নতুন রথের নতুন সারথীর খোঁজে বাংলা




দীপেন্দু চৌধুরী  
সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের পরে যে ফল আমাদের সামনে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে ভারতের আঞ্চলিক দলগুলির অস্তিত্ব বিপন্ন। এবারের নির্বাচনে বেশিরভাগ আঞ্চলিক দল মুখ থুবড়ে পরেছে। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর বহুজন সমাজবাদী পার্টি এবং অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টী নিজেদের মধ্যে জোট করেও আশানুরূপ ফল করতে পারেনি। মাত্র তিনটে রাজ্যের আঞ্চলিক দল বিজেপি ঝড়ের বাইরে আলাদা অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে। অন্ধ্রপ্রদেশে জগন্মোহন রেড্ডির ওয়াইএসআর কংগ্রেস, তেলেঙ্গনায় কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের টিআরএস পার্টি এবং ওড়িষায় নবীন পট্টনায়কের বিজেডি দল আঞ্চলিক দল হিসেবে আলাদা পরিচিতির স্বীকৃতি ধরে রাখতে পেরেছে। ওড়িষায় নবীন পট্টনায়ক পঞ্চমবারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসছেন। এটাও একটা ইতিহাস ভারতীয় গণতন্ত্রে সপ্তদশ নির্বাচনেও মোদী হাওয়া, মোদীর উন্নয়নের শ্লোগান, বালাকোটে পাল্টা আক্রমণ, মোদী সরকারের গরিবদের জন্য শৌচালয় গড়ে তোলার অভিযান। ২৬মে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে কয়েকজন সদস্য প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা বলেছেন, ‘নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ যে পর্যায়ে গিয়ে ভোট করেন কংগ্রেস তার ধারে কাছে নেই। মোদী গরিবদের জন্য শৌচালয় তৈরি করে, তাঁদের বাড়িতে রান্নার গ্যাস, বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়ে সম্মান বাড়িয়েছেন। ফলে জাতপাতের সমীকরণ মুছে এখন গরিবদের মুখেও মোদীর নাম শোনা যাচ্ছেএছাড়াও আছে জাতীয়তাবাদ এবং মেরুকরণ।’   
একটি তথ্য অবশ্য অন্য হিসেব দিচ্ছে। মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের ২০১৬-১৭ প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ৮৬, ৫৯১টি স্কুলের ছাত্রদের জন্য কোনও শৌচালয় নেই। মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের ওই রিপোর্টে আরও আছে ৩৮, ৫৯১ টি স্কুলে মেয়েদের জন্য শৌচালয় নেই। দেশের ৪৩ হাজার স্কুলে পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। এই তথ্য মোদীজীর স্বচ্ছ ভারত অভিযান প্রকল্পের ব্যর্থতার একটি উজ্জ্বল উদাহারণ।  
আমরা বলছিলাম কংগ্রেস নেতাদের কথা। তাঁরা আরও বলছে, গরিব মানুষের বাড়িতে গ্যাস, বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে মোদীর সরকার। এই সব প্রকল্পের কথা সর্বভারতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের মুখে শোনা যাচ্ছে। কংগ্রেসের টালমাটাল পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা এ কে অ্যান্টনি বলেছেন, ‘’কংগ্রেসের বিপর্যয় হয়নি। শুধু প্রত্যাশামাফিক ফল হয়নি‘’ প্রবীণ নেতা অ্যান্টনির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস নেতারা এই যুক্তি তুলে ধরতে চেয়েছেন। তাঁরা আরও বলছেন বিজেপির জাতপাতের সমীকরণ মুছে এখন মোদী নাম হচ্ছে। এই বক্তব্য থেকে বোঝাই যাচ্ছে এইসব নেতারা বিজেপির দিকে ঝুঁকে রয়েছেন। যদিও এআইসিসির নেতৃত্বে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য গত পাঁচ বছর ধরে রাহুল গাঁধি লড়াই করছেন। সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই তিনি কৃষক, শ্রমিক, বেকার যুবকদের দাবি নিয়ে রাস্তায় আছেন। সংসদে বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে চেপে ধরেছেন। কোন কোনও বিষয়ে সংসদে রাহুলের আক্রমণাত্বক বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও দুর্বল মনে হয়েছে।     রাহুলের নেতৃত্ব ক্রমশঃ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে।   
ভারতে ‘মোদী হেজেমনি’-র কথা সবাইকে মানতে হচ্ছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী সংসদে প্রবেশ করার আগে চৌকাঠে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেন। ২০১৯ সালের ২৫ মে দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার এক সপ্তাহ  আগে সংসদের সেন্ট্রাল হলে সংবিধানে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম করলেন নরেন্দ্র মোদী। ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন ঘরানার আবেদন। ভারতকে একটি ‘যুক্তরাষ্ট্র’-এর মর্যাদা কি তিনি দিতে চাইছেন? না তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক চমক? সপ্তদশ লোকসভা ভোটের পরে বিজেপি সরকারের নীতি, কর্মসূচী প্রভৃতি বিষয় কতটা সঠিক? সম্প্রতি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন একটি মার্কিন সংবাদপত্রে লেখা তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন, ‘’জ্বালাময়ী বক্তৃতায় ঘৃণা ও বিদ্বেষকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করে অন্যদের চিন্তাকে প্রভাবিত করতে পেরেছেন মোদী। অটল বিহারী বাজপেয়ীরাও তা পেরে উঠতেন না।‘’ তাঁর মতে মতে, গত পাঁচ বছরে ধর্মীয় বিভাজন প্রকট হয়েছে ভারতে। তবু গাঁধি-রবীন্দ্রনাথ-নেহরুর ঐক্য-একতার আদর্শকে মুছে ফেলতে পারেনি হিন্দু জাতীয়তাবাদ।
‘’গাঁধিজীকে ‘মানবতার শেষ প্রহরী’ মানতেন রলাঁ। ‘ভারতবর্ষের জিশু’ বলেও রলাঁ তাঁকে অভিহিত করেছেন। গাঁধিজী যে সত্যিই জিশুর মতোই নিহত হয়েছিলেন আমাদের সদ্য স্বাধীন দেশে, তা অবশ্য দেখে যাননি তিনি। তাঁর গাঁধি-জীবনী কোনও স্তাবকের রচনা নয়, এক যুক্তিবাদী চিন্তকের ইউরোপীয় অন্বেষণ। তিনি লিখেছিলেন, গাঁধিজীর ভাবনার সাফল্য বা ব্যর্থতার উপর নির্ভর করছে এক শতাব্দী বা তাঁর বেশি সময় ধরে ইউরোপের ভবিতব্য তথা পৃথিবীর ভবিতব্য।‘’ ২৫ মে কলকাতার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ-এ কথাগুলি বলেন ফরাসিবিদ, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক অধ্যাপক চিন্ময় গুহ। অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের ওই বক্তব্যের পরে পরেই মধ্যপ্রদেশে গোরক্ষকদের হাতে একজন দলিত নিগৃহীত হলেন। তবু বলতেই হবে গণতন্ত্র কারও জন্য থেমে থাকে না। ভারতে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে মুসলিম সাংসদ সংখ্যা বেড়েছে। সর্বমোট ২৭জন মুসলিম প্রার্থী জয়ী হয়েছেন ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে। এই ২৭ জন সাংসদের একজনও বিজেপির সাংসদ নন।   
এই তত্বের ওপর নির্ভর করে প্রশ্ন উঠছে আমাদের বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের এই ফল কেন? অথবা এই বিপর্যয় কেন? সিপিএমের মতো তৃণমূলের ঘোর নিন্দুকেরাও বলে থাকে গত আট বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যে উন্নয়ন হয়েছে। সেটা কলকাতা শহরের বাহ্যিক দিক দেখেই সবটা বোঝা সম্ভব নয়। গ্রামে গেলেও এটা বুঝতে পারা যায়। গ্রাম বাংলার উন্নয়নের আলো চেনা যায়। কেন্দ্রের মোদী সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করেছে। যে কথা কোর কমিটির দলীয় বৈঠকে মমতা আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘’যুবশ্রী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী করেছি। মানুষের মৃত্যুর সময় পর্যন্ত পাশে দাড়িয়েছি। তার পরেও মানুষ পছন্দ না করলে, না করবেন। বেশি কাজ করে ফেলেছি।‘’ রাজ্যে নির্বাচনী বিপর্যয় যে হতে পারে এটা তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব অনুমান করতে পারলেন না কেন? কিছু পরিসংখ্যান উল্লেখ করা যাক। বিজেপি আসন পেয়েছে ১৮টি। তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ২২টি। বিজেপি বাংলায় ভোট পেয়েছে ২.১৭ কোটি মানুষের। তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ২.৩৪ কোটি ভোট। পারসেন্টেজ হিসেবে বিজেপি পেয়েছে ৪০.২৩% ভোট। তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ৪৩.২৯% ভোট। রাজ্য বিধানসভার ১৩০টি আসনে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। ১৫০টি আসনে তৃণমূল কংগ্রেস। ১৬টি গ্রামীণ আসনে এগিয়ে বিজেপি দল। ১৮টি গ্রামীণ আসন নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছে তৃণমূল কংগ্রেস।
তৃণমূল কংগ্রেস দল ইতিমধ্যেই পর্যালোচনা বৈঠক করে ফেলেছে। সাংগঠনিক কিছু রদবদলও করেছে কিন্তু তবু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ২৩ মে ভোটের ফল ঘোষণার পরের দিন অর্থাৎ ২৪ মে ট্রেনে বাড়ি ফিরছিলাম। আমার সামনের আসনে চারজন যুবক বসেছিলেন। তাঁরা নিত্যযাত্রী। দু’জন তৃণমূল সমর্থক। তাঁদের মধ্যে একজন বলল, ‘’দিদি ২০১১ সালের আগে প্রত্যেক জনসভায় নিয়ম করে বলতেন, ‘তোমাকে মারিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে...... আর গত বছর পঞ্চায়েতের আগে দু’-তিনবার সেই কংসের বাড়িতে গেলেন দিদি? অসুস্থ কংসকে সৌজন্যের খাতিরে একবার দেখতে গেলেন। সেটা ঠিক আছে। আবার প্রকাশ্যে ছবিও তুললেন। আমরা কংসের বিরোধিতা করেই ‘বদল’ এনেছিলাম। সেই কংসের কাছে বারেবারে পরামর্শ নিতে যেতে হবে কেন? এটা একধরণের দ্বিচারিতা নয়? পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকেই গ্রামের মানুষ এটা ভালো চোখে নিতে পারেনি।‘’
তৃণমূল কংগ্রেসের আর একজন সমর্থক বলল, ‘’গ্রাম শাসন ট্যাক্স মানে ‘জিএসটি’ চালু হওয়ার পরে অনেক ছোট ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। মালিক শ্রমিক সবাই মফসঃসলে বেকার। অনেকেই বেঙ্গালুরু এবং ভিন রাজ্যে  ছুটছে চাকরির জন্য। এটাও বিপর্যয়ের একটা অন্যতম কারণ। আবার বামেদের ভোট নাকি রামে গেছে তৃণমূল থেকেই বলা হচ্ছে। অথচ সেই বামেদের কাছে পরামর্শ না নিলে দিদির হচ্ছিল না? তবে লোকসভায় যাইহোক আমি বলব, দু’হাজার একুশ/ তৃণমূলে আছি বাংলার মানুষ।‘’                      

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?