রাগসঙ্গীতের আলাপচারিতার ‘আত্মীয়তা’ একটি বই


দীপেন্দু চৌধুরী
শুরুটা এরকম ধ্রুপদী পর্যায়ে উঠতে পারে প্রেক্ষাগৃহের দর্শক-শ্রোতৃমণ্ডলীদের কেউ বুঝেও উঠতে পারেনি। কারণ আমরা গিয়েছিলাম সঙ্গীত বিষয়ক একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি ছিল ২৭ এপ্রিল। অভিজাত জি ডি বিড়লা প্রেক্ষাগৃহের মঞ্চের পর্দা তখনও ওঠেনি। আমরা বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ পাচ্ছি। তবলা বাজছে। বাজছে সানাইয়ের নিচু মাত্রার সূক্ষ তান। বুঝে উঠতে পারছিলাম না, বই প্রকাশ হবে না সঙ্গীত সন্ধ্যা? পর্দার আড়াল থেকে সঞ্চালক সৌগত চট্টোপাধ্যয়ের ঘোষণা শুনলাম আমরা। সৌগত বলছে, আলোক শীর্ষক সঙ্গীত সংকলন প্রকাশের আগে আমরা মঙ্গলধ্বনির অনুষ্ঠান শুনব। সানাই বাজাবেন আহমেদ আব্বাস খান। সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করবেন সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। সানাই শিল্পী আহমেদ আব্বাস খান তাঁর সানাইয়ের সুরের মূরচ্ছনায় আমাদের আবিষ্ট করে রাখলেন। তাঁর সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করলেন সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সমান উচ্চতায়। ধ্রুপদী সঙ্গীত বিষয়ক একটি বইয়ের প্রকাশ অনুষ্ঠানের পরম্পরা এবং মর্যাদা রেখেই উদ্যোক্তারা এমন একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। আহমেদ আব্বাস খান বংশপরম্পরা এবং ধারবাহিকতায় এদিন সানাই বাজালেন। সানাই শিল্পী আহমেদ আব্বাস খানের পূর্বপুরুষ ছিলেন ওয়াজির আলি শাহ। তাঁর সানাইয়ের সুরের মূরচ্ছনায় মুগ্ধ করেছিলেন তিনি বাকিংহাম প্যালেসের শ্রোতাদের।
১৯১০ সালে পণ্ডিত মতিলাল নেহরু ভারতের বেনারস ঘরানার সানাই শিল্পী ওয়াজির আলি শাহকে লন্ডন নিয়ে গিয়েছিলেন। দূরদর্শনের সিগনেচার টিউনের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তাঁর সঙ্গে সানাই বাজিয়েছিলেন, ওয়াজির আলি শাহের নাতি, আহমেদ আব্বাস খানের বাবা পণ্ডিত আলি আব্বাস হোসেন। সানাই সম্রাট পণ্ডিত বিসমিল্লা খানের বেনারস ঘরানাকে সাফল্যের সঙ্গে বহন করে চলেছেন যে কজন শিল্পী তাঁদের মধ্যে আলি আহমেদ হোসেন ছিলেন অন্যতম। ২০১৬ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র আহমেদ আব্বাস খান ‘বেনারস’ ঘরানার পরম্পরা বয়ে নিয়ে চলেছেন। এদিনের মঞ্চে তাঁর সঙ্গে ছিলেন পণ্ডিত ওয়াজের আলি শাহের চতুর্থ প্রজন্ম আহমেদ আব্বাস খানের পুত্র মাস্টার বাফর আব্বাস খান। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাবাকে সঙ্গ দিল সে। ধ্রুপদী ঘরানার সানাই শিল্পী আহমেদ আব্বাস খানের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন আই সি সি আর প্যানেলভুক্ত এবং বেতার-দূরদর্শনের তালিকাভুক্ত শিল্পী সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
পরের অনুষ্ঠান বেহালায় সঙ্গীতানুষ্ঠান, বেহালা বাজালেন সাকেত সাহু। এবং সেতার বাজালেন কল্যাণ মজুমদার। দু’জন শিল্পীই ‘আলাপ’ নামক বইটির ধ্রুপদী মানের কথা মাথায় রেখেই বাজালেন। চৌষট্টিজন ধ্রুপদী ঘরানার শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়ে বইটি লিখেছেন সেতারশিল্পী শুভজিৎ মজুমদার। বইটির প্রকাশক দে’জ প্রকাশনী।       প্রকাশকরা দাবি করছেন, আলাপ কেবলমাত্র একটি গ্রন্থ নয়। এটি বাংলার মার্গসঙ্গীতের শিল্পীদের সঙ্গীত উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ। তাঁদের সঙ্গীত চেতনার অভিব্যক্তি। সেতার শিল্পী শুভজিৎ মজুমদার ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ত্রিধারা কন্ঠসঙ্গীত, যন্ত্রসঙ্গীত এবং তালবাদ্যের ত্রিবেণীকে উপজীব্য করে দীর্ঘদিনের পরিশ্রম করে বাংলার প্রথিতযশা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীদের হৃদমাঝারে ডুব দিয়ে সংগ্রহ করেছেন, তাঁদের হীরক কণাসম অমূল্য কথা, নিপুণ আলিম্পনে সেগুলি সাজিয়ে দিয়েছেন লেখক। পাঠক পাঠিকাদের জন মার্গসঙ্গীতের ইতিহাসে এটাই প্রথম আকরগ্রন্থ। দাবি লেখক এবং প্রকাশক কতৃপক্ষের।  
চৌষট্টিজন শাস্ত্রীয় শিল্পীর মধ্যে আছেন চোদ্দজন খ্যাতনামা ধ্রুপদী ঘরানার কন্ঠশিল্পী, কুড়িজন তবলা শিল্পী এবং তিরিশজন যন্ত্রশিল্পীর সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, উত্থান, পতনের কথা লেখক তুলে এনেছেন ৬৬৪ পৃষ্ঠার বইয়েবইটি লিখতে লেখক সময় নিয়েছেন চার বছর। বইটিকে বলা হচ্ছে ‘আলোক শীর্ষক সঙ্গীত সংকলন’এই বইয়ে ১২জন নতুন শিল্পীর নাতিদীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে।
বইটি প্রকাশের সময় এলো প্রত্যাশিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মঞ্চে এলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার অন্যতম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষক এবং সংগীতশিল্পী পণ্ডিত অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক, জঙ্গলমহলের লেখক ‘ঋজুদা’ ওরফে বুদ্ধদেব গুহ,পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ সহ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গীতশিল্পী, তবলাবাদক, যন্ত্রশিল্পীদের মধ্যে থেকে বিভিন্ন ধারার প্রায় তিরিশজন শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের  শিল্পীকে মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয়। একটি বিরল মুহূর্ত। অবিস্মরণীয় একটি ঘটনা। মঞ্চে ছিলেন দে’জ প্রকাশনীর কর্ণধার সুধাংশুশেখর দে এবং দে’জ প্রকাশনীর তৃতীয় প্রজন্ম শুভঙ্কর দে। শাস্ত্রীয়সঙ্গীত বিষয়ক ‘আলাপ’ বইটি প্রকাশের পরে পণ্ডিত অমিয়রঞ্জন বলেন, ‘’যে কাজটি করেছেন শুভজিৎ তিনি অসাধ্যসাধন করেছেন এইখানে থেমে গেলে চলবে না। আরও অনেক শিল্পী আছেন। তাঁদের খুঁজে বের করতে হবে।‘’
বুদ্ধদেব গুহ বলেন, ‘’সব শিল্পীদের কথা বলতে পারলে ভালো হত। মালবিকাদি, কাননবালা সহ অন্যদেরও সংযোজন করা হোক।‘’ শুভঙ্কর দে বলেন, ‘’এই বইটা আমাদের প্রকাশনীর সঙ্গীত বিষয়ক তালিকায় আরও একটি সংযোজন।‘’ বইটির লেখক শুভজিৎ মজুমদার দাবি করেন, ‘’বইটার নাম ‘আলাপ’ রেখেছি কারণ, রাগ সঙ্গীতে আলাপচারিতা করেছি। সাঙ্গিতিক তাত্বিক দিক ধরতে চেষ্টা করেছি এই বইয়ে। এটা একটা সাক্ষাৎকারের সংকলন। এই ধরণের সংকলন আগে কখনও হয়নি।‘’ পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘’স্কেলটা অনেক বড়। এই কাজ আমাদের খুব কাজে লাগবে। এর আগে বাংলা ভাষায় এত বড় কাজ হয়েছে কিনা আমি জানি না। এই বইয়ে সঙ্গীত জগতের বড় মূল্য আছে। শুভজিৎ আমার সেন্ট জেভিয়ার্স-এর সহপাঠী। দীর্ঘদিন যত্ন নিয়ে পরিশ্রম করে এই কাজ করেছে ও।‘’                           


Comments

Popular posts from this blog

দু’জন বাঙালি বিঞ্জানীর গণিতিক পদার্থ বিঞ্জানে বিশ্ব বিখ্যাত আবিষ্কার

‘ইউনিভার্সাল রিলিজিয়ন’ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্র

লোকসভা অধিবেশন শুরুর পরেই কি ধর্মঘট প্রত্যাহার?