উদ্ভাবনী কৌশল এবং অনমনীয় ব্যক্তিত্বের অন্বেষণ



দীপেন্দু চৌধুরী
‘খাবারের জন্য কাউকে পিটিয়ে খুন করা হলে বা ব্যঙ্গচিত্রের জন্য কার্টুনিস্টের জেল হলে সংবিধানটাই ব্যর্থ হয়।’ বলেছিলেন বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বম্বে বার অ্যাসোসিয়েশনের এক অনুষ্ঠানে সংবিধানের মূল্যবোধ ব্যখ্যা করেন তিনি। এক্ষেত্রে দেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করেন তিনি। চলতি বছরের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে ২০১৪ সালের থেকেও বেশি আসন নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ জুটি বিজেপিকে মসনদে বসাতে সক্ষম হয়েছেন। ভোট চলাকালীন এবং ভোট পরবর্তী সময়ে ইভিএম কারচুপি, নির্বাচন কমিশনকে কাঠগড়ায় তোলা ইত্যাদি অভিযোগ স্বাভাবিক নিয়মেই উঠেছে। তবু বলতে দ্বিধা নেই ভারতীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক পরিসর বেড়েছে।
নেতা-নেত্রীরা ভোট চলাকালীন যে সব শব্দ এবং বাক্য ব্যবহার করেছেন সেটা ইতিপূর্বে এই মাত্রায় দেখা যায়নিকখনও কখনও চর্চিত ভারতীয় গণতান্ত্রিক সৌজন্য এবং শালীনতা ছাপিয়ে গেছে। তারপরেও সপ্তদশ লোকসভা ভোটের উৎসব শেষ হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সরকার গঠন হয়েছে। ভোটের ফলাফলের পরে দেখা যাচ্ছে কংগ্রেসের নেতৃত্বে আঞ্চলিক দলগুলি মুখ থুবড়ে পড়েছে। কংগ্রেস দলগতভাবে  ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন (২০১৪)-এর থেকে মাত্র আটটা আসন বেশি পেয়েছে। গত নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছিল ৪৫টা আসন, সপ্তদশ নির্বাচনে কংগ্রেসের ঝুলিতে এসেছে ৫৪টি আসন। এবারের ফলাফলের ধাক্কায় কংগ্রেস শিবির প্রথমটায় মুষড়ে পড়েছিল। খুব স্বাভাবিক কিন্তু রাহুল গাঁধির ব্যক্তিত্ব এবং সনিয়া গাঁধির অকুতোভয় শারীরিক ভাষা কংগ্রেস নামক শতাব্দী প্রাচীন দলটিকে চাঙ্গা হতে সাহায্য করছে।
প্রধানমন্ত্রী তথা বিজেপি দলের অন্যতম সারথী নরেন্দ্র মোদী সিংহ গর্জনে লাগাতর গাঁধি-নেহরু পরিবারকে আক্রমণ করে গেছেন। মোদীজীর অন্যতম ভাবশিষ্য অমিত শাহও একইভাবে আক্রমণ করে গেছেন কারণ তাঁরা দু’জনেই জানেন, কংগ্রেসের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু এই পরিবার। এই আলোচনায় জনান্তিকে মনে করে নিতে পারি কংগ্রেস দুর্বল হলে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি দুর্বল হয়। কংগ্রেস দুর্বল হলে ‘বাম-গণতান্ত্রিক’ শক্তি দুর্বল হয়। তাই বিষয়টা আত্মস্থ করে বিজেপির দু’ই শীর্ষনেতা ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ শানিয়ে গেছেন গাঁধি-নেহরু পরিবারের সদস্যদের একটি উদাহারণ দেওয়া যাক, তিন বছর আগে আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটির করা সমীক্ষার শিরোনাম ছিল ‘ডু পার্টিজ ম্যাটার ফর এথনিক ভায়োলেন্স? এভিডেন্স ফর ইন্ডিয়া’, ২০১৬। এই সমীক্ষার তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে আমাদের দেশের অর্থাৎ ভারতের কোনও একটি রাজ্যের কোনও একটি অঞ্চল থেকে কংগ্রেস বিধায়ক থাকার অর্থ ওই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধার সম্ভাবনা কমে যায় ৩২ শতাংশ।   
গাঁধি-নেহরু পরিবারের কেন্দ্রকে দুর্বল করে দিতে পারলে কংগ্রেস দুর্বল হবে। সেই পরিকল্পনা পরপর দু’দুটো নির্বাচনে কাজে এসে গেল। পাঁচ বছরের ব্যবধানে দু’টো ভারতীয় কাপ বিজেপির ক্যপ্টেন মোদী এবং সহকারী স্ট্রাইকার জিতে নিল। এই দু’জনের আক্রমণকে আটকাতে সমানে লড়াই করে গেছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধি। কিন্তু তবু দুর্গ রক্ষা করা যায়নি। সম্প্রতি নির্বাচিত সাংসদদের নিয়ে বৈঠকে রাহুল গাঁধি সংসদীয় দলের প্রধান না হয়েও হুঙ্কার দিয়েছেন, ‘লড়াই হবে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে। আগে ৪৫ সাংসদ নিয়ে ভাবতাম, বিজেপির ২৮২ জন সাংসদের মুখোমুখি কী করে হব? কয়েক সপ্তাহে দেখলাম, ৪৫ই যথেষ্ট। এ বারে ৫২ জন মিলে সিংহের সাহস দেখাব।’ কংগ্রেস কর্মীসমর্থকদের চাঙ্গা করতে রাহুলের এই স্পিরিটের প্রয়োজন ছিল।
দ্বিতীয় ইনিংসের দায়িত্ব নিয়েই নরেন্দ্র মোদীর সরকার গত ৪৫ বছরের রেকর্ড বেকারত্বের সমীক্ষা রিপোর্ট মেনে নিল। নোট বাতিলের পরে দেশে বেকারির হার হয়েছে ৬.১ শতাংশ যা ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। লোকসভা ভোটের পরে পরেই এই বিষয়টা মেনে নিল সদ্য গঠিত বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ সরকার। নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেওয়ার পরেই ৩১ মে ন্যাশন্যাল স্যাম্পল সার্ভে অফিস এর করা সমীক্ষা প্রকাশ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রক। রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরে ভারতে বেকারত্বের হার গত ৪৫ বছরের মধ্যে সব থেকে বেশি। গ্রামের থেকে শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার অনেক অনেক বেশি। গ্রামে বেকারত্বের হার ৫.৩ শতাংশ, সেখানে শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার ৭.৮ শতাংশ।
আমরা এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করছি কেন? ভারত সরকারের পরিসংখ্যান মন্ত্রক হঠাত করে এই রিপোর্ট প্রকাশ করে দিল বিষয়টা এত সহজ নয়। দেশের অভ্যন্তরে যেমন একটা চাপ ছিল, চাপ আসছিল আন্তর্জাতিক স্তরেও। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ১০৮ জন অর্থনীতিবিদ লোকসভা নির্বাচনের আগে ভারতে পরিসংখ্যান বিষয়ে সরব হয়েছিলেন। খোলা চিঠি লিখে প্রতিবাদ করেছেন তাঁরা। তাদের অভিযোগ ছিল ভারতে রাজনৈতিক কারণে পরিসংখ্যানের অপব্যবহার করা হচ্ছে। উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের দাবিদার একটি সরকার দেশের মানুষের সঙ্গে আর প্রতারণার সুযোগ নিতে চাইল না সম্ভবত।
গত ১৫ বছরে কংগ্রেস দুর্বল থেকে দুর্বল হয়েছে। তার মানে এটা নয় ভারতে ১৩৩ বছরের পুরনো শতাব্দী প্রাচীন দলটির প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। ভারতে কংগ্রেসের সাংসদ সংখ্যা কমিয়ে বিজেপি যেমন নিজেদের দলের সাংসদ সংখ্যা বাড়াতে পেরেছে, ভবিষ্যতে কংগ্রেস দল হিসেবে ঘুরে দাঁড়াবে। এটাই যে কোনও যুক্তরাষ্ট্রের অলিখিত নিয়ম। কংগ্রেসের দুর্বলতা প্রসঙ্গে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দিল্লিতে দলের যুব সম্মেলনে রাহুল গাঁধি বলেন, ২০১৪ সালে মানুষ কংগ্রেসকে শিক্ষা দিয়ে বলেছিল, কংগ্রেসের নেতাদের ঔদ্ধত্য এসেছে। বিনম্র হওয়া প্রয়োজন। জনতার সঙ্গে আরও জুড়তে হবে। রাহুল গাঁধির বলা এই বক্তব্য থেকেই বলা যায় দলের আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন আছে। কারণ বিজেপি ভোটে জিতলেও দেশের যুব সম্প্রদায় চাকরি খুঁজছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অস্বীকার করতে পারবেন না। তিনি পালিয়ে যেতে পারবেন না। আবেগের প্লাবন কিছুদিন থাকবে কিন্তু তারপর? ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকা ক্ষোভ আগুন হয়ে দাউ দাউ করে একদিন ছারখার করে দিতে চাইবে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লি স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, রোজগারের সুযোগ হ্রাস, কৃষি সঙ্কট, বিভাজন শক্তি দেশে কাজ করছে। তাঁর কথায় ‘এত দিন মূল সমস্যা ছিল বৃদ্ধি সত্বেও কাজের সুযোগ তৈরি না হওয়া। এখন তা আরও বড় হয়ে ব্যাপক কাজ হারানোর সমস্যায় পরিণত হয়েছে।’
দেশ বিদেশের অর্থনীতিবিদদের মতে ভারতে উদার অর্থনীতির যুগেও চাকরির সুযোগ গড়ে ওঠেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতাই এর অন্যতম কারণ। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ছাড়া কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয় না। উৎকর্ষ অনুসন্ধান এবং উন্নয়নের দায়িত্ব কেন্দ্র এবং রাজ্য পালন করতে না পারলে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্প বা স্লোগান ব্যর্থ হতে বাধ্য। বেসরকারি উদ্যোগেও ভাঁটা আসে। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধির নেতৃত্বে কংগ্রেসে যুব নেতৃত্ব যে সব বিষয়কে কেন্দ্র করে লাগাতর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, সে গুলি হল, ১) উৎপাদন খরচের দেড়গুণ ন্যুনতম সহায়ক মূল্যে কৃষকদের উৎপাদিত ফসল বিক্রির অধিকার অর্জনের জন্য আন্দোলন। ২) শ্রমিকদের বিধিবদ্ধ ন্যুনতম মজুরি প্রতিমাসে ১৮ হাজার টাকা করার দাবিতে লাগাতর আন্দোলন। ৩) বিনামূল্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা চালুর দাবিতে ধারবাহিক আন্দোলন কর্মসূচী। ৪) কেন্দ্রীয় সরকারকে স্বাস্থ্যখাতে রাষ্ট্রীয় ব্যায়বৃদ্ধি করে জিডিপির ৫ শতাংশ করতে চাপ তৈরি করা৫) সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ ইত্যাদি, এইসব বিষয় ছাড়াও কংগ্রেসের ঘোষিত নির্বাচনী কর্মসূচী রূপায়নে সংসদের বাইরে এবং ভেতরে তীব্র আন্দোলন কংগ্রেসকে ভারতের ধূসর আকাশে নীলাভ সামিয়ানা এনে দেবে।  
বামপন্থী দলগুলিও সমমনভাবাসম্পন্ন আঞ্চলিক দলগুলিকে সঙ্গে নিয়ে, এই আন্দোলনে সামিল হতে পারে। যে কথা বামেদের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে। কংগ্রেস ঐতিহাসিক ভাবেই বর্তমান সময়ে উদ্ভাবনী কৌশল এবং অনমনীয় ব্যক্তিত্বের অন্বেষণ করছে। দলে একজন নয় হাজারে হাজারে এই ধরণের সংগঠকের প্রয়োজন। দলকে মজবুত করতে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক উপরিকাঠামো। পুরনো বুদ্ধিজীবীদের মঞ্চকে জাগিয়ে তোলা প্রয়োজন। প্রয়োজন ‘সেবাদল’ অথবা ওই সংগঠনের আদলে নতুন মঞ্চ। তবেই বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সম্ভব।                       

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?