ঘুম ভাঙ্গা ভোরের প্রহর গুনছি


দীপেন্দু চৌধুরী
সপ্তদশ লোকসভা ভোটের পরে ফলাফল এবং নিজেদের সাংগঠনিক ব্যর্থতা বিশ্লেষণ করতে ২৬ মে এবং ২৭ মে সিপিএমের পলিটব্যুরোর বৈঠক বসেছিল। পলিটব্যুরো সূত্রে জানা যাচ্ছে, জাতীয় স্তরে সিপিএম-সিপিআইয়ের ভোটের ভাগ ছিল ৭ শতাংশ। ২০১৪ সালে সেটা নেমে এসেছিল ৪ শতাংশে। এ বার তা নেমে এসে দাঁড়িয়েছে ২.৩ শতাংশে। সংসদে বামফ্রন্টের সদস্য মাত্র ৫ জন। এই পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, জাতীয়স্তরে বামেদের মতো অন্যান্য বিরোধী দলগুলি এতটা ধাক্কা খায়নি। পলিটব্যুরোর বৈঠকের পরে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি দলের ব্যর্থতার সমস্ত দায় নিয়ে বলেন, ‘’কোনও জোটেই কাজ হত না। কারণ ২০০-র বেশি আসনে বিজেপি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে।‘’
সিপিএম নামক দলটির ধারাবাহিকভাবে এই রক্তক্ষরণের কারণ কি? দেশের বামপন্থী তাত্বিক নেতা, লেখক, সমাজবিঞ্জানী, ইতিহাসবিদ, অর্থনীতিবিদেরা আছেন। তাঁরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সময়োপযোগী ব্যখ্যা বিশ্লেষণ করছেন। বামপন্থায় আস্থা রাখতে বলছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে গ্রামবাংলায় বামপন্থীদের সংগঠনের ভিত্তি ভেঙে পড়ার কথাও কেউ কেউ আলোচনা করছেন। ভারতের কৃষি সমস্যা নিয়ে ঐতিহাসিক পদযাত্রা এবং ধারাবাহিক আন্দোলনের পরেও বামপন্থীদের এই ব্যর্থতার কারণ কি? আমরা বিভিন্ন লেখাপত্রে পড়ছি ‘ভারত’ (গ্রাম ভারত) আর ‘ইন্ডিয়া’ (শহর কেন্দ্রিক আধুনিক ভারত) দু’টো স্বতন্ত্র কাঠামো আমাদের উন্নয়নশীল এই রাষ্ট্রে। ২০১১ সালের এসইসিসি (SECC) সমীক্ষা অনুযায়ী ‘গ্রাম ভারত’-এ ৭৩.৪৪ শতাংশ পরিবার বাস করেন। শহর কেন্দ্রিক আধুনিক ভারত তথা ‘ইন্ডিয়া’-তে বসবাস করেন বাকী ২৬.৫৬ শতাংশ পরিবার। ১৯৩৪ সালের পরে ২০১১ সালের আর্থ-সামাজিক গণনা থেকে যে পরিসংখ্যান উঠে আসছে গ্রাম-ভারতের ৮৮.৪ কোটি জনসংখ্যার ৩৫.৭৩ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরতে পেরেছে মাত্র ১৭.৭৮ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর সংখ্যা মোট গ্রামীণ জনসংখ্যার সঙ্গে তুলনায় মাত্র ৩.৪৫ শতাংশ।
এই পরিসংখ্যান উল্লেখ করে প্রশ্ন কি তোলা যায় না যে সমাজের অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে ভারতের সিপিএম নামক একটি প্রথমসারির দল গ্রামীণ ভারতের মানুষের দায়িত্ব কতটা নিচ্ছে? অথবা নিতে পারছে না কেন? বারে বারে মুখ থুবড়ে কেন পড়ছে? হয়ত কেউ কেউ প্রশ্ন তুলবেন বাংলায় বামপন্থীরা আজ আক্রান্ত। এই বাংলা থেকেই ভারতে একদিন বামপন্থী আন্দোলনের প্রথমসারির নেতৃত্ব উঠে এসেছিল। বাংলার মাটি বাংলার দুর্জয় ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০১১ সালে বামফ্রন্টের ৩৪ বছর শাসনের অবসনের পরে কেটে গেছে আটটা বছর। তৃণমূল কংগ্রেসের শাসন ব্যবস্থায়, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শুন্যতা বা পরিসর তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা থেকে যেটা তৈরি হয়ে থাকে। পরিসর তৈরি না হলে বিজেপি রাজ্য রাজনীতিতে দ্বিতীয় সারিতে উঠে আসতে পারে কি করে? ৩৪ বছরের অভিজাত তথা আরামদায়ক, ঝুঁকিহীন বামপন্থী আবেদনের সঙ্গে ২০১১ পরবর্তী বাংলার বামপন্থী আন্দোলন, এযাবৎ অত্যন্ত আটপৌরে প্রতিবাদী রাজনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল। যেন গয়ংগচ্ছ ভাব।  
ভারতের মার্ক্সবাদী পণ্ডিত এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, নীতিগতভাবে সারা দেশের কোনও রাজ্যে সরকার থাকুক বা না থাকুক, ভারতের মতো দেশে বামপন্থী সাংসদ বাড়ল না কমল সেটাই একমাত্র বিচার্য বিষয় হতে পারে না। বামপন্থীদের কর্তব্যের মধ্যে রয়েছে যে, সমাজের মৌলিক শ্রেণিগুলি যেমন শ্রমিক-কৃষক, বেকার যুবক,  নিম্নবিত্ত, নিম্নবর্ণ, গরিব ব্রাহ্মণ (বর্তমান সময়ে), গরিব ক্ষত্রীয়, জনজাতি ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর স্বার্থে ভারতীয় বামপন্থীদের কর্মসূচী নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ বর্তমান ভারতে রবীন্দ্রনাথ-গাঁধিজীর মতো প্রথমসারির সমাজকর্মী নেই। বামপন্থীদের ঝুলিতেও ‘নবরত্ন’-এর বড্ড বেশি অভাব দেখা দিয়েছে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে। ২৭ এপ্রিল কলকাতা প্রেসক্লাবে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র যথার্থভাবেই বলেছিলেন, ‘’বিজেপি এবং তার সহযোগীদের ভোট আটকাতে আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের জন্য আমাদের নির্বাচনী রণকৌশল ঘোষণা করেছি।‘’ উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর চন্দন আশিস লাহা একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকের ২১ মে, ২০১৯-এর সম্পাদক সমীপেষু কলামে লিখছেন, ‘’মহাপুরুষরা চিরকালই ছিলেন- ১৯৯৯ সালে ফরাসি পার্লামেন্টে টিনটিনকে নিয়ে এক বিতর্কের সময় যা বলা হয়েছিল, তা এই- ‘neither right nor left, but upright’. এই ‘upright’ থাকা একটি ইউটোপিয়ান ধারণা, বিশেষত গণতন্ত্রের ভোট রাজনীতিতে।‘’
‘আমরা সংসদে না থাকি রাস্তায় থাকব’। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের জনৈক এক সিপিএম নেতা মুখের পেশী ফুলিয়ে হুঙ্কার দিয়েছেন। এটা ফাঁকা বুলি ছাড়া বর্তমান সময়ে আর কিছু নয়। কমরেড আপনারা রাস্তায় আছেন গত ৫৫ বছর। আপনারা বস্তিতে ছিলেন, উদ্বাস্তু কলোনিতে ছিলেন। ছিলেন চাবাগানের বনবস্তিতে। ভূমিহীন কৃষকের মিছিলে ছিলেন। কিন্তু গত ২০ বছর গ্রাম-শহরের অলিগলিতে আপনারা নেই। যে নব্য ঘরানার নেতা (সূর্যকান্ত মিশ্র নন) এই হুঙ্কার দিচ্ছেন বাংলার সিপিএমে তাঁর গত এক দশকে উত্থান অত্যন্ত বিতর্কিত। নিন্দুকেরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন বাংলা থেকে ২০১৮ সালে নির্বাচিত দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সেই সদস্য গত ২০-২৫ বছরে নিজের সংগঠনের শক্তিতে অথবা ক্যারিশ্মায় সাংসদ বা বিধায়ক নির্বাচিত হতে পারেননি। দলের বিভিন্ন স্থানীয় জনপ্রিয় নেতা এবং প্রশাসনের সাহায্যে তিনি ওই দুটি সংসদীয় পদে আসীন হয়েছেন। বাংলার এই নব্যনেতা যাকে ‘সাদা হাতি’ বলেও সম্বোধন করা হচ্ছে। তিনি তাঁর থেকে বয়সে বড় এবং যোগ্যতম সংগঠকদের ‘কাঁচকলা’ দেখিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছেন। অত্যন্ত সুকৌশলে। তারও আগে এই ব্যক্তিটি সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য এবং রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হয়েছিলেন একই কৌশলে।
আলোচ্য এই নব্য নেতাটি এবং সিপিএম দলের বাংলার আরও দুইজন নেতা (ব্যাঙ্কের কর্মী অফিসার আন্দোলনের বহু আলোচিত এবং বিতর্কিত নেতা তাঁরা) রাজ্যের সংবাদ মাধ্যম, সঙ্গীত, সাহিত্য, চলচ্চিত্র প্রভৃতি ক্ষেত্রে গোপন ‘কোর কমিটি’ নিয়ন্ত্রণ করেন এই সূত্রে বলা যায় তৃণমূল কংগ্রেসের ‘মা-মাটি-মানুষ’ শ্লোগান দখল হয়ে গেছে। ‘মা-মাটি-মানুষ’ নামে একটি পত্রিকার মালিকানা এই গোষ্ঠীর হস্তগত হয়েছে। সিপিএমের অন্দরের খবর উল্লেখিত তিন নেতার (নাম দিলাম না) উপর দলের অনেকেই সন্তুষ্ট নন। দলের অনেকের অভিযোগ বাংলার এই তিন সিপিএম নেতা দলের অনেক ক্ষতি করে দিচ্ছে।
কমরেড, সংবাদ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করলে কি হতে পারে তার একটা উদাহারণ আপনাদের দেওয়া যাক। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন নিজের গবেষণায় ফেলিন সংক্রান্ত আলোচনায় বলেছেন, একবার চিনের এক প্রদেশে খাদ্যশস্য মার খাওয়ায় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে লাখ লাখ মানুষ মারা যাননিকটবর্তি একটি প্রদেশে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য থাকা সত্বেও তা আনা যায়নি, তার কারণ চিন সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকার জন্য সংবাদ মাধ্যম দেশের একটি প্রদেশের দুর্ভিক্ষ ও উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যের খবর প্রকাশ করতে পারেনি।
সাম্প্রতিক ভোট বিপর্যয়, সাংগঠনিক বিপর্যয়ের কারণেই কি সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘’প্রত্যেক পাড়ায় নয়, বাড়িতে নয়, প্রত্যেক মানুষের কাছে আমাদের যেতে হবে।‘’ নাক উঁচু, পরশ্রীকাতর, অতিঞ্জানী পলায়নপর তথাকথিত সিপিএম বামনেতার দল কি শুনতে পাচ্ছেন? আমরা আজও রাত জাগা, ঘুমিয়ে পরা এবং ঘুম ভাঙ্গা নতুন এক ভোরের প্রহর গুনছি। সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নায়।                                        


Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?