ভারতীয় গণতন্ত্রে দলছুট নাগরিক




দীপেন্দু চৌধুরী
আমি আর কোনোদিন তাদের পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছতে পারব না,
চারিদিকে নেমে আসছে ছায়া।
                                                   মণীন্দ্র গুপ্ত
ভারতের সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন চাপানউতোরের মধ্যে নতুন তরজা বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নতুন আক্রমণ। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধিকে নতুন ভাষায় আক্রমণ। তার উত্তর দিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধি এবং কংগ্রেস দলের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গাঁধি বঢরা এবং কংগ্রেসের অন্যান্য শীর্ষ নেতৃত্ব ভারতের বৃহত্তর গণতন্ত্রে ‘কু-কথা’ বলার রেওয়াজটা সম্ভবত শুরু হয়েছে ‘সেন্স অব হিউমার’-এর চর্চা কমে যাওয়া এবং চন্ডিমণ্ডপ নামক এক আড্ডা থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর থেকেসম্ভবত এই কারণে সরাসরি ব্যক্তিগত আক্রমণে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। গ্রামগঞ্জের চন্ডিমণ্ডপে বসে দাবা খেলা, তাস খেলা এবং ক্যারাম বোর্ডের খেলা প্রায় নেই বললেই চলে। ভারতের বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষ গতিশীল দুনিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে প্রত্যুৎপন্ন কৌতুক চর্চা প্রায় ভুলে যেতে বসেছে। শহর কেন্দ্রিক নাগরিক সভ্যাতায় মানুষ আজ ঘরমুখি। ব্যবসায় মন্দা, বাজারে চাকরি নেইবিনোদন করার অর্থ নেই। রকের আড্ডা নেই। নিবিড় এবং রোমান্টিক প্রেমের গল্প, উপন্যাস নেই। ঘরে বসে হয় টিভি না হয় স্মার্টফোন, আই প্যাড, ‘আমার পি সি’, সামাজিক মাধ্যম, মিম এবং স্বাধীনভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ অথবা গোষ্ঠীগত আক্রমণের ইতর জাতীয় সংলাপ।
গ্রাম, গঞ্জ, শহর সব মিলে মিশে একাকার। শহরে বাণিজ্যিক থিয়েটার নেইগ্রুপ থিয়েটারে নতুন নাটক নেই। মিস শেফালি নেই। ঊষা উথথুপ নেই, বিবর নেই, রাতভোর বৃষ্টি নেই, প্রজাপতি নেই, স্টার থিয়েটার নেই। রাতভোর বাংলা বেসিক গানের জলসা নেই। আনন্দ থমকে গেছে নতুন সভ্যতার ‘অ্যাকোরিয়াম’-এর কাঁচের বাক্সে। নতুন শব্দের হাতছানির মেদুরতা নেই। গ্রামে যাত্রার আসর নেই। লৌকিক আচার অনুষ্ঠানে ভারতের ভিন প্রদেশের প্রভাব। কেমনতর এক তাৎক্ষণিক উত্তরণ চাইছি আমরা। জীবনের গভীরতা থেকে দূরে থাকতে চাইছি। মিথ্যে এক ঝা চকচকে গতিশিল জীবনে ‘ওলা-উবের’ সংস্কৃতির আত্মসমর্পণে বাধ্য হচ্ছি তথাকথিত নাগরিক জীবনে।     
উত্তর সমাজতন্ত্র বলি অথবা উত্তর মার্কসবাদ। শুধুমাত্র ভারতে নয় সারা বিশ্বে এক নতুন উত্তরণের খোঁজ চলছে। উত্তর বিশ্বায়ন সভ্যতা, উত্তর উদারনীতির হাত ধরে জাতপাতের রাজনীতি আমাদের আবার একবার সভ্যতার সংঘাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে না তো? উত্তর মণ্ডল কমিশন এবং উত্তর সাচার কমিটির ভারতে? যেটা ভোটের বাজারে খাওয়ানো যাচ্ছে। আমজনতা খাচ্ছেও ভালো। সমাজতত্ববিদরা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ভারতে যতই জাতপাতের অবস্থান নিয়ে আমরা আলোচনা করি, সেসব কিছুটা সীমাবদ্ধ এবং জেলা ভিত্তিক। সমাজতত্ববিদরা দাবি করছেন, ‘কোনও লোকসভা কেন্দ্রেই কোনও জাত নিরঙ্কুশভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়’ সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের জনসভায় বিজেপির অন্যতম কুশলী এবং বাকচতুর নেতা নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘’দেশের মানুষ জানতই না, আমার জাত কী। আমি মায়াবতিজি, অখিলেশজি এবং কংগ্রেসের লোকদের ধন্যবাদ দিতে চাই আমার জাত নিয়ে আলোচনা করার জন্য। আমি সব থেকে পিছিয়ে পড়া জাতির মানুষ। কিন্তু হাত জোড় করে বলছি, আমাকে এই জাতপাতের রাজনীতিতে টানবেন না। দেশের ১৩০ কোটি মানুষ আমার পরিবার।‘’ এর জবাবে প্রিয়ঙ্কা গাঁধি বঢরা বলেন, ‘’আমি তো এখনও জানি না, নরেন্দ্র মোদী কোন জাতের মানুষ। আর বিরোধী বা কংগ্রেসের কেউই তো ওঁর জাতের প্রসঙ্গ তোলেনি।‘’ ভারতের সমাজতত্ববিদদের অনুমান এই দু’জনের সংলাপ থেকে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়।  
 ভারতে নির্বাচন-ভিত্তিক চালু ব্যবস্থাটা নিয়ে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, সংসদীয় গণতন্ত্রে এর থেকে ভালো ব্যবস্থার নাকি আর কোনও বিকল্প নেই। সত্যিইতো প্রতি পাঁচ বছরের ব্যবধানে ভারতীয় জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। প্রতিনিধি ঠিকঠাক কাজ না করলে পাঁচ বছর পরে সেই বিদায়ী সংসদীয় প্রতিনিধিকে পাল্টে দেবার ক্ষমতা মানুষের হাতে ভারতীয় সংবিধান দিয়েছে। তবে এটাও বলতে হবে, নির্বাচন যদি ‘ভয়মুক্ত’ এবং ‘নিরপেক্ষ’ পরিবেশে হয়। ভারতের নির্বাচন দেখার দায়িত্ব আছে নির্বাচন কমিশন নামক এক স্বশাসিত সংস্থারএই সংস্থা আপাত-নিরপেক্ষ হিসেবে কাজ করে। ভারতের বৃহত্তর গণতন্ত্রের এই ব্যবস্থা সম্পর্কে শুধুমাত্র বৃহৎ পুঁজির রাজনৈতিক দলগুলিই নয়, সংসদীয় বামপন্থীরাও এই নির্বাচনে উৎসাহের সঙ্গে অংশ নিয়ে থাকেন।
ভারতের নির্বাচন কমিশন যতই আধুনিক হচ্ছে, ততই ভারতীয় নাগরিক কি পরাধীন হচ্ছে? আগে ব্যালট পেপারে ভোট হত। সেক্ষেত্রে ভোটার তালিকা ধরে রাজনৈতিক দলের নেতা এবং বুথ কর্মীরা বলে দিতে পারতেন, কোন পাড়ার কোন পরিবারের কোন সদস্য কোন দলের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। ভোটের পরে শাসক দলের কর্মীদের কোপে পড়তে হত বিরোধী দলের সাধারণ রাজনৈতিক দলের কর্মীদের।  ইভিএম এসে যওয়ার পরে এই সম্ভবনা কিছুটা কমেছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে। কিন্তু আজ (৬ মে) বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রাক্তন আইএএস অফিসার তথা রাজ্যের প্রাক্তন নির্বাচনী আধিকারিক (১৯৯৮-৯৯) জহর সরকার একটি প্রতিবেদন লিখে প্রশ্ন তুলেছেন এই গোপনীয়তা প্রসঙ্গে। তিনি লিখছেন, ‘’যদিও ব্যক্তিগত স্তরে কে কাকে ভোট দিয়েছেন সেটা জানা এখনও বেশ কঠিন, কিন্তু কোনও একটি বিশেষ রাস্তা বা এলাকা, যা কোনও একটি বিশেষ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের অধীন, তার ভোটদানের ধাঁচাটা ভাল মতোই অনুমান করা যেতে পারে। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দুর্বল শ্রেণি এবং সংখ্যালঘু যাঁরা, তাঁদের ‘কৃতকর্মের ফলভোগের’ আওতায় পরে যেতে পারেন।‘’ জহরবাবু একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। তার কথায় নির্বাচন কমিশন প্রতিটি ইভিএম মেশিনের প্রাপ্ত ভোট এলাকা ভিত্তিক একটি ‘টোটালাইজার’ নামক নতুন মেশিন ব্যবহার করে মিশিয়ে ফেলতে পারে। এই ‘টোটালাইজার’ যন্ত্র চোদ্দটি  পোলিং বুথের যন্ত্রে দেওয়া ভোটগুলিকে যোগ করতে এবং মিশিয়ে ফেলতে সম্ভব। এই মিশ্রণের ফলে কোন ভোটার কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে সেটা জানা খুব একটা সহজ হবে না। ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে নির্বাচন কমিশন আইন মন্ত্রককে একটি চিঠি লেখে। চিঠিতে ‘টোটালাইজার’ ব্যবহার এবং সেই সংক্রান্ত আইনি সংশোধনের কথা ছিল। ২০১৪ সালেও নির্বাচন কমিশন নিরপক্ষ মঞ্চ হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রককে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন দুঁদে আমলা জহরবাবু তাঁর প্রতিবেদনে বিষয়টা উল্লেখ করেছেন এই আলোচনা থেকেই বলতে হয় যারা ভাবছেন ‘নোটা’ বোতামে ভোট দেবেন। সেটা ভারতের যে কোনও দলের অপছন্দের প্রার্থীর কারণে হোক। অথবা দীর্ঘকালীন পারিবারিক বঞ্চনা অথবা ব্যাক্তিগতভাবে বঞ্চিত হওয়ার জন্য। আর্থিকভাবে দুর্বল এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন পরিবারের সদস্যারা ‘সাধু সাবধান’ থাকুন। ভিভিপ্যাট যন্ত্র থাকা মানে আপনি জানতে পারছেন আপনার ভোট ‘নোটায়’ পড়ল! কিন্তু.........? তারপর? আপনি বা আমি ভারতীয় গণতন্ত্রে দলছুট নাগরিক হয়েই থেকে যেতে পারি। ‘এক মুখ দাড়ি গোফ/ অনেক কালের কালো ছোপ ছোপ............’। গানটার পরের কথাগুলি আপনাদের ভেবে নিতে খুব কিছু অসুবিধে হবে?                                 

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?