গণতন্ত্রে থাকুন, দুধ খাইবার বাটি দিব



দীপেন্দু চৌধুরী
ভোটচতুর্থী শেষ হয়ে ভোটপঞ্চমী এগিয়ে আসছিল। ভারতীয় গণতন্ত্রের সব চেয়ে বড় উৎসবের সময়কাল। সপ্তদশ লোকসভা উৎসব। চুপ করে বসে থাকা কি সম্ভব? দুয়াত কলমের সময়কাল সেই কবে চলে গেছে। ইতিহাসে স্থান হয়েছে। অথবা বলা ভালো ভারতীয় মিউজিয়ামে স্থান হয়েছে। আরও বলা যায় কলকাতা ভিক্টোরিয়াল মেমোরিয়ালে গেলে খুঁজে পাওয়া গেলেও পাওয়া যেতে পারে। সম্প্রতি জানতে পারলাম দিলীপ কুমার রায়কে ১৯২৪ থেকে ১৯২৮ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি ১৯৮৫ সালে কলকাতার ভিক্টোরিয়াল মেমোরিয়ালকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে। সরোজ কুমার চ্যাটার্জি এই চিঠির সম্ভার ভিক্টোরিয়া কতৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছেন। এইসব চিঠির প্রদর্শনী (৮ মে থেকে ৯ জুন)-র ব্যবস্থা করা হয়েছে কলকাতার সেরা সৌধ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের ‘প্রিন্স সভাগৃহে’। তিনি ভগবান নন। তিনিও মানুষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা বলছি। তিনি যে সময় চিঠিগুলি লিখেছিলেন দোয়াত, কালি কলম ব্যবহার করে চিঠিগুলি কি লিখেছিলেন? কিন্তু তাঁর চিঠিতে তৎকালীন সমসাময়িক সময়ের সামাজিক টানাপড়েন, রাজনৈতিক ঘনঘটা, সঙ্গীত, সংস্কৃতির পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি নিশ্চয় এসেছে।
আমার হাতের কাছে রবীন্দ্রনাথের এক বন্ধুকে লেখা একটি চিঠি রয়েছে। উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারলাম না। কবির নর্মাল স্কুলের সহপাঠী অক্ষয়কুমার মিত্রকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর ১৬ই মাঘ, রবিবার রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘’......তোমার পত্র পাইলেই সেই ইস্কুলের ছেলেবেলাকার বন্ধুদের মনে পড়ে। যদিও নর্মাল স্কুলের সম্মুখ দিয়া যাইবার সময় অসচ্চরিত্র বালকদের কথা মনে করিয়া এখনও সঙ্কুচিত হইয়া পড়ি তথাপি যখন তোমাদের মনে করি তখনই মনে করি সেই দিন আসুক, সেই আড়ি ভাব আর একদিন করি, সেই উঠানামা আর একদিন করি।
তুমি আমার এখনকার বয়োবৃদ্ধির গাম্ভীর্য দেখিলে হয়ত হাস্য করিবে, একসময়ে তোমাদের কাছে এত ছেলেমানুষী করিয়াছি যে তোমাদের কাছে গম্ভীর হওয়া বাস্তবিক হাস্যজনক। তোমার পত্রপাঠে বোধ হইল যে এখনো যে তোমার সহিত বন্ধুত্ব রহিয়াছে, ইহাতে তুমি কিছু আশ্চর্য হইয়াছকিন্তু আশ্চর্য হইবার কারণ কিছুই নাই, আমরণকাল তোমার নিকট আমার ও আমার নিকট তোমার ভালবাসা প্রাপ্য রহিবে। ইহার অন্যথা হওয়াই আশ্চর্যের কারণ। একদিন যদি আমার কাছে আইস তবে দেখিবে, অন্যের রবি যতই গম্ভীর হউক না কেন তোমার নিকট সেই নবম বর্ষের বালক; অভিমান করিয়া এখনও আড়ি করিতে পারে, মিটমাট করিয়া পুনরায় ভাব করিতে পারে।‘’
যে আড়ি ভাবের কথা রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন। রাজনীতির উচ্চতম কক্ষ হোক অথবা নিম্নতম কক্ষ, ভারতে অথবা বিদেশে। উন্নত গণতন্ত্রে এই খেলা স্বগরিমায় চলছে। তর্কবিতর্ক, উন্নয়ন, বিকাশ ইত্যাদি। আমি সেই বিষয়কে বেছে নিয়েছিলাম। সীমাবদ্ধতা আছে। মুদ্রণমাধ্যমে আমার রাজনৈতিক লেখা ২৩ মে পর্যন্ত ‘আড়ি-ভাব’-এর পর্যায়ভুক্ত হয়েছে। আমার রাজনীতি বিষয়ক লেখায় ‘জরুরী অবস্থা’ জারি হয়েছে। ইহা বড়দের, তাই ‘আড়ি-ভাব’ বলা যায়। আমাদের দেশের সপ্তদশ সাধারণ নির্বাচন নিয়ে যখন লিখব ভাবছি। রাজনীতি আসবেই। আমার আবার সমস্যাও আছে। রাজনীতি নিয়ে কিছু লিখতে গেলে ‘হুতোম’-এর পরামর্শ প্রকাশ্যে অথবা গোপনে আমাকে নিতে হয়। গত এক সপ্তাহ গোপনে পরামর্শ নিচ্ছিলাম হঠাত সাপের ফনার মতো ‘ফণী’ এসে হাজির। জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার-এর হিসেব অনুযায়ী গত কুড়ি বছরে এই অঞ্চলের সব থেকে ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক ঝড়ে পরিণত হয়েছে ফণী। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর ১৯৯৯ সালে হওয়া ওই সামুদ্রিক ঝড়ে (সুপার সাইক্লোন) ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিপুল। ‘ফণী’-এর দাপট অনুমান করতে আজ সকালে ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সামনের দেওয়ালে হুতোম এসে বসল। থম থমে মুখ। মুখে এক টুকরো কাগজ। কাগজটা আমার সামনে ফেলে দিয়ে বলল, এটা দেখে লেখার নাম করণ কর। তোদের এখন ভোটের উৎসব। আমাদের সর্বনাশের মহাকাল। আমরা স্থায়ী উদ্বাস্তু। গাছ-পুরনো বাড়িতে থাকি। ফেণী না ফণা কি একটা আসছে। আবার উদ্বাস্তু হতে হবে হয়ত। এই কথা বলে হুতোম পাখা মেলে উড়ে চলে গেল। ‘আড়ি-ভাব’-এর সেই পুরনো মেজাজ আজ হুতোমের ছিল না। আমি কাগজের টুকরোটা খুলে দেখলাম দাদা ঠাকুর মানে শরৎ পণ্ডিতের দোয়াত, কালি-কলমে মিথ হয়ে যাওয়া লেখা ‘মাছ কাটলে মুড়ো দিব/ ধান ভানলে কুঁড়ো দিব/ কালোগরুর দুধ দিব/ দুধ খাইবার বাটি দিব।‘’
আসুন আমরা প্রস্তুত হই। অন্যদের প্রস্তুত হতে বলি। রবীন্দ্রনাথের নর্মাল স্কুলের নবম শ্রেণীর বন্ধু অক্ষয় কুমার দত্তকে লেখা চিঠির ধরতাই ধরে বন্ধু খুঁজি। ‘আড়ি-ভাব’-এর বন্ধু। ফণী যে আঘাত হেনে যাবে তারপর শুরু হবে মৃত্যু, ক্ষয়ক্ষতির হিসেব কষা। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে অর্থ বরাদ্দ হবে। বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের আর্থিক এবং পরিকাঠামো বাবদ অর্থ আগেই অনুমোদন হয়ে গেছে। কেন্দ্র এবং রাজ্য স্তরে। দু’তিনটে রাজ্যে। আমাদের রাজ্যেও। এই বরাদ্দ অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু ভোটপঞ্চমীর আগে ‘গণতন্ত্রে থাকুন দুধ খাইবার বাটি দিব’ বলতে বলতে নানান রঙের ঝান্ডা হাতে তারা ঝুটে আসবে। করুণার পাত্র হাতে ত্রাতা হয়ে ওঠার আপ্যায়নের তৎপরতায় সমকালীন অসম প্রতিযোগিতা শুরু হবে। তারপর ভাগের অঙ্ক। ভোটের অঙ্ক। গাছ পড়বে, বাড়ি ভাঙ্গবে। বন্যায় নদীর পাড় ভাঙবে। ভাঙবি নদী ভাঙ। বছর বছর বন্যা হবে টাকা আসবে দেখবে ভগবান। মানুষ হেথা থেকে হোথা যাবে। স্থানান্তরে যেতে বাধ্য হবে। উদাস নয়নে হ্রদয় ভাঙ্গা হা হুতাশ করতে করতে ‘বাবু’ খুজবে তাঁরা। একবিংশ শতাব্দীর ‘অসচ্চরিত্র বালক’-দের খোঁজ করতে হয়না। তাঁরা পঞ্চায়েত, গ্রামসভায় ঘাপটি মেরে বসে থাকেদুর্যোগ আসলে প্রকৃত সামাজিক বন্ধু খুঁজে নেওয়া যায়। তাঁদের সঙ্গে ‘আড়ি-ভাব’ খেলতে পারলে মনের আনন্দ হয়। কিন্তু ‘আয়লা’-এর কথা আমাদের মনে আছে। মাত্র ১০ বছর আগের ঘটনা। এই বিদ্ধংসী ঝড়ের পরে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিলপ্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধির ভাষায় একটাকা দিলে সাধারণ মানুষ ১৫ পয়সা পাবে। ভোটসপ্তমী কাটলেই ‘নবপ্রভাতের আসল বুঁদির গড়’ গড়ে উঠবে। টাকা মাটি মাটি টাকার নামে হুতোমের দল এক আস্তানা থেকে আর এক আস্তানায় ঘুরবে। আত্মীয়হারা হলুদ পাখির দল বনে বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে ‘আত্মীয়’ খুঁজবে। এ আস্তানা থেকে সে আস্তানায়। মাছের মুড়ো কেউ দেবে না বন্ধু! আড়ি-ভাব খেলব কার সঙ্গে?                      

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?