা তৈরি করতে হবে। যার দর প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা। খাদ্য ও বস্ত্র মন্ত্রকের দেওয়া এই বরাতের ৭০-৮০% জোগান দিতে হবে পশ্চিমবঙ্গের চটকলগুলিকেসেই সুবাদে বলা যায় এ ক্ষেত্রে উপকৃত হবেন এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কয়েক লক্ষ চাষি এবং শ্রমিক। ‘জুট প্যাকেজিং মেটিরিয়ালস’ (১৯৮৭) আইনে বলা আছে, চিনি, সিমেন্ট, সার, এইসব পণ্যসামগ্রীর জন্য চটের বস্তা বাধ্যতামূলক।   
রাজ্যের শ্রমিক সংগঠন নেতৃত্বের বক্তব্য, এই বরাতে শ্রমিকরা কাজ পাবেন জুন থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত।  মাত্র ছ’মাসের কাজতারপর সেই বঞ্চনার গল্প চলতেই থাকবে। চট শিল্পে প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেভাবে চলছে। বিকল্প হতে পারে, জুট মিলগুলিতে অনেক উদ্বৃত্ত জমি আছে। এই জমিতে জুট সহায়ক শিল্প গড়ে তোলা যায়। যেমন, পাট দিয়ে তৈরি হস্ত শিল্প, কুটির শিল্প। পাটের তৈরি গালিচা, ব্যাগ, চটের তৈরি পোশাক ইত্যাদিএইসব পণ্যের দেশের বাজারে এবং বিদেশের বাজার রয়েছে বিপুল চাহিদা। প্ল্যাস্টিক দূষণ থেকে মুক্তি পেতে জুট শিল্পের চাহিদা ব্যাপক এবং দ্রুত বাড়ছে। রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের প্রস্তাব, বেশিরভাগ চটকল বেসরকারি মালিকের হাতে আছে। যদি সহায়ক শিল্প করতে হয় তাহলে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে বসে ঠিক করতে হবে। রাজ্য সরকারের কোন আপত্তি নেই। তিনি বলছেন, মালিকপক্ষের প্রতিনিধি, স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধি এবং রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের নিয়ে এই বৈঠক করা যায়। এই ব্যবস্থায় নতুন কর্মসংস্থান যেমন সৃষ্টি হবে, পাশাপাশি চট শিল্পের মালিকরাও লাভবান হবেন।                            
 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?