সাগর ডাকের ঢেউ মানবতার ঢেউ গুনছি




দীপেন্দু চৌধুরী
গণতন্ত্রের বিজয়া বা বিসর্জন বলে কি কিছু হয়? বা হবে কোনদিন? বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে নানান কৌশলে সমাজ, সামাজিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এবং হচ্ছে। গণতন্ত্রকে কুশলী তত্বে, প্রায়োগিক তথাকথিত এক  সাংস্কৃতিক আধারে নিমজ্জিত করে এক নতুন ভাষায় মিশ্রণ খাওয়ানোর প্রচেষ্টা হয়। যুগে যুগে এই প্রচেষ্টা গড়ে তুলতে সুযোগ নেওয়া হয় বিভাজনের। প্রাপ্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা তার অন্যতম হাতিয়ার। এক কথায় বলা যায়, গণতন্ত্রকে ধরে নেওয়া হয়েছে ‘নির্বাচন’কে হাতিয়ার করে প্রভুর মসনদে আসীন হওয়ার মাধ্যম হওয়ার। বছরের বছর এই ব্যবস্থা মজবুত এবং বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য নিত্য নতুন সমন্বয়ের ভাষা শোনা যায় পরীক্ষিত এবং সামাজিকভাবে স্বীকৃত প্রথমসারির নাগরিকদের মুখে। একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসেও আমাদের বলতে হয় দেশের প্রায় প্রতিটি আম নাগরিক হারিয়ে ফেলছে প্রকাশ্যে আলোচনা করার অধিকার। হারিয়ে ফেলছে প্রতিবাদ করার সুযোগ। আভ্যন্তরীণ এক অদৃশ্য আতঙ্ক চেপে ধরতে চাইছে পাশাপাশি বসবাস করা, প্রতিদিনের প্রাত্যহিক চেনা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনে। এই সভ্যতা কি আমরা চেয়েছিলাম? এই সভ্যতা কি আমরা চাই?
সম্প্রতি কলকাতার ব্যস্ততম উপকন্ঠ মেটিয়াবুরুজের ইমাম বাড়ায় একটি অনুষ্ঠান হয়ে গেল ‘শাম-ই-আজাদি’ শিরোনামে। নবাবের স্মৃতি বিজড়িত মেটিয়া বুরুজের সিবতানাবাদ ইমামবাড়ায় এই অনুষ্ঠানটি হয়। ভোট মরশুম চলাকালীন এই অনুষ্ঠানের যৌথভাবে আয়োজন করেছিল ‘‘আপনার প্রতিবেশীকে চিনুন’’, ‘মনজিলাত’ সংস্থা এবং বেগমের আত্মীয় মাঞ্জিলাত ফতিমা। শাম-ই-আজাদি-র অনুষ্ঠানের সংগঠকরা বেছে নিয়েছিলেন বেগম হজরত মহলের মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে এই অনুষ্ঠান। ১৪০ বছর আগে ১৮৭৯ সালের ৭ এপ্রিল এক সাহসী ভারতীয় মহিলার মৃত্যু হয় নেপালের কাঠমুন্ডুতে। যেমন বাহাদুর শাহের মৃত্যু হয়েছিল রেঙ্গুনে। আমাদের নিবন্ধের এই মহিলা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন নামে খ্যাত ১৮৫৭ সালের ‘সিপাহি বিদ্রোহ’-এর। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে তিনি ছিলেন একজন সাহসী অভিজাত মহিলা, একজন মা এবং তিনি ছিলেন রাণী। তাঁর নাম বেগম হজরত মহল। বেগম ব্রিটিশ সেনাদের আক্রমণ থেকে স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাণী হিসেবে অওধ এবং ভারতকে রক্ষা করেছিলেন। বুদ্ধিদীপ্ত এবং চতুর কৌশলে বেগম হজরত মহল হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে বিভেদকারী ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে একজোট করেন। ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে  ব্রিটিশ সেনাকে বাধ্য করেন পিছনে যেতে। সেই যুদ্ধে যে দেশীয় রাজা-রাণীরা অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাদের অন্যতম অওধের রাণী হজরত মহল। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ-এর বেগম হজরত মহল। নবাব ‘ছোটা লক্ষৌ’ সে সময় কলকাতায় নির্বাসিত। হজরত মহল ছিলেন একজন বীর নারী, স্বাধীনতা সংগ্রামী, তিনি ছিলেন একজন সাহসী নারী। তাঁর সঙ্গে তুলনা করা চলে সাহসী নারী লক্ষ্মীবাঈয়ের সঙ্গে। বেগম হজরত মহল ব্রিটিশ শাসকদের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। তিনি আত্মবলিদান বাহিনী তৈরি করেছিলেন। ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য তাঁর অহংকার ছিল। বেগমের জেনারেল ছিলেন রাজা জয়লাল সিংহ। নারীবাহিনীর প্রধান ছিলেন দলিতনারী উদয়া দেবী। বেগম হজরত মহলকে লক্ষৌ প্রাসাদের শেষ রক্ষাকতৃ হিসাবে গণ্য করা হয়। তাঁর তুলনা করা হয় ‘সিপাহী বিদ্রোহ’-এর নায়ক তাঁতিয়া টোপির সঙ্গে। ইতিহাস বলছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হজরত মহল ছিলেন ভারতীয় জাতীয়তবাদী নারীদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল নারী ব্যক্তিত্ব। এবং সম্ভবত সিপাহী বিদ্রোহ ছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন। বেগম হজরত মহল এই লড়াই করেছিলেন একা কারণ ব্রিটিশ শাসকরা তাঁর স্বামী নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ-কে কলকাতা যেতে বাধ্য করেছিল।
নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের সামজিক দর্শন ছিল সব সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে বসবাস করা। তিনি হোলি উৎসব একসঙ্গে পালন করতেন লক্ষৌ এবং মেটিয়াবুরুজে। কালিঘাটের তৎকালীন সম্মানীয় ব্যক্তি বাবু রূপচাঁদ মুখোপাধ্যায় নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে নিজের বাড়িতে দোলযাত্রার দিন আমন্ত্রণ জানাতেন। বাবু রূপচাঁদ উচ্চ ঘরানায় অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি সাস্ত্রীয় সঙ্গীত শুনতে ভালবাসতেন। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের সম্মানে দোলযাত্রা উৎসবে বাবু রূপচাঁদ সাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আয়োজন করতেন। নবাব নিজেও তাঁর কালীঘাট ম্যানসনে হোলি উৎসবের আয়োজন করতেন। মিষ্টি বিতরণ করে এবং রঙিন আবির মেখে লক্ষৌয়ের প্রাসাদেও নবাব হোলি খেলতেন। এবং সাস্ত্রীয় সঙ্গীত, নৃত্যের আয়োজন করা হত। বাবু রূপচাঁদ মুখোপাধ্যের বাড়িতে দোল উৎসবে এসে নবাব প্রথম দেখেন সাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সাধক যদু ভট্টকে।
১৮৬৭ সালের হোলি উৎসব ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। নবাব নিজে একজন ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে নেচেছিলেন তাঁর দরবার হলে। এই দৃশ্য মাত্র কয়েকজন দেখেছিলেন। কলকাতার সংগীত সভার কয়েকজন সদস্য সাক্ষী হিসেবে ছিলেন সেদিন। যেমন অঘোরনাথ চক্রবর্তী, সাজ্জাদ মহম্মদ এবং আরও কয়েকজন সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন সেদিনের দরবার হলে। এই অনুষ্ঠান ছিল স্মরণীয় একটি অনুষ্ঠান। নবাব নিজে লক্ষৌ ঠুমরী পরিবেশন করেছিলেন। সামাজিক সম্প্রীতির অন্যতম উজ্জ্বল উদাহারণ ছিলেন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। তাঁর নিজস্ব ঘরানার ‘ঠুমরী’ সংকীর্ণ ধর্মীয় সীমানা প্রাচীর ভেঙে এক খোলা আঙিনায় পৌঁছে দিয়েছিল তৎকালীন সমাজকে। কৃষ্ণ সংস্কৃতির ঘরানায় নবাব নিজে গান কবিতা লিখতেন। হিন্দু দেবতা হরি, রাধা এবং যুগল কিশোরকে আঙ্গিক করে তিনি ‘লিরিক’ লিখে গেছেন।
সম্ভবত এই কারণে নবাব একবার আমন্ত্রণ পান নন্দলাল বসু এবং তাঁর ভাই পশুপতি বসুর কাছ থেকে। দোল উৎসবের দিন তাদের বাগবাজারের বাড়িতে একটি বড় সংগীত সন্ধ্যায় নবাব এসেছিলেন। সেদিনের অনুষ্ঠানে সম্মানীয় অতিথিদের অনুরোধে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ রঙিন আবির মেখে কথথক নৃত্য নেচেছিলেন। তাদের অনুরোধ তিনি ফিরিয়ে দিতে পারেননি।            
 দক্ষিণ কলকাতার মোমিনপুর এবং মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলের বাসিন্দারা নতুন করে সামাজিক আন্দোলনের এক নয়া অধ্যায় শুরু করতে চাইছেন। হজরত মহল এবং নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের পথ অনুসরণ করে এই অধ্যায়ের উদ্যোক্তারা বলছেন, অতীতের স্মৃতিচারণা করলে দেখা যাবে বিংশ শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত ভারতে তথা বাংলায় সামাজিক মেলামেশার সুযোগ অনেক বেশি ছিল। দুর্গাপুজোয় যোগ দিতেন সব সম্প্রদায়ের মানুষ। ঈদের সময় মুসলিম প্রতিবেশির বাড়িতে হিন্দু, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতিবেশিদের আমন্ত্রণ করে দাওয়াত দেওয়া হত। বিজয়া দশমী এবং ঈদের সময় সব ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব ধর্মের মানুষ উৎসবের আনন্দে পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করতেন। বা বলা ভালো কোলাকুলি করতেন। ‘বড়দিন’-এর অনুষ্ঠান আজও বৃহত্তর মানবতার মিলনের অনুষ্ঠান। অতীতের সেই চিরায়ত সামাজিক আদর্শকে ফিরিয়ে আনতে চান বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এই উদ্যোগের অন্যতম কান্ডারী ‘মনজিলাত’ এবং ‘আপনার প্রতিবেশীকে চিনুন’ সংস্থা। রবীন্দ্রনাথের কবিতা বলছে, ‘’মেঘ বলেছে যাব যাব, রাত বলেছে যাই,/ সাগর বলে কূল মিলেছে- আমি তো আর নাই।।/ দুঃখ বলে রইনু চুপে তাঁহার পায়ের চিহ্নরূপে,/ আমি বলি মিলাই আমি আর কিছু না চাই।।‘’             

     

Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?